এক গুল্লু এক চম্পু

অনেক অনেক দিন আগের কথা নয়। এই তো সেদিনকার কথা, যখন মানুষ বুঝল যে মাটির ওপর সমান্তরালে বেড়ে আর লাভ নেই, কতই-বা বাড়া যাবে! বরং উঠতে হবে আকাশের দিকে। সেখানে বহু জায়গা। তো, বেলুন দিয়ে উড়ে প্রথমে আকাশের মাঝখানে খানিকক্ষণ ঝুলে থাকল। দেখল, বেশিক্ষণ ঝোলা যায় না। একসময় ধীরে ধীরে সোজা মাটিতে এসে পা ঠেকে। তারপর নেমে এসে আরও বেশি করে বাতাস ভরে ওপরে উঠল। দেখল, থাকা তো যায় কিন্তু বেলুনের সুতো ছেড়ে দিলেই ধপাস। শেষে ঠিক করল, দেয়াল আর ছাদ বানিয়ে, তার ওপর আবার দেয়াল আর ছাদ বানিয়ে, তার ওপর আবারও দেয়াল আর ছাদ বানিয়ে আকাশে উঠে যাবে। তারপর ছাদগুলোকে মেঝে বানিয়ে দিব্যি থাকতে পারবে। প্রথমে বেলুন দিয়ে ওঠানামার ব্যবস্থা হলো। পরে ইটের মাথায় ইট, তার ওপর আরেকটা ইট, তারও ওপর আরেকটা ইট দিয়ে তৈরি হলো এক রাস্তা। রাস্তার নাম রাখা হলো সিঁড়ি। ব্যস, আর যায় কোথায়, আকাশকে কোথাও ফাঁকা রাখবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল মানুষ। ওপরে উঠতে উঠতে আকাশটাই ঢেকে ফেলবে এই হলো সিদ্ধান্ত।

ছাদ আর দেয়াল বানিয়ে আকাশ দখল করার এক কোম্পানিতে গুল্লু নামের নিতান্তই আবেগপ্রবণ আর সহজ-সরল এক তরুণ কাজ করত। সে যা করত মনোযোগ দিয়ে করত। কাজে ফাঁকি দিত না, ঠকাত না কাউকে। তবে এই সততার মধ্যে থেকে কী করে সে ধনী হবে, এটাই ছিল তার একমাত্র চিন্তা। সবাই জানত, কাজ সে করে ইট-বালু-সিমেন্ট নিয়ে। কিন্তু শুধু সে নিজে জানত তার আসল কাজ অন্য। সেখানেও তার প্রবল মনোযোগ। তার কাজ ছিল স্বপ্ন দেখা।

কিন্তু স্বপ্ন কি প্রত্যেকেই দেখে না?

তবে গুল্লুর ব্যাপারটা আলাদা। কারও কাছে জানতে চাইলে আগের রাতে দেখা স্বপ্ন হয়তো ঠিকঠাক মনেও করতে পারবে না। গুল্লু পারত। ধারাবাহিকভাবে স্বপ্নের প্রতিটি দৃশ্য মনে করতে পারত। বিষয়টা সেখানে শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু আসল ঘটনা সেটা ছিল না। মানুষ জানত, স্বপ্ন স্বপ্নই, গুল্লু যা মানতে চাইত না। সে বিশ্বাস করত, স্বপ্ন সত্য, স্বপ্ন বাস্তব। তাই যখনই সে কোনো স্বপ্ন দেখত, সেই মতো কাজকর্ম করতে শুরু করত। যেমন গুল্লু স্বপ্ন দেখল উঁচু এক ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে পড়তে এক পরি তাকে উড়িয়ে নিয়ে মেঘের নরম গদিতে শুইয়ে দিচ্ছে। পরদিন সকালেই সে আকাশছোঁয়া ছাদের মাথায় উঠে দিল লাফ। মাত্র দুটো ছাদ পেরিয়ে কোম্পানির দড়ির জালে আটকে গেল তার শরীরটা। সে যাত্রায় একটা হাত ভাঙার ওপর দিয়ে বিপদ কেটে গেল গুল্লুর। আরেকবার স্বপ্ন দেখল লটারিতে বহু টাকা পেয়েছে; পায়ের ওপর পা তুলে আধশোয়া হয়ে হুক্কা খাচ্ছে। ফলে নিজের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত দিয়ে সে কিনে ফেলল লটারির অনেকগুলো টিকিট। বলা বাহুল্য, পরের অনেকগুলো দিন তাকে আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকতে হলো। লোকে নানাভাবে তাকে বোঝাতে লাগল কিন্তু গুল্লু না ছাড়ল স্বপ্ন দেখা, না ছাড়ল তাকে সত্য ভাবা।

