রাত পোহালে পাখি বলে

>
আনিসুল হক
আনিসুল হক

নতুন বছরে নতুনের আবাহনে সবাই নিজের মুখোমুখি হন, করেন নতুন পরিকল্পনা। লেখকেরাও এর বাইরে নন। এই আয়োজনে আনিসুল হক লিখেছেন ২০১৮ সালে লেখালেখি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা

পরিকল্পনা করে তো কিছু করিনি। পরিকল্পনা করে জন্মগ্রহণ করিনি, একদিন দেখি, একটা জীবন পেয়েছি, দোয়েল-শালিকের নয়, শুঁয়োপোকা-প্রজাপতির নয়, মানুষের জীবন। পরিকল্পনা করে ছেলে হইনি, পরিকল্পনা করে রংপুর বেছে নিইনি, পরিকল্পনা করে যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিলাম, তা-ও নয়। আবার ভেবেচিন্তে তা ছেড়েছিলাম, সেটাও খুব বলা যাবে না।

হ্যাঁ। আরেকটা ব্যাপার আমার আছে। আমি লিখতে খুব পছন্দ করি। লিখতে বসলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়, দিন ভালো হয়ে যায়। লেখার আগে প্রতিবার মনে হয় বটে যে লেখার প্রতিভা আমি হারিয়ে ফেলেছি, আর পারব না। কিন্তু যখন লেখা শুরু হয়ে যায়, একটু একটু করে এগোতে থাকি, তখন মনে হয়, আরও একবার বেঁচে গেলাম, আমি পারছি, আহ্, জীবন এত সুন্দর কেন! একবার যে আমি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলাম, দুই পায়ে প্লাস্টার করে সটান শুয়ে ছিলাম, আমার স্ত্রী মেরিনা আমার সহকর্মীদের বলেছিলেন, ওকে লেখার কাজ দিন, লিখতে পারলেই ও সুস্থ হয়ে যাবে। আমার ঠ্যাং ভাঙা রোগের চিকিৎসাও আমার লিখতে পারা।

আরেকটা বৈশিষ্ট্য আমার আছে। আমাকে কোনো কাজ দেওয়া হলে আমি সঙ্গে সঙ্গে তা করে ফেলি। আমার লেখার সময় সকাল। সকালে প্রাতরাশ সেরে এক কাপ কফি খেয়ে দিনের লেখাটা সেরে তারপর আমি বের হই। বলতে পারেন, তাহলে এ বছর প্রথমা প্রকাশন থেকে যে উপন্যাসটা বেরোবে, সেটা তো আপনি এখনো লেখেননি, জানুয়ারি গেলে ফেব্রুয়ারির আর থাকবে কী? সারা বছর কী করলেন? সারা বছরও তো লিখেইছি, প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় উপন্যাস বেরিয়েছে, কিশোর আলোয় উপন্যাস বেরিয়েছে, এখন ধারাবাহিক বেরোচ্ছে, প্রতি সপ্তায় কলাম লিখি; আর গত বছর প্রচুর সময় কেটেছে ছবি এঁকে। ছবি আঁকার ভূত আপাতত কাঁধ থেকে নেমেছে, সে-ও এক স্বস্তি।

তো, এই মুহূর্তের কাজ হলো, প্রথমার জন্য উপন্যাসটি লিখে ফেলা। প্রথম দুই দিন কষ্ট হবে, তৃতীয় দিন ধরব, পারব না, চতুর্থ দিন এক হাজার শব্দ, পরের দিন আরও দুই হাজার...তো, শুরু হয়ে গেল রেলগাড়ির ছোটা, একটা সময় দিনে ছয় হাজার পর্যন্ত শব্দ আসতে থাকবে, আমি প্রথমার ব্যবস্থাপক জাফর আহমদ রাশেদকে ফোন-ই-মেল পাঠাব, ২০ হাজার পাঠালাম, পরের দিন ২৬ হাজার, তিন দিন পরে ৪২ হাজার। নাও, আর পারব না। রাশেদ বলবেন, ওস্তাদ, আর ৩ হাজার বাড়ায়া দেন, বোঝেনই তো...আরে না, শেষ করে ফেলেছি...

আপনারা বলবেন, এই জন্য তো আপনার লেখা ভালো হয় না, এইভাবে তাড়াহুড়া করে কেউ লেখে? আমি বলব, একজন লেখক যা পারেন, তাই লেখেন। সারা বছর ধরে একটা উপন্যাস লিখতে হলেও এইই হতো...যে যেমনটা পারে...

তবু স্বপ্ন তো থাকেই। মনে হয়, যদি আর কিছুই না করতাম, শুধু একটা উপন্যাস লিখছি, একটা বছর ধরে; আর কোনো কাজ নেই, দাওয়াত নেই, চাকরি নেই, প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি হওয়া নেই, তাহলে বেশ হতো।

হতো কি? আইওয়াতে ছিলাম তিন মাস। লেখার জন্য অফুরন্ত সময় দিয়েছিল ওরা। আর কোনো কাজ নেই, খাও, ঘুমাও আর লেখো। একটা ছোটগল্পও তো লিখিনি। অথচ আমি ট্রেনে বসে লিখেছি, গাড়িতে লিখেছি, প্লেনে লিখেছি, জাহাজে লিখেছি, বইমেলায় বসে লিখেছি, স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে লিখেছি, শুধু বোধ হয় সাইকেল চালাতে চালাতে কিছু লিখিনি। লিখেওছি হয়তো, মাথার ভেতরে, মনে মনে...আইওয়ার সেই নির্জন প্রবাসবাসে তা-ও লিখিনি।

কাজেই সামনের বছরও এই একই চক্রে থাকব, ফেব্রুয়ারিতে বই বেরোবে, মার্চে দম নেব, এপ্রিলে মেরিল-প্রথম আলোর অনুষ্ঠান, মে মাসে ঈদসংখ্যার লেখা...বছর শেষ...প্রকাশকেরা এসে বলবেন, ২০১৯-এর বইমেলার বইয়ের নাম দেন...আমার রাত পোহালে পাখি বলে দে রে খাই দে রে খাই...