সান্তা-ফের শিল্প-পরিব্রাজক

নীল বর্ণের ঘোড়া, হরিণ ও নারী
নীল বর্ণের ঘোড়া, হরিণ ও নারী

বাসে চেপে যাচ্ছি সান্তা-ফে শহরের প্লাজার দিকে। সহযাত্রী কেবল একজন প্যাসেঞ্জার। চুল-দাড়িতে ভবসব এ প্রৌঢ় কোমরে আধময়লা কম্বল জড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন রংচঙে গ্লসি একটি আর্ট ম্যাগাজিন। পরিধেয় হিসেবে কম্বল প্রথাগত ড্রেসকোডের অন্তর্ভুক্ত নয়। তদুপরি ভদ্রসন্তানের গলায় সাইকেলের আস্ত একখানা চাকা আটকানো দেখে আমার কৌতূহল সামলানো দুরূহ হয়ে ওঠে। একাধিক স্পাইকের কারণে ইচ্ছা করলেই গলায় বাইসাইকেলের চাকা সাতনরি হারের মতো করে পরে ফেলা যায় না। এ ধরনের বস্তু কণ্ঠে ধারণের জন্য জরুরত জবরদস্ত রকমের প্রতিভার। আমার সহযাত্রীর সেই রকমের কৃৎকৌশল জানা আছে নির্ঘাৎ, তিনি চাকার ভেতরে আরেকটি মিনিয়েচার রিং ঢুকিয়ে অবলীলায় তাঁকে অলংকার হিসেবে এস্তেমাল করছেন। আমি গাছপাগল বলে একটি লবজের সঙ্গে আশৈশব পরিচিত, তবে ইতিপূর্বে কখনো চক্র-উন্মাদের সঙ্গে মোলাকাত হয়নি বিধায় বেজায় ইমপ্রেসড হয়ে তাঁকে সম্ভাষণ করি, ‘গ্রিটিংস স্যার’। তিনি ম্যাগাজিন সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘সান্তা-ফেতে মনে হয় পয়লা আসা হয়েছে?’ আমি সম্মতিসূচকভাবে মাথা হেলালে তিনি স্বগতোক্তির মতো বলেন, ‘দিস ইজ আ ক্রিয়েটিভ মেকা, এখানে মানুষ আসে হয় আর্ট অবজেক্ট খরিদ করতে, নতুবা তাদের আগমন হয় সাথি গোছের জোড় খুঁজে বের করতে। তোমার ঘটনা কী?’ আমি জবাব দিই, ‘চিত্রকর্মের ক্রেতা আমি নই, আর্টের বিষয়-আশয় স্রেফ ঘুরেফিরে দেখতে এসেছি স্যার।’ তিনি একটু ঝুঁকে মাছি মারার কায়দায় আমার স্কন্দে চাঁটি মেরে বলেন, ‘ইউ আর ইন দ্য রাইট প্লেস মাই ফ্রেন্ড। দেয়ার আর মোর আর্ট গ্যালারিজ হিয়ার পার স্কয়ার ফুট দেন অ্যানি প্লেস অন দিস প্ল্যানেট।’ বাস থামতেই কোনো রকমের বিদায় সম্ভাষণ না করে নেমে যান তিনি। সে সময় নজর করি, কম্বলওয়ালা পাঁজরের কাছে সম্বল হিসেবে জাপটে ধরে আছেন ক্রুশকাষ্ঠের আকৃতিতে তৈরি মাছ ধরার জাল দিয়ে জড়ানো ঢাউস একটি তুলি।

বোম্ব-কেসে পশুর করোটি
বোম্ব-কেসে পশুর করোটি

পরবর্তী স্টপেজের দিকে ছুটে চলে বাসটি। মনে মনে একটি বিষয় নিয়ে তর্পণ করি আমি, কম্বলওয়ালা কী কোনো গির্জার দেয়ালে ক্রুশকাঠ-প্রতিম ব্রাশ দিয়ে আরাধনার চিত্র আঁকবেন?

