পুত্রসরোবর

রানি অশ্রুলেখার মনে সুখ নাই গো সুখ নাই। শ্রাবণ মাসের মেঘ ঘনাইয়া আসিয়া আকাশের রং, যমুনার রং আর সাঁঝের রং এক করিয়া ফেলিয়াছে। মেঘের অন্তরালচ্যুত আলোকে তাঁহার মহলার ছাদে বসিয়া আছেন, হংসমুখী পানের বাটায় তিতপতি পান শুকাইতেছে, স্যাঙাতনী তিতখালি সুপারি জাঁতিতে কাটিতেছে আর মনোহারী তামাকের পাতা চিবাইতেছে। আলতার হাঁ হইয়া থাকা বাটিতে আলতা শুকায়, রানি লতা পাড়িয়া কাজল দিতে ভুলিয়াছেন, কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাঁহার চক্ষু কাজলমলিন হইয়াছে। আহা, রাজপুরীতেও বুঝি সুখ নাই, রাজমহিষীরও বুঝি চক্ষের পানির ঠাঁই নাই। মহলার এই ভাগের ছাদখানার নাম ‘নিরালা-কানন’। পাথরবাঁধাই ছাদে গুটিকয় হাসনচাঁপা আর কামিনী গাছ, স্থলপদ্ম আর গন্ধরাজের কুঞ্জ। এইখানে বিরলে রানির পুতুল খেলিবার সরঞ্জাম, পুতুলের মখমলি জামা সিলাইবার কাপড়, ঘুড়ি উড়াইবার হাতমাঞ্জা, দুই একখানা প্রিয় পুস্তিকা ইত্যাদি ছড়ানো। অনুমতি-বিনা এইখানে কেহ আসে না।

রানি পাশ ফিরিয়া কাতরান, ‘স্যাঙাতনী!’

স্যাঙাতনী শ্বাসের সহিত উড়িয়া যায় এমন সরু করিয়া সুপারি কুচাইতে কুচাইতে বলে, ‘কেমন গো রানি?’

তারপর তাঁহারা যাহা আলাপ করেন, তাহা দাসদাসী জানিতে পায় না, রাজরাজড়ারা অনুমান করিতে পারে না, সয়া-সখীরা কেহ ভাবিতেও পারে না। রাজবংশের কবি কাব্যগীত লিখিয়া গেছেন, ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’...দেহের কথা কে কোথায় বলিবে? কাহার নিকট বলিবে? কাহাকে বলিবে তাহাও আর কেহ বলিয়া দিবে কি? দেহ কি সন্ধ্যাগমের কালসর্প? দেহ কি ঝামরচুলো ডাকিনী? তাহার নাম নিতে নাই? এই তো রানি আর স্যাঙাতনী দেহের গল্পই করেন। আহা, হৃদয়ও কি নাই তাতে? রাজ-অন্তঃপুরে কে কবে ভালোবাসিয়াছে, কে কবে ভালোবাসিয়া বঞ্চিত হইয়াছে, বঞ্চিত হইয়াও ভালোবাসিয়াছে? ইহা নিদারুণ শোধ-বোধের স্থান। শরীর দিবে, শরীর মিলিবে। যৌবন দিবে, যৌবন যাইবে। এই পাষাণপুরীতে রানির গায়ে ভাবকদমের শিউরানি ফুল ফুটিল কি না তাহা কে ঠাহর করিয়া দেখিতে যাইবে? রানি রমণে স্ত্রীজাতের হৃদয়ের ভূমিকা নিয়া বলেন, স্যাঙাতনী শোনে, সহজাত বুদ্ধির জোরে কিছু দোয়ারকি দেয়। স্যাঙাতনী লো, ভয়ে চক্ষু মুদিয়া থাকিয়া যে ধর্ষিত প্রায় হইল, তাহার গর্ভে জন্মাইল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। যে ব্যাসদেবের ভয়াল কান্তি দেখিয়া পাণ্ডুর-মূর্চ্ছিত হইল, তাহার পুত্র হইল পাণ্ডু। দাসী শুধু রানির বেশে আসিয়া ব্যাসদেবের সাথে প্রীতি বিনিময় করিল, সুখে সঙ্গম করিল, তবেই জন্মিল বিদূরের ন্যায় সুসন্তান। স্ত্রীলোকের হৃদয় আর দেহ সমবেত সংগীতে বাজিলেই তবে জন্মে মহাপুরুষ। এই তো অমৃতসমান মহাভারতের কথা। কেই বা শোনে!

