'দেশভাগ ছিল একটা মারাত্মক ভুল'

>
উইলিয়াম ডালরিম্পল
উইলিয়াম ডালরিম্পল

প্রথম আলো: আপনি তো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাই প্রথমে জানতে চাই, ভারতীয় রাজনীতিক শশী থারুর যে বলেছেন, ব্রিটেনের অন্তত এটা স্বীকার করা উচিত যে তারা উপনিবেশের যুগে ভারতের অনেক ক্ষতি করেছে, আপনি কি তাঁর সঙ্গে একমত?

উইলিয়াম ডালরিম্পল: শশী থারুরের সেই অক্সফোর্ড বিতর্কের এক বছর আগে লন্ডনের সুপ্রিম কোর্টে আমাদের এক বিতর্ক হয়েছিল। বিষয় ছিল, উপনিবেশবাদ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভালো না খারাপ ব্যাপার ছিল। আমি শশীর পক্ষেই ছিলাম। বিতর্ক শুরুর আগে ৯০ শতাংশ ব্রিটিশ দর্শক উপনিবেশবাদ ভালো ব্যাপার-এর পক্ষে ছিল। তবে বিতর্কের শেষে তাদের অবস্থান ঘুরে যায়। ব্যাপারটা হলো, ১৬০০ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হলো, তখন বিশ্বের জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ আসত ব্রিটেন থেকে, আর ভারত থেকে আসত ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ রাজের স্বর্ণ সময়ে বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্রিটেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ দশমিক ১ শতাংশ আর ভারতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ ক্ষতি যে হয়েছে তা স্পষ্ট, আর আমি শশীর সঙ্গে একমত, ব্রিটেনের অন্তত স্বীকার করা উচিত যে তারা ভারতের ক্ষতি করেছে।

প্রথম আলো: ভারতবর্ষে তো হিন্দু-মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস আছে। তাহলে বিশ শতকের শুরুর দিকে তারা কেন এ রকম পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল? এটা কি শুধু ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ষড়যন্ত্রের কারণে হয়েছে, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?

ডালরিম্পল: আমি ঠিক তা মনে করি না, এখানকার হিন্দু-মুসলমানরা এত দুর্বল ছিল না যে ব্রিটিশরা একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিতে পারে। খেয়াল করে দেখবেন, ওই একই সময়ে কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যেও একই ব্যাপার ঘটেছে। তুরস্ক, সার্বিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। গ্রিস ও আর্মেনিয়ায়ও এটি ঘটেছে। তেমনি পাকিস্তানের উদ্ভবের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায়ও ঘটেছে। কোম্পানি আমলের নথিপত্রে পরিষ্কারভাবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি ছিল বলে আমি দেখিনি, তবে ভিক্টোরীয় যুগে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে এই নীতির কথা বলে থাকতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই ব্রিটিশদের এ-বিষয়ক সংগঠিত নীতি ছিল না। এ ছাড়া আমি মনে করি, এই অঞ্চলে হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সমন্বয় ও সহাবস্থান থাকলেও দুই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সহিংসতাও হয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে হিন্দু কায়স্থরা একসময় মাদ্রাসায় পড়ত, ফারসি ভাষা শিখত, অভিন্নতার কথা বললে তাদের মধ্যে পারস্য সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। মূলত উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং জাতিসত্তার সঙ্গে ধর্মের সমীকরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক গভীরভাবে এসব বিভাজন ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ ও পরিচিতি বোধের কারণে মানুষ ক্রমশ একটি খাঁচার মধ্যে ঢুকে গেছে। ফলে এ রকম সরলভাবে বলা যাবে না যে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে দিয়েছিল। ব্যাপারটা অনেক জটিল।

প্রথম আলো: ব্রেক্সিট প্রসঙ্গে আসি, আমরা শুনেছি যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনার পাশাপাশি ব্রিটিশ নাগরিকেরা তাদের দেশে অন্য ইউরোপীয় নাগরিকদের ভালোভাবে নেয়নি। এটা কি ব্রিটিশ জাত্যভিমানের পুনর্জাগরণ, এক সময় যা উপনিবেশের যুগে দেখা যেত?

ডালরিম্পল: হ্যাঁ, আমি মনে করি এটা এক বড় ও যুগান্তকারী পরিবর্তন। এর জন্য আমি জনপ্রিয় পত্রিকা ও ট্যাবলয়েড, বিশেষত রুপার্ট মারডকের মালিকানাধীন পত্রিকাগুলোকে দায়ী করব। ব্রিটেন মূলত এক ব্যবসায়ী দেশ, তারা সব সময় অন্যদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে টিকে থেকেছে। নিজেদের উন্মুক্ত রেখেছে। এটা এক মহাকাব্যিক ভুল, যেটা আমাদের সমৃদ্ধির বারোটা বাজিয়ে দেবে। আমি এতে কতটা বিপর্যস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

প্রথম আলো: উপমহাদেশের রাজনীতি থেকে বিভেদ দূর হয়নি। এখনো মনে হচ্ছে, আমরা ১৯৪৭ সালের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। কীভাবে এর অবসান ঘটতে পারে?