পরবর্তী স্টপেজে নেমে পড়ে এক জামানায় যেখানে স্প্যানিশ গভর্নরের প্রাসাদ ছিল, তার পেছন দিকে চলে আসি। এখানে দাঁড়িয়ে সুজান সামার বা সুজির জন্য মিনিট পনেরো অপেক্ষা করব। কয়েক পা এগিয়ে সিমেন্টে তৈরি স্কয়ারের কাছে দাঁড়াই। চাতালটির শক্তপোক্ত মোজাইক ভেদ করে লম্ফ দিয়ে উঠছে রাঘববোয়ালাকৃতির কতিপয় মাছ। বাস্তবজীবনে এ ধরনের মৎস্যকুলের হেবিটাট নীল দরিয়া হলেও শিল্পকলার তেলেসমাতিতে পাথরের খটখটে ফাউন্ডেশন ফুঁড়ে এদের উত্থান সম্ভব হচ্ছে দেখে তাজ্জব হই।

মাছ লাফানো স্কয়ারের পেছনে ধূসরে হালকা গোলাপি মেশানো কাদামাটির লেপাপোঁছা আডোবি দালানকোটা। এগুলোর ব্যালকনি ও ছাদ অতিক্রম করে সাংগ্রে ডে ক্রিস্ত পাহাড়ের দিকে ছড়িয়ে আছে আমেরিকার আদিবাসীদের ট্রাপেস্ট্রির মতোই বর্ণবহুল আকাশ। তার তীব্র নীল কসমিক শামিয়ানার তলায় ক্রিমসন রঙের মেঘমালায় জ্বলছে ক্যাম্প ফায়ারের আভা। এ দৃশ্যপটের দিকে নজর করে আজকের মখতোসর আর্ট ট্র্যাভেলে সুজি যে আমার সহযাত্রী হচ্ছে, বিষয়টি ভেবে তার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করি আমি। সুজির সঙ্গে সহৃদয়তার সূত্রপাত ২০০৬ সালের দিকে, আমার সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ার বসবাসের সময়। সুজান সামার বা সুজি একটি দূতাবাসের কূটনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিল। অবসর সময়ে সে প্রিটোরিয়ার মামালোদি টাউনশিপের বাস্তুহারা শিশু-কিশোরদের ছবি আঁকা শেখাত। সুজি তার উদ্যোগে শামিল হওয়ার জন্য আমাকে প্ররোচনা দিলে—যেহেতু আমি আঁকাজোকাতে অক্ষম—তাই খিচুড়ি রান্না করে আঁকতে আসা বাচ্চাদের খিলানোর বন্দোবস্ত করি।

তারপর কেটে গেছে এগারো বছরের সম্পূর্ণ এক মুদ্দত। আফ্রিকার নানা দেশে আমার বসবাসের মেয়াদ সমাপ্ত হয়েছে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সান্তা-ফে শহরের প্রান্তিকে পরবাসী হয়েছি আমি। সুজি বাস করছে এ নগরীর একটি নেইবারহুডে। টেলিফোনে তার সম্পর্কে যা জেনেছি, তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, ক্রমাগত একধরনের আবগারি তাম্বাকু সেবনের অভিযোগে ডিপ্লোমেটিক কোর থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর অ্যাগ্রেসিভ একধরনের ক্যানসারে ভোগার পর শরীরে একাধিকবার সার্জারি করিয়ে রোগমুক্ত হালতে সে হালফিল বাস করছে সান্তা-ফেতে।

সুজির কথা ভাবতে ভাবতেই রংচটা একখানা বিটআপ কার হাঁকিয়ে এসে হাজির হয় সে। সাত রঙে ঝিলিক পাড়া অরগাঞ্জা মেটেরিয়ালে তৈরি একটি বহো কেতার স্কার্টের সঙ্গে কপাল প্যাঁচিয়ে রংধনু আঁকা স্কার্ফ পরে এসেছে সে। তাতে তার ক্যানসারে ভোগা পাণ্ডুর মুখে এসে পড়েছে রঙের ছটা। আমি তার সঙ্গে উষ্ণ হাগ বিনিময় করতে করতে জানতে চাই, ‘সুজি, তোমার হাজব্যান্ড জেরি আজ কোথায়? তাকে আনলেই তো পারতে।’ সে জবাবে ঠোঁট উল্টে জানায়, ‘এনাফ অব হাজব্যান্ড ইন মাই লাইফ, টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, আই গট রিড অব জেরি, হি ইজ গন।’