স্ত্রীকুল, তাহার দেহ, তাহার হৃদয়! আহা, রানির হৃদয় কে যেন তিলঘষা জাঁতায় ফেলিয়া ঘুরাইল, রানি দীর্ঘশ্বাস গোপন করিলেন! ভাবিয়া দ্যাখ লো স্যাঙাতনী, উতত্থ ঋষির পুত্র ভ্রূণদশায় পা দিয়া মায়ের শরীরে অমোঘ বীর্য ঋষির উপগমন ঠেকাইল—কিনা গর্ভে দুই শিশুর স্থান সংকুলান হইবে না, রেতঃ মাটিতে পড়িল, লাভের ভিতর এই, উতত্থনন্দন ঋষির অভিশাপে জন্মিল জন্মান্ধ হইয়া। কোন ঋষি এমন নিঠুর, না বৃহস্পতি! যাঁর স্ত্রী সর্বকালের পূজনীয়া সতী। (স্যাঙাতনী এই সকলের কিছু বোঝে, কিছু কিছুতে না বুঝিয়া মাথা দোলায়।)

রানির বুকে প্রদীপ্ত অঙ্গারে ঘি আহুতি দিল কে, তিনি আবার শুরু করিলেন...সেই যে জন্মান্ধ ঋষি দীর্ঘতমা জন্মাইলেন, ঋষিরও শয্যায় চাহিদা কত! ক্ষেত্রজ পুত্র দিতে আসিয়াও মধু-গুড় ইত্যাদি রানি সুদেষ্ণার দেহ হইতে লেহন করিবেন! বিপ্রেরকী লক্ষণ, আহা, আপনার স্ত্রীর ভরণপোষণ করিতে পারে না, গর্বিত বাক্যও সহিতে পারে না (স্ত্রীলোক কী কারণে পুরুষের ন্যায় বাক্য বলিবে), সহিতে না পারিয়া মচমচাইয়া অভিশাপ দেয়—অদ্য হইতে পত্নী যাবজ্জীবন পতির অধীন, পতি মৃত হইলেও পুরুষান্তরে গমন করিতে পারিবে না! সেই এক কাল গিয়াছে, স্ত্রীজাতের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল–দুষ্ট ঋষিকে আপন পুত্রের দলই জলে নিক্ষেপ করিয়াছিল।

