এক ছিল যে রাজ-পুত্র

শিফট শেষ হওয়ার কথা সন্ধ্যা ছয়টায়—সে রকমই আনিসাকে বলা হয়েছিল আশুলিয়ায় ওয়েলনেস ফার্মাসিউটিক্যালসের ফ্যাক্টরিতে চাকরি নিয়ে ঢোকার সময়, তিন বছর আগে। ম্যানেজার ওয়াহিদ স্যার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কাজ শেষে আধা ঘণ্টা হাঁটার দূরত্বে তার বাসায় সে ঠিক সাড়ে ছয়টায় পৌঁছে যেতে পারবে; যে বাসার ব্যবস্থা তিনিই করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আশ্বাসটা যে আনিসার বেতনের মতোই মূল্যহীন, সেটি বুঝতে এক মাসও সময় লাগেনি। এখন তার বাসায় ফিরতে সাড়ে সাতটা বাজে।

বাসা মানে তিন বছর আগের সেই ছাপরা। ঘরটার অবস্থা আগের থেকে খারাপ হয়েছে, কিন্তু ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ভাড়ার অত্যাচারে তার পুরোনো দুই রুমমেট অন্যখানে ঘর খুঁজে নিয়েছে। নতুন দুই মেয়ে এসেছে, যার একজন বর্ণা ভাব জমিয়েছে ওয়ার্ড কমিশনারের ভাতিজা ইছুপের সঙ্গে। ইছুপ তাকে দিয়েছে একটা ১৯ ইঞ্চি ওয়ালটন টিভি, সঙ্গে ডিশ কানেকশন। বর্ণার কাজ হচ্ছে সন্ধ্যা থেকে টিভির সামনে বসে হিন্দি-বাংলা সিরিয়াল দেখা। এ জন্য বাসায় ফিরে যে শান্তি পাবে, আনিসার সে উপায় নেই। বর্ণা আবার আনিসার হাতে-পায়ে ধরে তার ভাগের রান্নাটা করে দিতে রাজি করিয়েছে। ফলে তাকে সপ্তাহে চার দিন রাঁধতে হয়। আনিসা নীরবে এই আলগা দায়িত্বটা মেনে নিয়েছে। যতই সে রেগে থাকুক ভেতরে-ভেতরে, বাইরে তার প্রকাশ কখনো সে দেখতে পারে না। ছোটবেলা থেকে সে মানুষের বকা খেয়েছে, গাল খেয়েছে, মারও খেয়েছে—এত সব খাওয়ার পর নানা অপমান আর লাঞ্ছনাও হজম করেছে। কিন্তু কোনো দিন কারও চোখের দিকে তাকিয়ে একটা কথাও বলতে পারেনি।

আনিসাকে ওয়েলনেসে কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন তার এক মামাতো ভাই—কাজী ভাই, বাস্তবে যিনি ছিলেন এই জগতে তার একমাত্র আশ্রয়।

তাঁর সম্পর্কে অতীতকাল ব্যবহারের কারণ, তিনি গত হয়েছেন। কাজী ভাই চিরনিদ্রায় শান্তিতে থাকুন, এই গল্পে তাঁর প্রয়োজন সামান্যই।

প্রয়োজন আছে বরং ওয়াহিদ স্যারের—কাজী ভাইয়ের চাকরিজীবনের প্রথম বস। তিনি আনিসার দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং পরম নিষ্ঠায় তা করে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর সহকারী সোহেলকে বলেছিলেন, মেয়েটার একটা ইন্টারভিউ নিয়ে, তাকে যোগ্য মনে হলে কোনো একটা সেকশনে যেন ঢুকিয়ে দেন। সোহেলের কাছে আনিসাকে যোগ্য মনে হয়েছিল; তিনি তাকে ট্যাবলেট সেকশনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

যোগ্য প্রমাণিত হওয়ার পথে সোহেলের কিছু প্রশ্নের উত্তর আনিসা দিয়েছিল, যেগুলোর একটা সারাংশ করলে এ রকম দাঁড়ায়:

: স্যার, আমার মা মরে গেলে বাবা আবার বিয়ে করেন। আমার বয়স ছিল পাঁচ।

: না স্যার, স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাড়িতে পড়েছি, যত দিন দাদু বেঁচে ছিলেন। তারপর কাজী ভাই কিছু যে বই কিনে দিতেন, সেগুলো পড়েছি।

: দাদু মারা গিয়েছিলেন দমকলের গাড়ির নিচে পড়ে। লোকে বলে বড় রাস্তায় গিয়ে তিনি দমকলের গাড়ি দেখে তার নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এর আগের দশ দিনে নতুন মা তাকে দুই দিন শুধু ভাত খেতে দিয়েছিলেন।

: স্যার, দমকল কোথায় যাচ্ছিল আমি জানি না।

: না স্যার, আমার বয়স এখন উনিশ। না স্যার, বিয়ে করব না স্যার, চাকরিও ছাড়ব না। চাকরি ছাড়লে খাব কী?