তেমন অবাক হই না আমি। যতটা জানি, ইতিপূর্বে সুজি বিবাহিত হয়েছিল আরও বার দুয়েক। ভবিষ্যতেও হবে হয়তো। আমাকে নীরব দেখে সে কবজি জাপ্টে ধরে বলে, ‘আই অ্যাম নো লংগার সুজান সামার। জেরি সামারকে বিতাড়নের পর আমি আমার লাস্ট নেম পাল্টে করেছি নিউ-মি। অর্থাৎ নতুন করে জীবন শুরু করতে যাচ্ছি।’ আমি তার নিউ লাইফের শুরুয়াতকে আন্তরিকভাবে কংগ্রাচুলেট করতে গেলে সে ঘন হয়ে কাছে চলে এসে বলে, ‘আই অ্যাম এগেইন সিঙ্গোল, সো, ফ্রি টু মিঙ্গোল।’ ঘটনাটিকে আমি একনলেজ করি; এবং অনেক দিন পর স্বামীর শিকলি কাটা সাবেক পরস্ত্রীর ওষ্ঠে চুম্বন করার বিরল সুযোগ পাই।

আধিকারিক মহিলার কাঁধে লাভ-বার্ড ‘হ্যাপি’
আধিকারিক মহিলার কাঁধে লাভ-বার্ড ‘হ্যাপি’

সুজির সঙ্গে সান্তা-ফেতে ঘুরে বেড়ানোর প্রধান ফায়দা হচ্ছে সে এ শহর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সুতরাং এখানকার প্রাইমারি আর্ট ডিসট্রিক্ট কেনিয়ান রোডে যেতে আমাকে পথঘাট কিছু তুকাতোকি করতে হয় না। আমরা স্প্যানিশ গভর্নরের পড়ো প্রাসাদের দীর্ঘ বারান্দা ধরে পয়দলে আগ বাড়ি। ওখানে মাদুর বিছিয়ে ফিরোজা পাথর দিয়ে তৈরি জেওরাতের পসরা সাজিয়ে বসেছেন নেটিভ আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ান দোকানিরা। চুলের পনি টেইলে পাখির পালক গাঁথা এক পাথরের কারবারি সুজিকে ইশারা করে বলেন, ‘হানি, পে অ্যাটেনশন টু আওয়ার কালারফুল কমোডিটিজ।’ না থেমে ওষ্ঠে আঙুল রেখে উড়ন্ত চুমুর ভঙ্গি করে প্রাসাদের বারান্দা থেকে নেমে আসে সে। হাঁটতে হাঁটতে আমাকে আর্ট ডিসট্রিক্ট সম্পর্কে খানিকটা ব্যাকগ্রাউন্ডও দেয়।

পাহাড় ও উপত্যকার সমাহারে সৃষ্ট সূর্যস্নাত ল্যান্ডস্কেপের আকর্ষণে শিল্পী ও লেখকেরা এখানে আসতে শুরু করেন ১৯২০ সাল থেকে। এঁদের মধ্যে ইংরেজ উপন্যাসিক ডি এইচ লরেন্স বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সান্তা-ফে শহর থেকে অল্প দূরে লবো মাউনটেনের একটি নির্জন রেঞ্চে তিনি বাস করেন ১৯২০-২২ সাল অব্দি। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৮ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতায় একটি নির্জন রেঞ্চে বসে তিনি মুসাবিদা করেছিলেন দ্য প্লুমড সারপেন্ট নামের উপন্যাসের অনেকগুলো অধ্যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা চিত্রশিল্পী জর্জিয়া ওকিফ (১৮৮৭-১৯৮৯) অত্র এলাকায় ঘর বাঁধেন ১৯২৯ সালে। তখন তিনি ফুলের প্রতিকৃতিতে প্রজননের প্রতীক সমন্বয় করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সান্তা-ফের কাছাকাছি একটি সুদর্শন পাহাড়ে দিনযাপনের সময় তাঁর রং-তুলিতে ফোটে গোধূলি ঝলসানো রক ফরমেশন ও ডেজার্টের প্রান্তিকে নেমে আসা আসমানের বর্ণিল চিত্রপট।

