ছিটমহলের মুক্তিগাথা

ব্রিটিশ শাসনকর্তা সিরিল র‍্যাডক্লিফের সক্রিয় পৌরহিত্যে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তিজনিত যে সীমানা নির্ধারণ-প্রক্রিয়া সাধিত হয়, সৃষ্টি হয় দুটি নতুন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান—তারই নানা বিরূপ ও অমানবিক ফলাফলের একটি হচ্ছে ‘ছিটমহল’। তা-ও আবার একটি-দুটি নয়, ১৬২টি বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো এসব ছিটমহলবাসী পাক্কা ৬২ বছর ধরে যে চরম মানবিক অধিকারহীনতার শিকার হয়েছেন, তারই বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে গবেষক গোলাম রববানীর গভীর গবেষণালব্ধ বই বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল: অবরুদ্ধ ৬৮ বছর-এর পাতায় পাতায়।

বইয়ের মুখবন্ধের শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেছেন ছিটমহলবাসীর বঞ্চনার কথা। বলেছেন, ‘১৯৪৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ যখন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিক পরিচয় লাভ করেছিল, তখন রাতারাতি ছিটমহলের বাসিন্দারা নাগরিকত্বহীন হয়ে পড়েছিল। সিরিল র‍্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় তারা হয়ে পড়েছিল “নিজভূমে পরবাসী”। কারণ তারা ছিটমহল নামক বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলোতে আবদ্ধ হয়ে যে দেশে আটকা পড়ে, সে দেশ তাদের ছিল না। সে দেশে তারা ছিল “ভিনদেশি”, অর্থাৎ “নিজভূমে পরবাসী”। আর দেশভাগের ফয়সালা অনুযায়ী তারা যে দেশের নাগরিক নির্ধারিত হয়, সে দেশের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না। তাই তারা ছিল রাষ্ট্র ও নাগরিকত্বহীন মানুষ। বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলা এবং ভারতের কোচবিহার জেলায় সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই ছিটমহলগুলো ছিল যেন একেকটি স্থলবেষ্টিত দ্বীপ। আর ছিটমহলগুলোতে আবদ্ধ, রাষ্ট্রহীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ছিল একধরনের বন্দিদশা, যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল এক অভূতপূর্ব মানবিক সংকট।’

মোট ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইয়ের অধ্যায়গুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক: ‘ছিটমহল: ধারণা ও বাস্তবতা’, ‘বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের উৎপত্তি’, ‘পাকিস্তান আমলে ছিটমহলের পরিপ্রেক্ষিত’, ‘বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল ইস্যু, ১৯৭১-২০১৫’, ‘ছিটমহলের অবরুদ্ধ জীবন-জীবিকা’, ‘ছিটের লোকের অর্থনীতি’, ‘ছিটমহলবাসীর আন্দোলন-সংগ্রাম’, ‘ছিটমহল বিনিময়’, ‘ছিটমহল বিনিময়কালীন পরিস্থিতি’, ‘বাংলাদেশ ও ভারতে বিলুপ্ত ছিটমহলের তুলনামূলক চিত্র’ এবং ‘সংকটের দুষ্টচক্রে ছিটমহলের মানুষ’। অধ্যায়গুলোর আগে আছে ‘মুখবন্ধ’ ও ‘প্রসঙ্গকথা’। এর শেষে আছে ‘পরিশিষ্ট’, ‘গ্রন্থপঞ্জি ও অন্যান্য’ এবং ‘নির্ঘণ্ট’।

গোলাম রববানীর একাগ্র পরিশ্রমের ফসল এ বইয়ের পাঠ আমাদের নিয়ে যাবে নতুন এক অভিজ্ঞতার ভেতরে। পড়তে পড়তে আমরা দেখব, বইটি রচনা করতে গিয়ে লেখক কেবল পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থসূত্র এবং অন্তর্জালে প্রাপ্ত প্রাসঙ্গিক তথ্যের সহায়তাই নেননি, নিয়েছেন ছিটমহলবাসীর সরেজমিন সাক্ষাৎকারও। ফলে ১১ অধ্যায়জুড়ে যে তথ্যের সমাহার রববানী ঘটান, সেখানে কোনো ফাঁকফোকরের সুযোগ নেই। প্রাসঙ্গিক তথ্যের বাইরে ফোলানো-ফাঁপানো কথার ফানুসও ওড়ানো হয়নি।

ছিটমহলবাসীর ৬২ বছরের চরম দুঃখ-কষ্ট, বন্দিদশা আর নিগ্রহের বিবরণ তুলে ধরার পাশাপাশি লেখক তুলে ধরেছেন তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রামের বিবরণ।

অবশেষে এই মানুষগুলোর জীবনে আসে সেই সন্ধিক্ষণ—২০১৫ সালের ৩১ জুলাই—এদিন মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কার্যকর হলো ছিটমহল বিনিময়। লেখক বলেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে প্রায় সাত দশক ধরে রাষ্ট্রহীন থাকা মানুষগুলো অবশেষে রাষ্ট্র ও নাগরিকত্ব পেয়েছে। চিকিৎসাসেবার অধিকার মিলেছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মিলেছে আইনি সুরক্ষাও। ছিটমহলের মানুষের কাছে এগুলোই সবচেয়ে বড় পাওয়া। কিন্তু তাঁদের মূল স্রোতে যুক্ত করার জন্য দরকার আরও অনেক কিছু।’

লেখক রববানী এখানেই থেমে থাকেননি। মুক্ত ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসনের রূপরেখা তুলে ধরেছেন এবং বর্তমানে যেসব সমস্যা তারা মোকাবিলা করছে, তার বিবরণ হাজির করার পাশাপাশি যথাসম্ভব হাজির করেছেন প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা। ফলে ছিটমহলবাসীদের সার্বিক কল্যাণ নিয়ে যাঁরা ভাবিত, তাঁদের জন্য এ বই হয়ে উঠেছে একটি দিকনির্দেশনাস্বরূপ গ্রন্থ।

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল: অবরুদ্ধ ৬৮ বছর

মোহাম্মদ গোলাম রববানী

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১৭

১৮৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৬০ টাকা।