: এক ভাই আছে স্যার। সে কাতারে থাকে। আমাকে ভুলে গেছে। একটা বোন ছিল, বাচ্চা হতে গিয়ে মরে গেল।

: সত্যি বলছি স্যার, দুলাভাই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তার ভয়েই আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি। কাজী ভাই আমাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন।

: স্যার, কাজী ভাইকে আমি বাবার মতো দেখি।

: না স্যার, কাজী ভাইয়ের কথা আর বলব না।

: স্যার? এ কথার মানে কী স্যার?

: না স্যার, কেউ কোনো দিন আমার হাত ধরেনি, আমার গায়ের কোথাও...

: এসব কী বলেন স্যার? জি না স্যার। স্লামালেকুম স্যার।

চাকরি শুরু করার সাত দিনের মাথায় ওয়াহিদ স্যার আনিসাকে নিজের প্যাকেজিং সেকশনে নিয়ে যান। মানুষটাকে অদ্ভুত লাগে আনিসার। লম্বা-চওড়া চেহারা, মাথায় আর্মি ছাঁট চুল। দেখলে মনে হবে এক ফোঁটা দয়ামায়া নেই শরীরে। অথচ সেকশনের প্রত্যেক ছেলেমেয়ের মাথার ওপর ছাতা হয়ে আছেন। আনিসাকে তিনি বলেছিলেন, ডানে বামে তাকাবে না। খালি কাজ করে যাবে। কেউ আলাপ জমাতে এলে ফুটে যেতে বলবে। ব্যস।

আনিসার সঙ্গে আলাপ জমাতে অনেক লোকেরই ইচ্ছা হতো। তাদের ইচ্ছাটা বেশি দূর এগোত না। কারণ ওয়াহিদ স্যার।

আজ দুপুরে খাওয়ার সময় তিনি আনিসাকে ডেকে বলেছেন, প্যাকেজিং সেকশনে মানুষ কমানো হচ্ছে, নতুন যন্ত্র এসেছে। অন্য সেকশনগুলোতেও অল্পস্বল্প হবে।

আনিসা চুপ করে শুনল। সে বুঝল। আর কত দিন স্যার? সে জিজ্ঞেস করল।

তিন মাস। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলেন ওয়াহিদ সাহেব। তারপর পা চালিয়ে চলে গেলেন। আনিসার মনে হলো, তার চোখে সে যেন বাষ্প দেখল।

ওয়াহিদ স্যার চলে যাওয়ার পর তার খেয়াল হলো, আসল কথাটাই তাঁকে বলা হয়নি। সে খুব হতাশ হলো। বেশ কিছুদিন থেকে কথাটা তার ভেতরে তৈরি হচ্ছে, বেড়ে উঠছে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো অবস্থায় এসে গেছে এবং তাকে বলছে, এখনই ওয়াহিদ স্যারকে বলো, না বললে...

আসল কথাটা এই: বর্ণাকে টিভি কিনে দেওয়া ইছুপ সপ্তাহ দুয়েক ধরে আনিসার পেছনে লেগেছে। এক শুক্রবার দুপুরে সে হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল তাদের ঘরে, আশুলিয়া বাজার থেকে বর্ণার জন্য গার্নিয়ের শ্যাম্পু আর আদিত্য ময়রার স্পেশাল জিলাপি নিয়ে। ঘরে বর্ণা ছিল না, আনিসা ছিল। সে গোসল সেরে একটা গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ছিল। তার বুকের ওপর ওড়না ছিল না।

ইছুপ আনিসাকে দেখে শিস দিয়ে উঠেছিল। শিসটা শুনে তার মনে হয়েছিল, গাটা আবার ধুতে হবে।

সে একটা লাফ দিয়ে ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিয়েছিল। রান্নাঘরে আনিসা মাটিতে চাটাই পেতে ভাত খাচ্ছিল।