ঝিরিঝিরি জলের ঝরার পাশে অটামের সোনালি পত্রালি শোভিত বৃক্ষছায়ায় ভরপুর পায়ের চলার ট্রেইলে আমরা দেখতে পাই অনেকগুলো নেটিভ আমেরিকান টোটেমপল। এখানকার ব্রেথটেকিং নিসর্গমায়ায় আমি খানিকটা অন্যমনস্ক হলেÑ সুজি কিছু জরুরি তথ্য দিয়ে আমার ফোকাস ফিরিয়ে আনে। সান্তা-ফের দুই শর অধিক আর্ট গ্যালারির অর্ধেকের অবস্থান কেনিয়ান রোডে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত চিত্রকর এস জে শ্যাফার বা ডেভিড ডেভারির যেমন মোলাকাত পাওয়া কঠিন কিছু না, তেমনি শিল্পকলার পসরা সাজিয়ে গ্যালারিতে হামেশা ঘুরপাক করছেন বহেমিয়ান ঘরানার সৃজনশীল শিল্পীবৃন্দ। আঁকাজোকাতে এঁরা যেমন মুনশিয়ানার পরিচয় দিচ্ছেন, একইভাবেœব্যতিক্রমী ধরনের দিনযাপনেও এঁদের রেপুটেশন কিংবদন্তির কাছাকাছি।

হাঁটতে হাঁটতে সেতু অতিক্রম করতেই দেখিÑগাছের গোড়ায় খয়েরি পাথর কুঁদে তৈরি আরেকটি বৃক্ষের আকৃতি, তাতে চড়ে দারুণ উৎসুক্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে ক্রীড়াচ্ছলে মেতে আছে কয়েকটি শিশু-মূর্তি। এখান থেকেই আদতে শুরুয়াত হয়েছে আর্ট ডিসট্রিক্টের। একটি আঙিনায় নীল বর্ণের ঘোড়ার ভাস্কর্য দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। নুড়িপাথর ছড়ানো উঠানে বসে জাবর কাটার উদ্যোগ নিচ্ছে দুটি হরিণ। রমণীর এক প্রতিমূর্তি নীরবে ঘড়া থেকে ঢালছে জল। আঙিনার কোনায় এ দৃশ্যপটের শরিক হয়ে রংতুলি দিয়ে আঁকছেন এক নারী চিত্রকর। আমার কৌতূহল দেখে আঁকা থামিয়ে হাসিমুখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান তিনি। তাঁর সঙ্গে বাতচিত করতে পারলে তো বেশ হয়। ভাবি, ঢুকে পড়ব এ গ্যালারিতে। কিন্তু সুজি রাজি হয় না। সে আমার কব্জি টেনে ধরে আগ বাড়তে ইশারা করে। বিষয় কী জানতে চাইলে সে বলে, এই নারী চিত্রকর আচার-আচরণে টেরিবল। সুজি অপ্রতিষ্ঠিত চিত্রকরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের বায়ো কম্পাইল করার চেষ্টা করছে। তার আকাঙ্ক্ষা এঁদের জীবনযাপনসংক্রান্ত তথ্য দিয়ে একটি ব্লগ তৈরি করা। তো, দিনকতক আগে এই নারী চিত্রকরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি নাকি তাঁর সঙ্গে সলুক খারাপ করেন।

সড়কের পাশের কামপাউন্ডে রাখা অনেকগুলো বিমূর্ত ভাস্কর্য। ‘হ্যাপি টুগেদার’ শিরোনামের একটি পাথরের শিল্পকর্মে বসে আছে ছোট ক্বদের তিনটি পাখি। ধূসর রকের প্রেক্ষাপটে নরম পালকের খেচরগুলো তাদের মিথস্ক্রিয়ায় ছড়াচ্ছে দুর্দান্ত রকমের হারমনি। কাছ থেকে নজর করে দেখার জন্য আমরা ঢুকে পড়ি হরেক রকম শেইপের পাথুরে আকৃতি দিয়ে ভরপুর ভাস্কর্যের বাগিচায়। এ কাজগুলোর শিল্পী গিলবারতো রোমেরোর সঙ্গে সুজির পরিচয় আছে। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের একজন সাবেক সৈনিক। যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাঁকে একটি অন্ধকার গুহায় তালাবদ্ধ করে রাখে গেরিলারা। সুড়ঙ্গ তৈরি করে পালিয়ে আসার ভেতর দিয়ে তাঁর পাথর কুঁদে কাজ করার হাতেখড়ি হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে শামিল হওয়ার অপরাধে রোমেরোকে ফেরারও হতে হয় কিছুকাল। তখন কাছাকাছি রকি মাউন্টেনের একটি অন্ধকার গুহায় বছর খানেক বাস করেন তিনি। অতঃপর ধরা পড়ে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে কাটান কয়েক বছর। ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই আলোর আরাধনা করছেন রোমেরো। মরুপাহাড়ের দিগন্ত প্রসারিত বৃক্ষহীন প্রান্তরেÑ সুরুজের আলোকিত ক্যানোপির নিচে শতরঞ্জি বিছিয়ে নিশিযাপন করতে পছন্দ করেন। পাহাড় থেকে পাথর সংগ্রহ করে তা কেটে-কুঁদে তৈরি করেন বিচিত্র আকৃতি।