রাজমহিষী দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। স্ত্রীজাতের সম্মান করিতে জানে না, এমন ঋষি-রাজর্ষি-রাজপুরুষ কেহই আর জলে নিক্ষিপ্ত হন না। জলে যায় যৌবন, অতুল বৈভবশীলা, নটিনী যৌবন। রাজার শরীর যতকাল যৌবনরশ্মিতে দেদীপ্যমান ছিল, ততকাল তিনি অন্দরে খাইতে আসিতেন মাত্র (হংস্-শূল্য আর খাসির তেলের বড়া খাইতে চাহিলে রানি কিরণলেখার মহলে। রুই মাছের টিকলি আর শোল-পোড়া খাইতে চাহিলে রানি বিদ্যুৎলেখার মহলে। করিলা পাতার তিতচড়চড়ী আর শেফালি পাতার শুক্তা খাইতে চাহিলে রানি অশ্রুলেখার মহলে), অবিদ্যা-ভিন্ন অক্লান্ত রাজশরীরের ভাগ রানিদের জোটে নাই। যখন পুত্রার্থে বংশ রক্ষার্থে তিনি রাজ-অন্তঃপুরে ফিরিলেন, তখন রাজার কামপরায়ণ শরীর শিথিল হইয়াছে, পাহাড় হইতে ভাইট্যাল নদী কবে সমুদ্রে গিয়া আত্মবিসর্জন দিয়াছে, মদনবেগ একদা সম্বরণ করিতে পারিতেন না সে-কথা আপনারই বিশ্বাস হয় না। এই সিদ্ধ আনাজি কলার ন্যায় শ্লথ দেহভার বহিবার কথা শ্মশান বন্ধুদের, বহিতেছেন রানি অশ্রুলেখা। রাজভীষক রাজাকে ইন্দ্রিয় শৈথিল্যের মহৌষধ অশ্বগন্ধা-আলকুশির বীজ-গাওয়া ঘি-মিছরি ইত্যাদি চড়াইয়ের ডিম সহযোগে সেবন করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন শোনা যায়, রাজা শুনিয়াছেন এমন লক্ষণ দেখা যায় নাই, রাজার পুরুষকারের আকার অশ্বলিঙ্গ অপেক্ষা বৃহৎ। রতিলিপ্সা রানি কদাচ অনুভব করিতে পাইলেন না, রানির অনবধানে সখীরা তাঁহার দেহে বৃথাই নখরাঘাত খুঁজিলেন, সোনার কুলুপ মুখে আঁটিয়া রানি রাজার সহিত তীর্থে তীর্থে স্নান করিলেন, দান করিলেন। রৌদ্রে-জ্যোৎস্নায়-অনলে-অনিলে প্রাণের ঐশ্বর্য নীরবে আহুতি দিয়া রানি হাসিলেন, কুলবৈদ্যের কাছে ঋষির কাছে হাতজোড় করিলেন—তিন রানিতে মিলিয়া সন্ন্যাসী দত্ত গাছের মূল দুধে বাটিয়া খাইলেন—পুত্রসরোবরে স্নান করিলেন—রাজার ভোগে সপ্তব্যঞ্জন বংশ-পাখির মাংস রাঁধিলেন। কিছুতেই সন্তান জন্মিল না। রাজার নাম হইল আঁটকুড়ে, রাজদর্শন মানে অনামুখোকে দেখিয়া দিবসের কার্য শুরু করা...প্রজা অসন্তোষ বাড়িয়া চলিল।

একদিন রানি অশ্রুলেখার অশ্রু শুকাইল। তখন চৈত্র মাস। নিরালা-কাননে ফুলের ঝাড়, ফুলের কাতার। ফিঙে-কোকিল হাওয়া কাটিতেছে। দিবসে ফুল থলো-থলো, রাতে জ্যোৎস্না খলখল। রাজজ্যোতিষী আসিয়া গণনা করিতে বসিয়াছে, বয়সে নবীন যুবা পুরুষ, চক্ষুকোণ দুটি রুদ্রাক্ষের মতন লাল, পোখরাজের মতন গায়ের রং। দাসীরা চুমুক দিয়া খাইবার বিলাতি আমড়ার উপাদেয় অম্বল দিয়া গিয়াছে, গরমকালে শরীর স্নিগ্ধ রাখিবে। রানিকে ক্ষেমাদাসী পরিপাটি করিয়া বসন্তসাজে সাজাইয়া গিয়াছে, সিঁথিপাটিতে ফুল, বাজুতে অতসী ফুল, কবরীতে কচি পাতাবাহার চিরুনি, কানে দোলার চাঁপাকুঁড়ি। আমসী-ত্রিফলা ইত্যাদি শুকাইবার কাজ দিয়া রানি স্যাঙাতনীকে অন্যত্র পাঠাইলেন।

সাঁঝের পিদিম জ্বলিল, সাঁঝের ডঙ্কা বাজিল। স্যাঙাতনী আসিয়া দেখিল রানির মুখ মুচকুন্দ ফুলের পাপড়ির ন্যায় আলো—ফুটফুট, রানির বুক সমুদ্রের ডাকে হুম-হুম, গুম-গুম। কবরী উতলা, বসন্তসাজ দলিত, স্যাঙাতনী শুধাইল, ‘রানি, ভাগ্য কেমন বুঝিলে?’