ইছুপ সেখানেও হানা দিয়েছিল।

দুই

এরপর থেকে আনিসার সকাল-সন্ধ্যার শান্তি গেল। রাতগুলোতেও জমতে শুরু করল হাড় ছুঁয়ে যাওয়া শীত শীত অস্বস্তি।

শুরুতে বর্ণার সঙ্গে দু-তিন দিন টিভি দেখে আনিসার ধারণা হলো, টিভির জগৎটা অবাস্তব এবং হিন্দি সিনেমার জগৎটা রূপকথার চেয়েও বেশি বানোয়াট। তাই সে ঘরের পেছনের ঘাসবালির বুকপকেট সমান একটুখানি উঠানে একটা মোড়া পেতে বসে আকাশটা দেখত। অল্পখানি আকাশ, তাতে জমে থাকত ধুলা, ধোঁয়া আর অস্পষ্টতা। কিন্তু এই অস্পষ্টতার ভেতর দিয়েও সে দেখত আকাশটা ক্রমে বড় হচ্ছে, বাড়ছে, ঢেকে দিচ্ছে আশুলিয়া-বিরানপুরের ভঙ্গুর ভূগোল; এবং সেখান থেকে নেমে আসছে একটা ডানাওয়ালা ঘোড়া।

তার মনে পড়ে, দাদু যখন তাকে গল্প বলতেন, মাঝে মাঝে তার গাল দুটি টিপে দিতেন আর বলতেন, তুই একটা রাজার মেয়ে আনি, কিন্তু তোর বাপটা একটা জল্লাদ। এখান থেকে তোকে ভাগতে হবে।

দাদু যখন গল্পের ঝুলি খুলতেন, সন্ধ্যার আয়োজন শুরু হতেই, খুব উৎফুল্ল থাকতেন, কারণ ওই সময় আনিসার নতুন মা-ও তাঁর রান্নার আয়োজন শুরু করতেন। রান্নার গন্ধ দাদুকে চাঙা করত। তাঁর গল্পও ডালপালা ছড়াত। একসময় রান্না শেষ হতো। রান্নাঘরের আলো নিভত। ডাল-চচ্চড়ি, পুঁইশাক আর কুচো চিংড়ি অথবা আলু-ডিমের জিব ভেজানো সুগন্ধ মিলিয়ে যেতে থাকত। দাদুর গল্প বলাও থামত। তাঁর চোয়াল ঝুলে পড়ত। চোখের আলো নিভত। তিনি কাতর গলায় বলতেন, ‘বউমা, খাওয়াটা দিয়ে দাও। কেমন?’

বউমা বলত, ‘আগে আপনার ছেলে আসুক।’ ছেলে প্রায় রাতে বারোটার পর ফিরত।

আকাশ থেকে নামা ডানাওয়ালা ঘোড়া শোঁ শোঁ শব্দ করত আনিসার মাথার ওপর। এমনই অল্পখানি উঠান, ঘোড়াটা নামবে কোথায়? আনিসা চোখ বন্ধ করে শুধু বলত, আমার দাদুকে একটু খাবার কি পৌঁছে দেবেন? আমি রেঁধে দেব। আলু ডিম আর শুঁটকি দিয়ে কচুর লতি...?

আনিসার দাদা এ দুটো খাবারকে দুনিয়ার সেরা খাবার মনে করতেন।

শোঁ শোঁ করতে থাকা ঘোড়ায় কোনো সওয়ারি থাকত কি না, আনিসা জানে না। কখনো দেখেনি, দেখার ইচ্ছাও হয়নি। তার রাগ হতো, একবারও হাত বাড়িয়ে কেউ বলেনি, দাও, তোমার টিফিন ক্যারিয়ারটা দাও। আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।

একসময় সে টের পেত বর্ণা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। এই ছেমড়ি, বর্ণা বলত, ‘মশার লগে দোস্তি করিস? কামড়াইয়া চিবাইয়া গায়ের চামড়া ছিলাইয়া নিতাছে, আর তুই বইস্যা আছিস। আয় ঘরে আয়, খামু। খিদা লাগছে।’

বর্ণার ক্ষুধাটা ছিল তীব্র।

কদিন থেকে বর্ণা একদম বদলে গেছে। তার মেজাজে ঝাঁজ, কথায় কামড়। আনিসাকে সে যা যা বলেছে, শুনুন:

: ইছুপের সঙ্গে ট্যাংকি মেরে লাভ নেই। ইছুপের ওপর একমাত্র অধিকার বর্ণার।

: ইছুপকে শরীর দেখালে শরীরের এক ইঞ্চি চামড়া নিরাপদ থাকবে না।

: একটুখানি সাইজ করাকে যদি সে মার হিসেবে নিয়ে কাঁদে, মার কী জিনিস, সে জানে না।

: ট্রাঙ্কের তালা কে ভেঙেছে, সে কীভাবে বলবে? ভেতরে টাকা ছিল, না কানের দুল ছিল, সে কী করে জানে? ছেমড়ি যেন এ নিয়ে আরেকটা কথা না বলে।

: দুই দিনের মধ্যে সে যদি বিরানপুর ছেড়ে চলে না যায়, তাহলে তার শেষ ঠিকানা কোন ডোবায়, কোন নালায় হবে, সেটা বর্ণা বলতে পারবে না। গতকাল সন্ধ্যায় বিরানপুর লোহার পুল থেকে নামলে এক হাতে তার মুখ চেপে অন্য হাতে জাপটে ধরে একটা গাছের নিচে নিয়ে গেছে ইছুপ। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে পড়েছে চারদিকে। রাস্তায় মানুষ চলছে, রিকশাও। এরই মধ্যে এমন দ্রুততায় কাজটি করেছে ইছুপ যে আনিসাও কিছু বুঝে ওঠার সময় পায়নি। তার শরীরে ইছুপের একটি হাত কয়েক মুহূর্ত খেলা করল, তারপর তাকে সে বলল, ‘কাল সন্ধ্যায় সে যেন মীরবাড়ির গলিতে থাকে, ঠিক সাতটায়। যদি সে বাঁচতে চায়। চামড়া-চুল-চোখ অক্ষত রেখে বাঁচতে চায়।’

আজ ওয়াহিদ স্যারকে এই আসল কথাটা সে বলতে চেয়েছে। কিন্তু স্যার চলে গেলেন, কোথায় গেলেন? কোন সেকশনে? ফ্যাক্টরির বাইরে?

অন্য আরেকটা প্রায় আসল কথাও, তাঁকে বলতে চেয়েছিল আনিসা। সেটা হলো এই: সোহেল স্যার তাকে বলেছেন, তাঁর সেকশনে তিনি আনিসাকে ঢোকাতে পারবেন। তবে ঢোকানোর আগে আনিসাকে একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বল এখন আনিসার মাঠে।

সোহেলের চোখে ইছুপের চোখটা যেন কেটে বসানো। দুই চোখের তারাও এক। তাদের নাচন, কাঁপনও এক।

আনিসা একবার ভাবল, পুরোনো এক রুমমেট স্বপ্নার সঙ্গে রাতটা গিয়ে থাকে। কাল ওয়াহিদ স্যারের সঙ্গে কথা বলে না-হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। নিজের বাসায় কিছুতেই ফেরা যাবে না। ইছুপ তাকে থাকতে বলেছে মীরবাড়ির গলিতে, সন্ধ্যা সাতটায়। সেখানে গেলে সে বাঁচবে না। যদি দৈবের কৃপায় বেঁচেও যায়, বর্ণার হাত থেকে কে তাকে বাঁচাবে?

ছয়টার পর আনিসা বেরিয়ে পড়ল। কিছু দূর গিয়ে দেখল, রাস্তাজুড়ে অসংখ্য মানুষ—এত মানুষ, রাস্তায় কেউ চলতে পারছে না। আনিসাকে দাঁড়াতে হলো; এবং দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার ভয়টা যেন হঠাৎ চলে গেল। আনিসার চারদিকে তার মতোই অনেক মেয়ে, সবার চোখে আগুন। এই আগুন তাকে নিশ্চয় বাঁচাবে।

সে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী ভাই?’

মেয়েটাও হয়তো কোনো ভয়ে ছিল, পাঁচ বছর লম্বা একটা চাকরি এক নিমেষে হারিয়ে ফেলার মুখে পড়লে যেমন ভয় হওয়ার কথা। সে আনিসাকে জানাল, সে রাজ গার্মেন্টসে চাকরি করে কিন্তু এখন তাদের অনেককে ছাঁটাই করা হবে। সকাল থেকেই উত্তেজনা হচ্ছে, শোনা যাচ্ছে মালিকের ছেলে আসবেন। তিনি হয়তো ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেবেন। তিনি আসবেন বলে পুলিশ এসেছে। মালিকের গুন্ডাবাহিনী তাদের ঘিরে রেখেছে।