এই মানুষটির সঙ্গে মোলাকাতের প্রত্যাশায় গ্যালারি অতিক্রম করে আমরা চলে আসি তাঁর খোলামেলা স্টুডিওতে। দেখি, ঝলমলে রোদের ভেতর পেল্লায় একটি রকের সামনে তব্দিল হয়ে ছেনি হাতে বসে আসেন শিল্পী। আমি তাঁকে ‘গুড আফটারনুন’ বললে ড্যাবড্যাব করে তাকান তিনি। কোনো জবাব দেন না। তাই সুজিকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কথা বলছেন না কেন, রোমেরো সাহেব?’ সে ফিক করে হেসে জানায়, ‘কাটফাটা রোদ মাথায় চড়ে বসেছে, এতে সবকিছু গুলিয়ে হয়তো কথা বলা স্রেফ ভুলে গেছেন।’

আমরা আবার ফিরে আসি গ্যালারিতে। ওখানে দেখা হয় রোমেরোর ভাস্কর্য বিক্রির আধিকারিক মহিলার সঙ্গে। ছোট্ট একটি লাভ-বার্ড নিয়ে মেতে আছেন তিনি। পুঁচকে পাখিটি উড়ে এসে তুলে নিচ্ছে তাঁর ঠোঁটে রাখা সূর্যমুখী ফুলের বীজ। তারপর গিয়ে বসছে তাঁর কাঁধে। আমাদের দেখতে পেয়ে পাখিটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। লাভ-বার্ডের নাম ‘হ্যাপি’। অত্র এলাকা লাভ বার্ডের প্রাকৃতিক হেবিটাট নয়। হ্যাপি সম্ভবত কারও খাঁচা উজাড় করে পালিয়ে এসে ঘর বেঁধেছে ভাস্কর গিলবারতো রোমেরোর সঙ্গে। আজকাল রোমেরো মশাই এ লাভ-বার্ডকে মডেল করে গড়ে তুলছেন একের পর এক ভাস্কর্য।

গ্যালারি ছেড়ে সরণিতে নামতেই দেখিÑবিয়ের কনের শুভ্র গাউন পরে হাতে একগুচ্ছ ক্রিসেনথিমাম নিয়ে হাঁটছে এক যুবতী নারী। সে ফিরোজা পাথরের মতো নীলাভ চোখে রাজ্যের মায়া ছড়িয়ে তার পার্সটি তুলে দেখায়। তাতে লেখা ‘বিক্রি করছি চুম্বন, মাত্র দশ ডলারের বিনিময়ে।’ আমি স্বভাবে কঞ্জুস, তাই ডলার ব্যয় করতে চাই না। আমার অসম্মতিতে হেসে কাঁধ ঝাঁকায় সে। তাতে ঝিলমিল করে ওঠে তার বুকের সি-থ্রু ডিপকাটে জড়ানো অনেকগুলো বর্ণিল পাথর। ঝিনুক খোঁজা হাঁসের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে সে অগ্রসর হয় ভিন্ন খদ্দেরের তালাশে। সুজি আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে স্বগতোক্তি করে, ‘পুওর গার্ল, নট ম্যানেজ টু হুক ইউ আপ। সে গৃহহীন চিত্রকরদের জন্য ফান্ড কালেক্ট করছে।’ শুনে নিশ্চুপ থাকি আমি।