রানি কহিলেন, ‘ভাগ্য বহুদূর। জ্যোতিষ বলিয়াছে, হাতির দাঁত ভাবকদমের পাত, শোলক না ভাঙিলে জন্মিবে গাধার জাত।’

স্যাঙাতনী শুধাইল, ‘তবে?’

রানির মুখ ধলসমুদ্রের শ্বেতকমলের মতন ফুটিফুটি, তিনি বলিলেন, ‘জ্যোতিষকে কাল আবার ডাক পাঠাইও। ভাগ্য গনিব।’

জ্যোতিষী তবে আবার আসিলেন। আবার রাত ঘনাইল। কার ঘরে কে নিশি জাগে? কার সোনার শিঙায় পড়ে ফুঁক? রানির মুখে ধলসমুদ্রের দুধজল ছায়া ফেলে। রানির বুকে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ নদীতটের শিলা মসৃণ হইয়া আসে। রাজপুরীর বাহিরে বাগানের শেষে শৃগাল আসিয়া প্রহর ঘোষণা করিয়া যায়।

বৈশাখ আসিলে রাজা একদিন একখানা আধপাকা আম হাতে করিয়া রানি অশ্রুলেখার মহলায় আসিলেন, বলিলেন, সন্ন্যাসী আসিয়া তাঁহাকে বলিয়া গিয়াছেন—তিন রানিকে সুবর্ণ তুলসীর পাতা সিঁথিতে রাখিয়া তিন অমাবস্যা নিদ্রা যাইতে, উঠিয়া ঋতুস্নান শেষে ত্রিফলার সহিত এই আম্রফল বাটিয়া খাইতে, তাহার পরে ধলসমুদ্রসঙ্গমে তীর্থদর্শনে গিয়া হাজার ব্রাহ্মণ খাওয়াইয়া ফিরিতে, ফিরিয়া লোহাকাঠের ঘরে দশ বৎসর থাকিবে—চাঁদ–সুরয দেখিবে না, তবে সন্তান হ’বে।

রানি কিছু বলিতে উসখুস করিলেন, কিন্তু বলিলেন না। শুধু বলিলেন, ‘চন্দ্রসূর্য না দেখিয়া আমি দশ বৎসর থাকিতে পারিব না। আকাশ বাতাস ফাল্গুন মাস শিমুল ফুল না দেখিয়া থাকিতে পারিব না।’ রাজা ভাবিলেন, আম ফর্মালিনমুক্ত এই প্রবোধ দেওয়া প্রয়োজন। রানিকে তাহা বলিতেই রানি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া বলিলেন, ‘তিন ভাগ করিয়া আম খাইব তিন সতীনে, তাহার পরে পুত্র হইবে তিন টুকরা, কে তাহাকে জোড়া দিবে? জরাসন্ধের কাল কবে কাটিয়া গিয়াছে!’

রাজা ক্ষিপ্ত হইয়া বলিলেন, ‘স্ত্রীলোকের এত ভাবিয়া কাজ কি? জরাসন্ধকে জোড়া দিবার লোক ছিল, আমাদেরও জুটিয়া যাইবে!’

রানি ভাবিলেন বলিবেন, সুস্থ স্বামীর সহিত শিব-পার্বতীর ন্যায় মিলিত হইয়া সুসন্তান জন্ম দিব এই আমার ইচ্ছা...বলিতে রানির বুক ফাটিয়া গেল, মুখের সোনার কুলুপ ঘুচিল না। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আম খাইবে কি না?’