প্রতিদিন ওয়েলনেসে আসার পথে আনিসা রাজ গার্মেন্টসের বিশাল দালান দেখে। তার চোখ জুড়িয়ে যায়। তার বন্ধু মনিকা বলেছে, এক শ বিঘা জমি নিয়ে রাজ গার্মেন্টস। চল্লিশ হাজার লোক কাজ করে।

মনিকার বাড়িয়ে বলার অভ্যাস। তারপরও রাজ গার্মেন্টস আনিসার কাছে এক বিস্ময়।

মানুষজনের উত্তেজনা আর হইচইয়ের ওপর দিয়ে একটা আকাশ-কাঁপানো ঠ-ঠা শব্দ শোনা গেল, শব্দ যে তৈরি হচ্ছে আকাশেই। মানুষজন দেখল লাল রঙের একটি হেলিকপ্টার এসে রাজ গার্মেন্টসের ছাদের ওপর কিছুক্ষণ থমকে থাকল, তারপর নামল। ছাদের ঠিক কোন জায়গায়, মানুষ জানল না। আটতলা উঁচু বিশাল দালানের ছাদটা নিচ থেকে শুধু আন্দাজই করা যায়।

আনিসার হঠাৎ ডানাওয়ালা ঘোড়ার কথা মনে পড়ল। এই যন্ত্রঘোড়াটাও অনেকক্ষণ মাথার ওপর শোঁ শোঁ করল কিন্তু এর সওয়ারিকেও দেখা গেল না।

রাজ গার্মেন্টসের সামনে জমতে থাকা উত্তেজনা আরও গাঢ় হলো। মানুষ অপেক্ষা করতে থাকল মালিক ইরফান হোসেন রাজের বিলাতফেরত পুত্রের জন্য। চিৎকার থেমেছে, কিন্তু গুঞ্জন বেড়েছে। সেই গুঞ্জন ছাপিয়ে গার্মেন্টসের মেয়েটি কথা বলছে আনিসার সঙ্গে। তাদের দশ মিনিটের কথাবার্তায় আনিসা জানল: মেয়েটির নাম সুমিতা। থাকে পোয়া মাইল দূরে বালিয়াপাড়ায়।

ঘড়ির কাঁটা সাত পার হলে আনিসার মনে ইছুপের মুখটা ভেসে উঠল। সে ভয়ে চোখ বুজল। সুমিতা সেই ভয় পড়তে পেরে এর কারণ জিজ্ঞেস করল। আনিসা তার গল্পটা বলল। সুমিতা তার পিঠে একটা হাত রেখে বলল, ‘আমার সঙ্গে চলো। দুজনেরই তো চাকরি গেছে। একসঙ্গে কোথাও চাকরি খুঁজে নেব।’

আনিসার হাতের ঘড়িটা ছিল কাজী ভাইয়ের দিয়ে যাওয়া শেষ উপহার।

রাজ গার্মেন্টসের বড় গেটটা হঠাৎ খুলে গেল। দুজন লোক একটা বড় স্টেপ লেডার বয়ে এনে সেটি গেটের সামনে বসিয়ে দিল। সেই লেডার বেয়ে এক সুদর্শন তরুণ তরতর করে অনেকটা উঁচুতে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার হাতে একটা বুল হর্ন। সুমিতা ছোট্ট করে আনিসাকে বলল, ‘এই মাইক এখন আমার মৃত্যু ঘোষণা করবে।’

না, রাজ সাহেবের ছেলে মৃত্যু কেন, কোনো কষ্টের কথাও ঘোষণা করল না। সুন্দর, পরিষ্কার বাংলায় সে বলল, দেশে ফিরে সে রাজ গার্মেন্টসের দায়িত্ব নিয়েছে। এখন আর কেউ ছাঁটাই হবে না, বরং বেতন বাড়বে। সে বলল, ‘আপনারা বাড়ি যান। আনন্দ করেন। কাল আসেন। কাল আপনাদের নেতাদের সঙ্গে বসব।’

মানুষ প্রথমে কথাগুলো অবিশ্বাস করল। তারপর একে অপরকে জিজ্ঞেস করতে থাকল, তারা ঠিক শুনেছে কি না। তারপর তারা আকাশ কাঁপিয়ে আনন্দের আওয়াজ তুলল, হল্লা করল এবং রাস্তা ছেড়ে বাড়ি-মেস-বাজার-বাসস্টপের দিকে দৌড় লাগাল।

সুমিতা বলল আনিসাকে, ‘চলো, তোমাকে আজ কোক খাওয়াব। তারপর বাড়ি যাব।’