কৃত্রিম গাছে শিশু-মূর্তি
কৃত্রিম গাছে শিশু-মূর্তি

পথের পাশে ‘ডার্ক বার্ড প্যালেস’ লেখা আরেকটি গ্যালারি। আমরা ঢুকে পড়ি ওখানে। দেয়ালে কতগুলো কাকের ছায়ামূর্তির মতো আবছা পোট্রে৴টের নিচে একটি বোম্ব-কেস। বারুদহীন বোমার কনটেইনারে রাখা একটি লোমশ বন্যজন্তুর করোটি। আলোকচিত্রে আমি তা ধারণ করতে গেলে নাকে এসে লাগে পোড়া মরিচের ঘ্রাণ। সুজি ব্যাখ্যা করে, ভেতরের স্টুডিওতে শিল্পী কেলি মুর ফ্রাইপ্যানে মরিচ ভাজছেন। তাঁর সৃজনী প্রেরণার ঘাটতি হলে তিনি নাকি মরিচের ধোঁয়ায় স্মোক-বাথ করেন। নাকে রুমাল চেপে আমি জানতে চাই, ‘কেলি সাহেবের আর কোনো আচরণ সম্পর্কে তোমার কাছে স্পেসিফিক তথ্য আছে কি সুজি?’ সে নাক থেকে স্কার্ফ সরিয়ে বলে, ‘তিনি চারটি কাককে পোষ মানিয়েছেন। সকালবেলা পাহাড়ের নির্জনে যখন জগিং করেন, কাকগুলো তখন তাঁর পাশে পাশে ওড়ে।’

সুজির বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই স্টুডিওর দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন শ্রীযুক্ত কেলি মুর। তাঁর হাতে ফিরোজা পাথর বসানো একটি পিস্তল। তিনি আমাদের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে জানতে চান, ‘হোয়াট দ্য হেল আর ইউ গাইজ ডুয়িং হিয়ার?’ আমি দেয়ালে কাকের একটি ছায়াচিত্র দেখিয়ে জবাব দিই, ‘এ ছবিটি কিনতে চাই।’ তিনি মৃদু হেসে জবাব দেন, ‘ইট কস্ট অ্যাবাউট সিক্সটিন থাউজেন্ড ডলার।’ অত টাকা খরচ করে কালো কাউয়ার ছবি খরিদ করার এরাদা আমার নেই। তাই বলি, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট মাচ মানি।’ তিনি যেন ধাঁধার উত্তর চাইছেন, এ রকম ভঙ্গিতে বলেন, ‘তোমার হাতে যদি কাকতালীয়ভাবে ষোলো হাজার ডলার এসে যায়, তাহলে এ চিত্রটি তুমি কিনবে কি? আনসার মি ট্রুথফুলি।’ আমি জবাব দিই, ‘নো স্যার।’ হাসিটিকে বিস্তৃত করে এবার তিনি জনতে চান, ‘ছবি তো কিনবে না বুঝতে পারলাম, কিন্তু এত টাকা দিয়ে তুমি কী করবে?’ আমার সাওয়াল, ‘বৃক্ষের ডালায় ট্রি হাউস বানিয়ে তাতে বসবাস করব।’ তিনি পিস্তল উঁচিয়ে বলেন, ‘দেন গেট দ্য হেল আউট অব হিয়ার।’

সড়কে ফিরে আসতেই দেখি, নিজের ছায়াকে অনুষঙ্গী করে বাসে মোলাকাত হওয়া সেই কম্বলওয়ালা মানুষটি ক্রুশকাষ্ঠের মতো দেখতে পেল্লায় তুলিটি উঁচিয়ে ধরে হাঁটছেন। মাছ ধরার জালটি তিনি মাথায় পেঁচিয়েছেন পাগড়ির মতো। তাঁর আদুল গতরে ও গলার চাকায় তাজা রক্ত বা লাল পেইন্টের ছাপ। আমার উপস্থিতিকে আমলে না এনে তিনি ফেরিওয়ালার মতো থেকে থেকে হাঁক পাড়েন, ‘সাংগ্রে ডে ক্রিস্ত বা যিশুখ্রিষ্টের রক্ত।’ আমি হাঁ করে তাঁর দিকে তাকাচ্ছি দেখে সুজি ফিসফিসিয়ে বলে, ‘উনি হোমলেস আর্টিস্ট অ্যালবেরতো গনজালেস, বিকেল ঘনিয়ে এলে তিনি চার্চের উঠানে নুড়িপাথর ও বালুকা দিয়ে তৈরি করবেন ক্রুশের আইকন।’ শুনে আমি অবাক হয়ে ফের তাকালে সুজি জানতে চায়, ‘তুমি কি আইকন তৈরির প্রক্রিয়া দেখতে চার্চে যেতে চাও?’ প্রবল জোশের সঙ্গে জবাব দিই, ‘ওহ্, ইয়েস। আই অ্যাম অল ফর ইট হানি।’