রানি সবেগে সতেজে জবাব করিলেন, ‘তুমি আঁটকুড়ে, তোমার চিকিৎসা কোনো বৈদ্য কেন করিল না? তুমি অনামুখো, তাই আমরা বন্ধ্যা স্ত্রীলোক। তুমি অজাতপুত্র, তাই আমরা বংশরক্ষায় অক্ষম। কেন গাছের মূল, আম্রফল, সুবর্ণতুলসী ইত্যাদি বাটিয়া তুমি খাইবে না অথচ আমরা খাইব? কেন তোমাকে বুক চিরিয়া তীর্থে তীর্থে সোপানে সোপানে রক্ত দিতে হইবে না অথচ আমরা দিব? কেন শুভ কাজে তোমার উপস্থিতি চলিবে অথচ আমাদের চলিবে না?’

রাজা একটায় পঁচিশটা হইয়া চিৎকার করিলেন, ‘চোপরাও! অতলকূপে জিয়ন্ত পুঁতিয়া ফেলিব যদি পুরুষের ন্যায় বাক্য ব্যবহার করো!’

রানি ঠিকই বলিয়াছিলেন, দীর্ঘতমা ঋষির কাল গিয়াছে, স্ত্রীলোকের অসম্মানে কেহ আর কাহাকেও জলে নিক্ষেপ করে না। রাজা আম্রফল সোনার থালায় রাখিয়া গটগট মটমট করিয়া চলিয়া গেলেন।

রানিরা সলা করিয়া দুধ-সন্দেশ মাখিয়া আম খাইলেন, রানি অশ্রুলেখা আম খাইবার ভান করিলেন। অন্তঃসত্ত্বা নারী ঋতুস্নান করিবে কী করিয়া…পুত্রার্থে কোনো আচার আর তাঁহার না পালন করিলেও হইবে। পাঁচ ঠাকুরের থানে হত্যে না দিলেও চলিবে, ষষ্ঠীপূজা না করিলেও হইবে। অন্ধের নড়ি, যখের ধন, নাড়ির রতন তো গর্ভে আসিয়াছে। রানিরা শিলনোড়া ধুইয়া জলসুদ্ধ খাইতেছেন, তাহা অপাঙ্গে দেখিয়া রানি অশ্রুলেখা হাসিলেন। হাসিতে হাসিতে তাঁহার হাসি শুকাইয়া আসিল। রানি স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন, বানরের ছাল পরিয়া তাঁহার সন্তান জন্মিবে, পেঁচার পাখ নিয়া তাঁহার সন্তান জন্মিবে, পারুল ফুল হইয়া পাশকুঁড়ে তাঁহার সন্তান জন্মিবে। তাঁহার সন্তান জন্মিবে অথচ বাকি রানিদের জন্মিবে না, রাজা এই রহস্য ভেদ করিতে পারিবেন না? ভয়ে রানির নাড়ি শুকাইয়া যাইতে লাগিল। গর্ভের শিশু পাশ মুড়িয়া শুইল। কে তাঁহার নাম রাখিয়াছিল অশ্রুলেখা!

স্যাঙাতনী রানির দশা দেখিল। নিরালা-কাননে আর রানি কাহাকেও ডাকেন না। কুঞ্জে কেহ জলসেচ দেয় না। লতাপাতা সকলি জলাভাবে মরিতেছে। জীর্ণ লতাবিতানের কঙ্কাল ভেদ করিয়া জোড়শালিকের বাসা দেখা যাইতেছে। রানির ছাদের বাঁধানো শানে আর পাখি আসিয়া পঞ্চশস্য ঠুকরাইয়া খায় না। কোথাও কোনো শ্রী নাই। সে একদিন আলতার বাটিতে আলতা গুলাইয়া, ঝামা হাতে কাছে আসিয়া বসিল। সমবেদনা পাইয়া রানির চক্ষে জল আসিল। গোপন হইতে গোপন যে কথা, তাহা বলিবার জন্য রানির প্রাণ ওষ্ঠাগত হইল।

