লেখক-সাহিত্যিকদের আনন্দ সম্মিলন

প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) বিচারকমণ্ডলীর সদস্য ওয়াসি আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পুরস্কার হাতে লেখক বেগম আকতার কামাল, বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান আজিজুল হক, পুরস্কার হাতে কবি মোহাম্মদ রফিক, বিচারকমণ্ডলীর সদস্য সেলিনা হোসেন ও খালিকুজ্জামান ইলিয়াস l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) বিচারকমণ্ডলীর সদস্য ওয়াসি আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পুরস্কার হাতে লেখক বেগম আকতার কামাল, বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান আজিজুল হক, পুরস্কার হাতে কবি মোহাম্মদ রফিক, বিচারকমণ্ডলীর সদস্য সেলিনা হোসেন ও খালিকুজ্জামান ইলিয়াস l ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে এখন খ্রিষ্টীয় বছর শুরু হয় সারা দেশে বই নিয়ে উৎসবের ভেতর দিয়ে। এই বই স্কুলের পাঠ্যবই। তবে বছরের শুরুতেই বই নিয়ে আরও একটি আনন্দঘন উৎসব হলো গতকাল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। এটি বর্ষসেরা মননশীল ও সৃজনশীল বইয়ের পুরস্কার বিতরণীর আয়োজন। 
এত দিনে সবার জানা প্রথম আলো বঙ্গাব্দ ১৪১০ থেকে নিয়মিতভাবে সাহিত্যে মননশীল ও সৃজনশীল এই দুটি শাখায় বছরের সেরা দুটি বইকে পুরস্কৃত করছে তার লেখকদের সম্মানিত করে। ১৪২৩ সালের মননশীল শাখায় এই পুরস্কার পেয়েছেন কথা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা বইয়ের লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। আর সৃজনশীল শাখায় বাতিঘর থেকে প্রকাশিত মানব পদাবলি কাব্যগ্রন্থের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি মোহাম্মদ রফিক। তাঁদেরই আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত করা হলো গতকাল সন্ধ্যায়। 
সাহিত্যকৃতির এই স্বীকৃতি জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন দেশের অগ্রগণ্য এবং প্রতিশ্রুতিশীল নবীন সাহিত্যিক, প্রকাশক ও পাঠকেরা। বাংলা একাডেমির চত্বর মুখর হয়ে উঠেছিল তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত আলাপচারিতায়। পুরস্কৃত লেখকদের অভিনন্দিত করছিলেন তাঁদের অনেকে। সামনেই অমর একুশের বইমেলা। এবার মেলায় কার কী নতুন বই আসছে, লেখালেখি নিয়ে কার ভাবনাই-বা কেমন, সেসবও ছিল অনেকের আলোচ্য। এরই ফাঁকে আঁধার একটু গাঢ় হতেই শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। 
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সবাইকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর সূচনাভাষ্যে বললেন, ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কারের ১৪ বছর পূর্ণ হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সাহিত্যকে উদ্যাপন করা। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ইতিহাসে আমাদের অনেক এগিয়ে রেখেছে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে যখন আমরা একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি সেই ঐকান্তিক লক্ষ্যে, অভিন্ন ভাবনায় সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এই পুরস্কারের ভেতর দিয়ে আমরা মননশীল ও সৃজনশীল সাহিত্যকে আরও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরারই চেষ্টা করছি।’ 
এরপর পরপর দুটো গান। প্রিয়াঙ্কা গোপ গেয়ে শোনান ডি এল রায়ের ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’ এবং অতুল প্রসাদ সেনের ‘কে তুমি বসে নদী কূলে একেলা’। 