তিন

একটা কনফেকশনারি থেকে দুই বোতল কোক কিনে তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খেতে থাকল। সুমিতার কাছে কোক হচ্ছে আরাধনার পানীয়। আনিসা কখনো কোক খায়নি, তবে খেতে গিয়ে তার মনে হলো, এমন কিছু সে জীবনে খায়নি। তারা পরমানন্দে কোক খাচ্ছিল, সে জন্য খেয়াল করেনি তাদের পেছনে একটা জিপ এসে থেমেছে। রাজ সাহেবের ছেলে জিপ থেকে নেমে দোকানিকে জিজ্ঞেস করল, ‘সোডার ক্যান আছে কি না।’

তারা আরও খেয়াল করেনি, সামনে থেকে একটা মোটরসাইকেলও এসে থামল। স্টার্ট বন্ধ না করে এর সওয়ারি ইছুপ আনিসাকে বলল, ‘ওঠ, আমার পেছনে ওঠ।’

আনিসা কোক খাওয়া থামিয়ে ইছুপকে দেখল। কোকের বোতলটা তার হাত থেকে পড়ে গেল।

ইছুপ তাকে টান দিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে বসাল। আনিসা বুঝল, এই যাত্রা হবে অগস্ত্যযাত্রা। সে ইছুপের হাতে একটা কামড় দিয়ে নেমে পড়ল। সুমিতা একটা বিপন্ন চিৎকার দিল। ইছুপ মোটরসাইকেলটা ছেড়ে কোমর থেকে একটা ছুরি বের করল। ছুরিটা সে আনিসার তলপেটে বসিয়ে দিল।

বসাতে বসাতেই সে অবশ্য টের পেল, তার কাঁধ এবং মাথার পেছনটাতে একটা প্রবল আঘাত তীব্র একটা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।

আঘাতটা রাজ-পুত্রের জিম করা সুঠাম, শক্তিশালী হাতের। ইছুপকে পরাস্ত করে তিনি মনোযোগ দিলেন আনিসার দিকে। আনিসার চোখ কাঁপছে, শীতের আমলকী পাতার মতো। নিচু হয়ে তিনি আনিসাকে তুলে নিলেন। সঙ্গের একটা লোককে বললেন, ‘ডেভিডকে ফোন লাগাও। কপ্টার রেডি করতে বলো।’

চার

আনিসার জ্ঞান ফিরল রাত বারোটায়। অচেনা এক বিছানায়, অচেনা দালানে। রাতের অচেনা সময়ে।

সে দেখল সাদা অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার। দু-একজন নার্স। ঝুঁকে পড়ে তারা তাকে দেখছে।

আরেকজনের মুখ সে দেখল, এক অদ্ভুত সুন্দর হাসিতে রাঙানো। মুখটা রাজ-পুত্রের।

ডাক্তার রাজ-পুত্রকে বললেন, আর ভয় নেই, তবে একে হেলিকপ্টারে করে না নিয়ে এলে কী হতো, বলতে পারি না।

আনিসার ভেতরে বোধগুলো সক্রিয় হচ্ছিল। হেলিকপ্টার শব্দটি বোধের ঝিমুনি পুরোটা ভেঙে দিল। সে তার হারিয়ে যেতে বসা শক্তিগুলোকে একখানে করে একটা খোঁপার মতো বাঁধল; এবং আস্তে একটা প্রশ্ন করল, ‘হেলিকপ্টার?’

‘হ্যাঁ, আনিসা’, রাজ-পুত্র বললেন, ‘হেলিকপ্টার।’

‘এখন বিশ্রাম নাও। আমি তোমার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকব।’

রাজ-পুত্রের হাতের স্পর্শে তার শক্তি-খোঁপাটা এলোমেলো হয়ে পড়ল। বোধগুলো তাদের তেজ হারাল। তার চোখ বুজে এল।

বুজে যাওয়ার আগে তার চোখাচোখি হলো রাজ-পুত্রের সঙ্গে। সেই চোখে কার চোখ কেটে বসানো? তার এলোমেলো বোধ তাকে পরিষ্কার কোনো ধারণা দিতে পারল না, চোখ দুটি কার। কাজী ভাইয়ের? নাকি তার জীবনে ঢুকে পড়া অন্য কোনো মানুষের?

ডাক্তার বললেন নার্সদের, চলো আমরা যাই। উনি রোগীকে ঘুম পাড়াবেন। এখন রোগী ঘুমাবে।