স্যাঙাতনী বলিল, ‘এই কথা? তবে শোনো। কাঠকুড়ানি বুড়ির মেয়ে সুখু। হেঁপোরোগী স্বামী লইয়া ঘর করে, সন্তান নাই, উঠানে বাতি নাই। আজ মরিলে কাল বাস্তুসাপ আসিয়া সকলি দখল করিবে। দুখু রাখাল মাঠে গোরু চরাইতে আসিত, তিনখানা গাই। ধবলা, কাজলা আর কপিলা।’

রানি অস্থির হইয়া বলিলেন, ‘আমি মরিতেছি বিষের জ্বালায়, তুই আসিয়াছিস তিন গাইয়ের কথা শুনাইতে!’

স্যাঙাতনী হাসিয়া বলিল, ‘আহা রানি শোনই না গো, সংসারে সুখদুঃখ মিলিয়া মিশিয়া থাকে, দুখু আর সুখুও একসময় মিলিয়া মিশিয়া গেল। সুখুর পেটে ছেলে আসিল। এখন স্বামীকে সুখু কী বলিবে? সপ্তাহ ফুরাইলে যখন বন্ধ্যা-সুখুকে তাহার স্বামী চিকিৎসাকেন্দ্রে লইয়া যাইবে, টীকা-আপাকে সে কী বলিবে? সুখু খুব ভাবিল। তাহার পর অঘ্রাণ মাসে বিলে সাঁতরাইতে গিয়া কেঠো শিকার করিয়া আনিল, কেঠোর মেটের কালিয়া রাঁধিল। চালিতা পাড়িয়া অম্বল রাঁধিল। ক্ষার খৈল দিয়া নাইয়া সপসপে করিয়া মাথায় তেল দিয়া কবরী বাঁধিয়া আঁট করিয়া ডুরে শাড়িখানা পরিয়া স্বামীর অপেক্ষায় থাকিল। স্বামী আসিয়া পেট পুরিয়া মোটা চাউলের ভাত খাইল। কালিয়া খাইল। অম্বল খাইল। খাইয়া দাইয়াতুষ্ট হইয়া আড়কোলা করিয়া সুখুকে শয্যায় লইয়া গেল।

‘সপ্তাহ কাটিলে হেঁপো স্বামীকে অর্জুনফলের শুখা টুকরা কলকেতে দিয়া তামাক সাজিয়া দিয়া সুখু বলিল, “শোনো গো, সেই যে কেঠো আনিয়া কালিয়া রাঁধিয়াছিলাম, ডুব দিতে গিয়া মাছের ডিম পেটে ঢুকিয়া গিয়াছে। এখন তুমি ছেলের মুখ দেখিবে।”’

রানির হতভম্ব মুখের কাছে হাত নাচাইয়া স্যাঙাতনী বলিল, ‘রানি তুমি সুখভোগ করিতে চাহিয়াছিলে। রাজাও সন্তানের মুখ দেখিতে চাহিয়াছেন। এখন কোল আলো করিয়া ছেলে আসিবে। চাঁদের আঙিনা হইতে চুরি করা অমৃতফল আসিবে। তোমার দুর্বলতাহেতু তুমি মুখ ফুটিয়া যাহা ইচ্ছা বলিবে। রাজার দুর্বলতাহেতু তিনিও চুপ করিয়া থাকিবেন। দেখিও।’

রানি আনমনে আঁচলে আঙুল জড়াইতে জড়াইতে ভাবিলেন, কুন্তীবীরমাতা হইবেন, পাণ্ডুর বংশ রক্ষা হইবে, কুন্তী সর্বজনপূজ্যতে সতীও থাকিবেন। মহাভারতের অমৃতলহরী অক্ষুণ্ন থাকিবে, কান ভরিয়া সাধু শুনিবে। হয়তো সান্ত্বনা পাইলেন। স্ত্রীলোকের প্রেমের উদ্বোধন হইতে এখনো বহুকাল বাকি আছে।