ওদিকে উঁচু ছাদ আর দেয়াল বানানোর কাজে তার আর মন বসছিল না। কারণ জায়গাটায় পানির খুব অভাব। খাওয়ার জন্য মোটে পানি জোগাড় করা যায়—তা-ও বড় কষ্টে। অথচ মাটির নিচে অনেক তেল। কোম্পানির লোকেরা মাটি খুঁড়ে তেল উঠিয়ে তাতে সিমেন্ট-বালু মিশিয়ে দেয়াল তুলছিল। গুল্লুর পক্ষে এই অসততা মেনে নেওয়া অসম্ভব। কাজটা ছেড়ে চলে যাবে যাবে, এমন সময় গুল্লু ঠিক যা জানতে চায়, সেটাই জেনে গেল এক রাতের স্বপ্ন-মারফতে। দেখল বহুদূরে আছে এক অতি উঁচু জায়গা, যেখানে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াতে পারলেই সে ধনী হবে। সেখানে যেতে হবে সূর্যের সঙ্গে টক্কর দিয়ে। মানে, সূর্য উঠতে না উঠতেই রওনা আর বিশ্রাম কেবল সূর্য ডুবলে। এভাবে ১১ দিন চলতে থাকলে গুল্লু সেই জায়গার সন্ধান পাবে। তারপর উঁচুতে চড়তে পারলেই হলো, ধনীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলবে গুল্লু।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে বেরিয়ে পড়ার জন্য গোছগাছ করে নিল। মালিককে চলে যাওয়ার কথা জানাতেই আপত্তি তুললেন তিনি, ‘কাজ ছেড়ে যাবে কেন, আমরা কি উঁচু ছাদ কম বানিয়েছি? উঠে গিয়ে দাঁড়াও না।’

কিন্তু গুল্লু জানত ওখানে থাকলে তার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। আটকে রাখতে পারবে না জেনে মালিক তাকে কাগজে পেঁচিয়ে একটা ইট দিয়ে বলল, ‘যাবেই যখন ঠিক করেছ, যাও। তার আগে এই নাও তোমার বহুদিনের পাওনা বেতনের অংশ, যা আমার কাছে জমা ছিল।’ হাতে নিতে গিয়ে গুল্লু দেখল ইটটা সাধারণ ইটের চেয়ে অনেক বেশি ভারী। সঙ্গে নিয়ে নিরুদ্দেশের উদ্দেশে যাত্রা করার পক্ষে বেশ ঝামেলার। কিন্তু কী আর করবে, মালিক আগ্রহ করে দিলে মানা করা যায় না। গামছা বিছিয়ে সে কাগজে মোড়ানো ইটটা পেঁচিয়ে নিল। তারপর ঘাড়ে ঝুলিয়ে রওনা দিল।

শুরু হলো গুল্লুর সফর। সূর্য যতক্ষণ আলো ছড়ায়, গুল্লু পা থামায় না। অন্ধকার ঘন হলেই নিজের জন্য কোনো রকম একটু জায়গা করে নিয়ে শুয়ে পড়ে। অপরিচিত পথে তিন দিন ধরে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে গেল গুল্লু। সঙ্গে আনা পানি আর সামান্য খাবারও গেল ফুরিয়ে। ওদিকে ঝুলিয়ে রাখা ভারী ইটের ওজনে ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত ব্যথায় টনটন করতে লাগল। সেদিন সন্ধ্যায় গুল্লু বাতাসে পানির কণার গন্ধ পেল। পানির উৎসের খোঁজে দ্রুত চালাতে লাগল পা। শেষে সূর্য যখন দিগন্ত থেকে পিছলে নিচে পড়ে গেল, তার পা পড়ল ভেজা পলিমাটিতে। সামনেই নদী বুঝতে পেরে সে দ্বিগুণ উৎসাহে ছুটল। তারপর নদী থেকে মন ভরে পানি খেয়ে ঘাড়ে ঝোলানো ইটটাকে বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নদীর ধারে। ভোরের আবছা আলো ফুটতেই গুল্লু দেখল নদীর উল্টো দিকে ছবির মতো সাজানো একটা গ্রাম। কিন্তু সে ওদিকে যাবে কী করে? ঘাড়ে ইট বেঁধে সাঁতরে এত বড় নদী পার হতে গেলে মাঝ নদীতে নির্ঘাত মারা পড়বে। এদিকে সূর্যও তো বসে থাকবে না, গুল্লুকে তার আগে এগোতে হবে। নিরুপায় গুল্লু গালে হাত দিয়ে উল্টো দিকের লোকালয়ের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকল। পার না হতে পারলে তীর ধরে এগোবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। নদীর এক মাথায় পর্বত আরেক মাথায় সমুদ্র, তার কোন দিকে যাওয়া উচিত—এ নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল।