ডালরিম্পল: ব্রেক্সিট যেমন ব্রিটেনের জন্য বড় ভুল হয়েছে, উপমহাদেশের জন্য তেমনি দেশভাগ। উন্মুক্ত ও বহু সংস্কৃতির ব্রিটেন যেমন কাঙ্ক্ষিত ছিল, তেমনি ভারতের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম এখানে চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল।ধর্ম থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অর্থাৎ চিন্তা, আচার-আচরণ, ভাষা, খাদ্য, সংগীত, নৃত্য—সবকিছুতেই হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। এমনকি ধর্মীয় সংমিশ্রণও ঘটেছিল। তাই দেশভাগ ছিল একটা মারাত্মক ভুল। এটা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও ভারত এখনো বহুত্ববাদ ধরে রেখেছে।

প্রথম আলো: সম্প্রতি ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পরও আপনি কি এ কথা বলবেন?

ডালরিম্পল: হিন্দুত্ববাদের উত্থান উদ্বেগজনক ব্যাপার। তবে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেছেন অর্থনৈতিক খাতে কংগ্রেসের অযোগ্যতার কারণে। আর তারা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, ব্যাপারটা একদম প্রকাশ্য হয়ে গিয়েছিল। মানুষ ভেবেছিল, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে ভারতকে একটি শক্তিশালী সরকার উপহার দেবে। আমি মনে করি না যে হিন্দুত্ববাদের কারণে মোদি ক্ষমতায় এসেছেন। এমনকি বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণায় হিন্দুত্ববাদ ছিল না। কিন্তু তিনি সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করতে পারছেন না। তিনি যে কাঠামোগত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে পারেননি। মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় অর্থনীতি হোঁচট খাচ্ছে, গতি পাচ্ছে না। ফলে মানুষ খুব হতাশ হচ্ছে। কিন্তু এখনো তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয়, রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস সর্বশক্তি নিয়ে নামতে পারছে না। রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনছেন। তিনি যত দিন কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকছেন, তত দিন মোদি স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় থাকবেন। জনগণ দেশের ভার রাহুল গান্ধীর হাতে দিতে ভরসা পায় না। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হলো, মোদি হিন্দুত্ববাদী আদর্শ নিয়ে এগোচ্ছেন।

আর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহের কারণে ভারত ও পাকিস্তান সামরিক খাতে প্রচুর ব্যয় করছে, যা উভয়ের জন্যই বিপর্যয় বয়ে আনছে। অথচ দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য হতে পারত, পাকিস্তানের অনেক চাহিদাই ভারত পূরণ করতে পারত। ফলে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এক বড় বিপর্যয়, যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। এই অবিশ্বাস দূর করতে পারলে ক্ষত শুকাতে পারে, তা না হলে নয়।

প্রথম আলো: ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ শিরোনামের প্রবন্ধে আপনি বলেছেন, এখন আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। তার সঙ্গে আবার চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের কথা বলা যায়। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রগতির কী সম্ভাবনা দেখছেন?

ডালরিম্পল: এই অবস্থায় অগ্রগতির প্রশ্নই ওঠে না। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখছি না। একদিকে এ ব্যাপারে পাকিস্তানি জেনারেলদের আগ্রহ নেই, তেমনি মোদিরও আগ্রহ নেই। এতে কিন্তু সবারই ক্ষতি। এই অবস্থায় আফগানিস্তান প্রক্সি যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। হাক্কানি নেটওয়ার্ক আফগানিস্তানে ভারতীয় স্বার্থে হামরা চালিয়েছে, তবে এখনো সেটা বড় কিছু হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তালেবানরা যতই আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ছে, ততই সেখানে বড় বড় ভারতীয় বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমে আসছে। ভারতীয় স্বার্থ ক্রমশই সেখানে সংকুচিত হচ্ছে, এতে পাকিস্তান খুশি।

প্রথম আলো: আপনি কি বলতে চাইছেন, আমরা এক অচলাবস্থায় পতিত হয়েছি?

ডালরিম্পল: হ্যাঁ, এটা এক অচলায়তনই বটে। আর মোদি যত দিন ক্ষমতায় আছেন, তত দিন এই পরিস্থিতির উত্তরণের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করি না। মানে নেতানিয়াহু যত দিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আছেন, তত দিন ফিলিস্তিনিদের আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই।

প্রথম আলো: ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন শিশু মৃত্যুর হার, টিকাদান কর্মসূচি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশর কেমন সম্ভাবনা দেখেন আপনি?

ডালরিম্পল: বাংলাদেশ নিয়ে আমি কখনো কাজ করিনি, তাই আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে অবশ্যই বাংলাদেশের যেমন অনেক সম্ভাবনা আছে, তেমনি অনেক সমস্যাও আছে। গত বছর হলি আর্টিজান বেকারিতে চরমপন্থী হামলার ঘটনায় আমরা দেখলাম, পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে আমি সামগ্রিকভাবে আশাবাদী, তবে তার জন্য তিন দেশেই ধর্মীয় চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।