টার্গেট আত্মজীবনী

>

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান

নতুন বছরে নতুনের আবাহনে সবাই নিজের মুখোমুখি হন, করেন নতুন পরিকল্পনা। লেখকেরাও এর বাইরে নন। এই আয়োজনে আকবর আলি খান লিখেছেন ২০১৮ সালে লেখালেখি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা

আমি মূলত পাঠক, বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে ভালোবাসি। বই লেখার কষ্ট করতে চাইনি। তবু অনেক দিন পড়াশোনার পর একসময় আমার মনে হলো, কোনো কোনো বিষয় সম্পর্কে আমার নিজের কিছু বক্তব্য আছে। এই ভাবনা থেকে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে ডিসকভারি অব বাংলাদেশ নামে একটি বই লিখলাম, পাঠকের কাছে যা বেশ সমাদৃত হলো। পণ্ডিতেরাও একে পুরস্কারে ভূষিত করলেন। এরপর ২০০১ সালে প্রকাশিত হলো আরেকটি বই—পরার্থপরতার অর্থনীতি। এটিও পাঠক আনুকূল্য লাভ করল। আসলে পাঠকদের আগ্রহেই মূলত আমি লিখি।

তবে আমার একটা বড় অসুবিধা এই যে কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে চিহ্নিত করা যাবে না। আমি ইতিহাস নিয়ে যেমন লিখেছি, তেমনি অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়েও লিখেছি, উন্নয়নচর্চা নিয়ে লিখেছি, লোকপ্রশাসন নিয়ে লিখেছি, আবার সাহিত্য বা পানি সম্পদ নিয়েও লিখেছি। অর্থাৎ বিচিত্র বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে। ফলে আমার পক্ষে হয়তো কোনো বিষয়েই বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও আমি লিখছি, লিখে চলেছি।

ইচ্ছা ছিল সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর অনেক বই লিখব। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি তিনটি কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুশীল সমাজের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার ফলে। তৃতীয়ত, অতিসম্প্রতি আমার স্ত্রী ও আমার একমাত্র সন্তান মারা গেছেন। সুতরাং মানসিকভাবেও আমি এখন বিপর্যস্ত। এই তিন কারণে বিভিন্ন সময়ে আমার লেখার কাজ থেমে গেছে, ততটা করে উঠতে পারিনি।

মানসিকভাবে খুব একটা ভালো না থাকলেও এ মুহূর্তে আমি পাঁচটি বই নিয়ে কাজ করছি। কতটুকু সম্পন্ন করতে পারব, সেটা নির্ভর করবে শারীরিক সামর্থ্য ও মানসিক ধৈর্যের ওপর।

প্রথম বইয়ের নাম দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। এই বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হিন্দু-মুসলমান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে যেসব অত্যুদ্ভুত ধারণা প্রচলিত আছে, সেগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের যেসব চিন্তাভাবনা রয়েছে, আধুনিক যুগের প্রাসঙ্গিকতায় সেগুলো আলোচিত হয়েছে। বইটি নিয়ে এখনো কাজ করছি। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এটি প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

দারিদ্র্যকে বিষয় করে একটি বই লিখছি। দারিদ্র্য হ্রাস নিয়ে বাংলাদেশে অনেক হইচই হয়েছে, হচ্ছে। তবে দারিদ্র্য কী এবং দারিদ্র্য হ্রাসের তাৎপর্য কী—এ-সম্পর্কে অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের তুলনায় জাতীয় দারিদ্র্য হারের ভিত্তিতে অবশ্যই দারিদ্র্যের নাটকীয় হ্রাস ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় দারিদ্র্যের হার যে আয়ের ওপর নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য হারের কোনো মিল নেই। আন্তর্জাতিক হারে বাংলাদেশে এখনো অনেক প্রকট দারিদ্র্য রয়েছে। এখানে এখন হয়তো মানুষ না খেয়ে নেই। কিন্তু ১৯৭০-এর তুলনায় বস্তিবাসীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মানুষ খাবার পাচ্ছে, কিন্তু সুপেয় পানি পাচ্ছে না। ১৯৭০-এ বোতলের পানি কেনার দরকার ছিল না। আজকে গরিবদের জন্য তা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের দারিদ্র্যকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের এ বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন রয়েছে। আলোচ্য বইয়ে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যেসব উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি চালু হয়েছে—যেমন গ্রামীণ ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ, ব্র্যাক এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা যেসব কাজ করেছে—সেগুলোর মূল্যায়ন করা হবে। বিশ্লেষণ করা হবে ইসলামি ব্যাংক কর্মসূচির সফলতা ও দুর্বলতাও। এ ছাড়া সরকারের যেসব কর্মসূচি আছে, সেগুলোর দুর্বলতাগুলো উপস্থাপনের চেষ্টা থাকবে বইটিতে। এই বইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে আমি তিন বছর পড়িয়েছি। বইটি হয়তো আগামী বছরের শেষ দিকে শেষ করতে পারব।

কাজ করছি বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে। এতে মূলত ডিসকভারি অব বাংলাদেশ-এ যে তাত্ত্বিক কাঠামো পেশ করেছিলাম, তারই আলোকে আলোচনা করা হবে বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস।

এ বইগুলো ছাড়াও লিখছি আরেকটি বই—সম্প্রতি যাঁরা অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁদের মূল ধারণাগুলো পাঠকের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরা হবে এই বইয়ে। কাজ অনেকটা এগিয়েছে। তবে কত দিনে লিখে উঠতে পারব, তা বলতে পারি না।

এসবের সঙ্গে সঙ্গে আমার আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনাও করেছি। ধারণা করি, আত্মজীবনীটি হবে তিন খণ্ডে। প্রথম খণ্ডে থাকবে আমি, আমার পরিবার ও ছোটবেলার কাহিনি। এই খণ্ডের জন্য এখন আমি তথ্য সংগ্রহ করছি। আশা করছি শিগগিরই এটি বের করা যাবে। এরপর বাকি দুই খণ্ড কখন লেখা হবে, সেটি সময়ই বলে দেবে। যদি স্বাস্থ্যের অবনতি না হয়, তবে হয়তো আগামী বছর দু-একের মধ্যে পরের দুই খণ্ড আলোর মুখ দেখতে পাবে।