এই সমস্ত ভাবনার মাঝখানে সেখানে উপস্থিত হলো সরু নৌকা বাইতে থাকা এক মনমরা মাঝি। গুল্লু কিছু বলার আগেই মাঝি বলল, ‘ওপারে যাবে বুঝি? উঠে এসো।’ আর সময় নষ্ট না করে উঠে পড়ল গুল্লু। তবে ভাবল, এর বিনিময়ে মাঝিকে দেওয়ার মতো কিছুই যে নেই তার কাছে! মাঝি নিজের মনে বলে উঠল, ‘এপার থেকে যা পারি নিয়ে বেচে আসি দূরের এক বাজারে গিয়ে। এখন বাড়ি যাচ্ছি...তবে আজও হলো না।’

‘কী হলো না?’ গুল্লু আগ্রহ দেখাল।

‘একটা ইট কেনার পয়সা। পলিমাটিতে ইট হয় না। তাই এখানে ইটের খুব দাম।’

‘মাত্র একটা ইট দিয়ে কী হবে?’ প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই করল গুল্লু, কিন্তু মনে মনে উত্তেজনা চেপে রাখতে কষ্ট হলো তার। মাঝির উপকারের উপযুক্ত প্রতিদান তার কাছে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ঘাড়ের ওপর ইয়া ওজনদার জিনিসটা ঝুলিয়ে হাঁটার হাত থেকে নিস্তার পাবে সে।

‘একটাই মাত্র মা-মরা মেয়ে আমার, বড় আদরের। সে যা চায় আমি না দিয়ে পারি না। গ্রামে তো সব মাটির ঘর, কিন্তু সে শখ করেছে ইটের ঘরে থাকবে। অনেক কষ্টে ছোট্ট একটা ইটের ঘর তুলেছি। ঘরটা আবার হয়েছে একটু বাঁকা। সে যা হোক, একটা মাত্র ইটের অভাবে সেটা শেষ করতে পারছি না,’ বিষণ্ণ গলায় বলল মাঝি।

‘আমি তোমাকে দেব একটা ইট। আর ঘর বানানোর কাজও আমি জানি, বাঁকা ঘরটা ঠিক করে দেব।’

‘এত কিছু তুমি কেন করবে?’

‘বাহ, এই যে নদী পার করে দিচ্ছ—আমার যাওয়া খুব জরুরি।’

মাঝি কী বুঝল কে জানে। মাথা নাড়ল কয়েকবার।

নদীর তীর থেকে মাঝির বাড়ি যেতে প্রায় দুপুর। গুল্লুর হাতে সময় কম। প্রথমেই সে মাঝির ইটের ঘরটা মেরামত করে সোজা করে দিল। তারপর গামছার প্যাঁচ খুলে ইটটা তুলে দিল মাঝির হাতে। কাগজের মোড়ক ছিঁড়তেই মাঝির চোখ ছানাবড়া। মাথার ওপরের সূর্যের আলোয় চকচক করে ঝলসাতে লাগল রুপার ইটটা। গুল্লুও কম অবাক হলো না। নিজের অজান্তেই সে ধনী ছিল, জেনে মাথা ঘুরে উঠল তার। কিন্তু কী আর করা, ইটটা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা যখন করা হয়ে গেছে, তখন সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। ঘরের জানালার পাশে একটিমাত্র ইটের ফোকরে রুপার ইটটা যত্ন করে বসিয়ে দিল গুল্লু। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মাঝির আদরের মেয়ে চম্পু। গুল্লুর কাজে আর দানে সে মুগ্ধ। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, একে আমি বিয়ে করব।’ মেয়ের কথা ফেলতে না পেরে তাকে বিয়ে করার জন্য গুল্লুকে অনুরোধ করতে লাগল মাঝি। এবার মেয়েটির অপরূপ মুখের দিকে গুল্লু তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের সংকল্পের কথা মনে মনে আওড়ে জানিয়ে দিল যে বিয়েতে রাজি হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ, লক্ষ্যে পৌঁছাতে সামনে তখনো টানা সাত দিনের পথ বাকি। নিরুপায় মাঝি, যে কিনা মেয়েকে কখনো ‘না’ বলতে পারে না, কাঁদো কাঁদো গলায় মেয়েকে সান্ত্বনা দিল, ‘সাতটাই তো দিন, তারপর ওর সঙ্গেই তোমার বিয়ে দেব।’