বিচারকমণ্ডলী পুরস্কৃত লেখকদের নিয়ে মঞ্চে এলেন। এও সবার জানা যে বর্ষসেরা গ্রন্থের বিচারে প্রথম আলোর কোনো হাত থাকে না। দেশের অগ্রগণ্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। বাকি কাজটি তাঁরাই করেন। এবার বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। বিচারকাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এই কাজটি খুবই কঠিন। তারপরেও তাঁরা তাঁদের বিদ্যা-বুদ্ধি, সাধারণ জ্ঞান ও সাহিত্যপাঠ থেকে বিচার-বিবেচনা করে এই বই দুটি নির্বাচন করেছেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তিনি বলেন, মোহাম্মদ রফিক তাঁর কবিতায় নতুন চিন্তা ও বিষয়ের উপস্থাপনা করেছেন দেশের গ্রামীণ পটভূমি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে। আর বেগম আকতার কামাল তাঁর গবেষণায় রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মদর্শনের অন্তর্নিহিত যে ভাবনা, মানবহিতৈষা, তা-ই তুলে ধরেছেন। 
এরপর পুরস্কার দেওয়ার পালা। প্রথমেই মননশীল শাখার পুরস্কার। বেগম আকতার কামালের বইয়ের অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। এতে বলা হয়, ‘রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিশ্বাসকে বেগম আকতার কামাল শুধু আধ্যাত্মিকতা ও অধিবিদ্যার নিরিখেই বিচার করেননি, উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন এর যৌক্তিক ও সৃজনশীল স্বরূপও। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিশ্বাসকে বোঝার চেষ্টা করছেন প্রাসঙ্গিক ও কল্পনার যুক্তি দিয়ে।’ তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য ওয়াসি আহমেদ। বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ক্রেস্ট ও এক লাখ টাকার অর্থমানের চেক তুলে দেন তাঁর হাতে। 
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বেগম আকতার কামাল বলেন, তিনি দীর্ঘদিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের রবীন্দ্রনাথ পড়াচ্ছেন। কবির ব্রহ্মভাবনা বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেছেন অধ্যাত্মভাবনা একটা পর্যায়ে চরম বিকাশের ভেতর দিয়ে মানবমুখী হয়ে উঠেছে। তিনি কবির এই ভাবনার ক্রমবিকাশের ধারাটিকেই তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। 
মানব পদাবলি গ্রন্থের অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর অপর সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এতে বলা হয়, ‘কবি তাঁর এই হৃদয়-উৎসারী পদাবলিতে বিম্বিত করেছেন তাঁর আত্মদর্শনের স্মৃতি। তাঁর সমকাল-চেতনার সঙ্গে মিশিয়েছেন ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের পাঠ এবং লোক মনীষার চিরন্তন চরিত্র বেহুলা-কপিলার পুনর্বয়ান।’ কবিকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য সেলিনা হোসেন। ক্রেস্ট ও চেক তুলে দেন বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান আজিজুল হক। 
প্রতিক্রিয়ায় কবি মোহাম্মদ রফিক বলেন, শারীরিকভাবে তিনি একটু অসুস্থ। তবে এই পুরস্কার তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। কবিত্ব হলো আত্ম-আবিষ্কার, প্রতিবাদ, ন্যায়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, কারও দাসত্ব না করা। এই কবিত্ব শৈশব ও যৌবনে সবার ভেতরেই থাকে। তারপর ধীরে ধীরে পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং আরও নানা কারণে অনেকের ভেতরের এই কবিত্ব চাপা পড়ে যায়। এই আত্মজিজ্ঞাসা, এই সংগ্রাম যদি না থাকে তাহলে কেউ কীভাবে কবি হতে পারেন? কবির কাজ এই প্রতিবাদ, এই সংগ্রাম, এই আত্মজিজ্ঞাসাকে অন্যের ভেতরে সঞ্চারিত করে দেওয়া। তিনি সেই কাজটি করে চলেছেন। তার স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার তাঁকে একই সঙ্গে আনন্দিত ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। 
আনুষ্ঠানিকতার পালা শেষ। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আয়োজনটিকে সফল ও প্রথম আলোকে সম্মানিত করার জন্য সমবেত সাহিত্যিক ও সাহিত্যামোদী বিদগ্ধজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন চায়ের উষ্ণতায়।