চম্পু খুশিমনে সাত দিন চলার মতো খাবার বেঁধে দিল গুল্লুকে। আর সেদিন থেকে তাকে বরের বেশে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা শুরু করল। গুল্লু ওদিকে মাঝির বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে ভোর হতে না-হতেই সেই গ্রাম কি আরও বহু গ্রাম পেরিয়ে চলে গেল। ঘাড়ে রুপার ইটের ভার নেই, কোনো পিছুটান নেই, তাকে আর ঠেকায় কে!

টানা সাত দিন উন্মাদের মতো কখনো দৌড়ে কখনো হেঁটে অজানা এক শহরে উপস্থিত হলো সে। মানুষে গিজগিজ করা, শব্দে ভরপুর, আকাশের দিকে তিরের মতো উঠে যাওয়া উঁচু ছাদে ঠাসা জায়গাটা দেখে গুল্লুর গলা শুকিয়ে এল। একটা ছাদ দেখলে মনে হয় ওটার ওপরেই ওঠা দরকার, পরেরটা দেখা যায় তার চেয়ে অন্তত দেড় গুণ উঁচু। সারা দিন কেটে গেলেও ছাদ বাছাই করতে পারল না গুল্লু। শেষে সবচেয়ে উঁচু একটা ছাদের ওপর দেখা গেল আকাশ ফুঁড়ে উঠে যাওয়া একটা টাওয়ার। গুল্লু সেটা বেয়ে এক্কেবারে মাথায় গিয়ে কোনো রকমে টাওয়ারের একটা লোহা ধরে ঝুলে রইল। জনাকীর্ণ শহরটাতে এ রকম অদ্ভুত ঘটনা দেখতে মানুষ জমতে একটুও সময় লাগল না। জমায়েতের মানুষেরা হায় হায় করতে লাগল। ওপর থেকে আড়চোখে গুল্লু দেখল, পিঁপড়ের মতো মানুষের ঢল। দমকলের লোকেরা লম্বা মইয়ের ভাঁজ খুলল, দড়ির জাল বিছাল। কিন্তু তাকে ছোঁয়ার সাধ্য হলো না কারও। তার মধ্যে কোত্থেকে এসে উপস্থিত হলো কিম্ভূত এক দীর্ঘদেহী মানুষ। হাঁটু অবধি দাড়ি আর মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া আলখাল্লা তার গায়ে। ওরকম রহস্যময় পোশাক গুল্লু কোনো দিন দেখেনি। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সে জানতে চাইল, গুল্লু কী চায়। সে তার স্বপ্ন আর ধনী হওয়ার কথা বললে হাসল লোকটা, ‘ওহ, এই কথা!’ সহজ সমাধান দিল সে, বলল, ‘এখানে যত মানুষ জমায়েত হয়েছে প্রত্যেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিলেই গুল্লু ধনী হয়ে যাবে।’ কয়েক পা পেছনে সরে গেল মানুষ। কেন খামোখা একজনকে ধনী করতে সবার ক্ষতি করতে হবে? দীর্ঘদেহী গুল্লুকে বাঁচানোর অন্য পথ খুঁজতে লাগল; বলল, ‘আমিও স্বপ্ন দেখি, বুঝেছ? আর আমারও স্বপ্ন সত্য হয়ে যায়।’

মনের মিল হওয়া প্রথম মানুষকে বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগল গুল্লু। লোকটা বলল, ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি এখান থেকে তিন দিন দক্ষিণে, পরের পাঁচ দিন পূর্বে, পরের দুই দিন আবার দক্ষিণে গেলে এক দ্বীপ, সেই দ্বীপের মাঝখানে এক বটগাছ, সেই গাছের নিচের মাটি খুঁড়লেই দুই মণ সোনা। সেখানেই যাচ্ছিলাম। চাও তো আমার আগে তুমি গিয়ে নিয়ে নিতে পারো।’ এ কথায় দ্বিধায় পড়ল গুল্লু। অন্যের স্বপ্নে অর্জিত অর্থ সে কেন নেবে? সে হেসে ফেলল।

‘এই তথ্য জানার জন্যই হয়তো তোমার স্বপ্ন আজকে তোমাকে টাওয়ারের মাথা পর্যন্ত তুলেছে।’ লোকটির কথা এবার গুল্লুর পছন্দ হলো। তা-ই হবে। ধীরে ধীরে সে নেমে এল টাওয়ার বেয়ে। মানুষজনও দুই স্বপ্ন-পাগলের পাগলামি দেখা থেকে রেহাই পেল।

উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ভেংচি কেটে আলখাল্লা পরিহিত কিম্ভূত মানুষটা বলল, ‘অল্প করে পয়সা দিলে না তো বেচারাকে?...এবারে বুঝবে।’ মানুষেরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তারপর হো হো হাসির প্রতিধ্বনি তুলে দীর্ঘদেহী গুল্লুকে সঙ্গে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। যেতে যেতে গুল্লুকে বলল, ‘কেউ যখন কাউকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তার সম্পদ আমি ছিনিয়ে নিই।’ গুল্লু চমকে উঠে বলল, ‘কীভাবে?’ সে হুট করে রাস্তার পাশের দুটো বস্তা দেখিয়ে বলল, ‘দেখবে আসো।’ বস্তার মুখ খুলতেই দেখা গেল টাকা আর দামি গয়নায় ঠাসা। ‘আমার দরকার পড়ে কেবল একটু ভিড়। ওখানে উপস্থিত সবার সবকিছু নিয়ে নিয়েছি, এতক্ষণে তারা একজন আরেকজনকে চোর ঠাওরে ভয়ানক মারামারি বাধিয়ে ফেলেছে...হা হা হা।’

‘কিন্তু...কী করে?’ হাঁ হয়ে গেল গুল্লুর মুখ।

‘ভেলকি যাকে বলে ইন্দ্রজাল। তুমি বুঝবে না হে ছোকরা।’

গুল্লুর অবশ্য অত শত বোঝার ইচ্ছেও নেই। জাদুকররূপী লোকটাকে বিদায় দিয়ে তার দেওয়া ঠিকানামতো রওনা দিল সে। তিন দিন দক্ষিণে, পাঁচ দিন পূর্বে আবার দুই দিন দক্ষিণে গিয়ে উপস্থিত হলো সেই দ্বীপে। বিস্ফারিত চোখে দেখল দ্বীপের ঠিক মাঝখানে ঝুরি নামা বিশাল বটগাছ ছায়া করে দাঁড়িয়ে আছে। শিকড়ের কাছে খুঁড়তে খুঁড়তে গুল্লু গুনে গুনে দুই মণ সোনা পেয়ে গেল। সে এখন ধনী। লক্ষ্য অর্জনের পর প্রথম তার চোখে ভেসে উঠল মাঝির মেয়ে চম্পুর মুখ। ভাবল নিজেকে গুছিয়ে নিয়েই চম্পুর উদ্দেশে রওনা দেবে।

ওদিকে সাত দিন কেন, আরও অনেক দিন পরেও যখন মাঝি চম্পুর জন্য তার পছন্দমতো বর গুল্লুকে হাজির করতে পারল না, ভীষণ রেগে গেল চম্পু। চম্পু, যে কিনা জীবনে বাবার মুখে ‘না’ শোনেনি, বাবার অপারগতায় রাগ বাড়তেই থাকল তার। রাগের চোটে কোমরছাপানো ওর চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল ওপরের দিকে। আরও রাগলে চুলের আগায় নীলচে বেগুনি আগুনের শিখা দেখা গেল। তারপর দাউ দাউ করে আগুন বেরিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। আগুনে পুড়ে চম্পুর শরীরটা হয়ে গেল ঝামা। আর তারপর আগুন-জ্বলতে থাকা কালো কুচকুচে ঝামার সাপ হয়ে গুল্লুকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল সে।

চম্পু যেদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে গেল, সেদিকেই আগুন লাগল। যত আগুন লাগল, চম্পু সাপের আগুনের তেজ ততই কমতে থাকল। গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পোড়াতে পোড়াতে শরীরের শেষ বিন্দু আগুন নিয়ে সে ঠিকই পৌঁছাল গুল্লুর বাড়িতে। বাড়িতে আগুন লাগলে গুল্লুর সমস্ত সোনার দলা পুড়ে গলে গলে গেল উবে।

ভাগ্যিস, গুল্লু তখন বাড়িতে ছিল না! পোড়া বাড়িটা কদিনেই ঠিকঠাকমতো বানিয়ে সে আবারও শুরু করল স্বপ্ন দেখতে।