প্রকৃতির আঁকিবুঁকি

‘এই যে ইঁদুরছানারা, তোমরা শুধু কুটকুট করে কাটো কেন?’ তুলতুলে দুই ইঁদুরছানা ই আর ঈ। ওরা বলে ওঠে ‘চুঁচুঁচুঁ’—মানে ‘আমরা তো কিছু করিনি। এই দেখো না, আমাদের এখনো দাঁতই গজায়নি। মা বলেছে, তোমার দাঁত আমাদের গর্তে না ফেললে আমাদের দাঁত গজাবে না।’

শুনে প্রকৃতি বলে, ‘আমার দাঁত তোমাকে কেন দেব?’

‘বা রে, তুমি আমাদের বন্ধু না?’

 ‘আমি আবার কবে বললাম তোমরা আমার বন্ধু।’

 ‘কেন, তুমি যে কাল তোমার ড্রইং খাতায় আমাদের ছবি আঁকলে?’

 ‘সেটা তো আমার স্কুল থেকে বাড়ির কাজ দিয়েছিল বলে...’

 ‘না না, তা হবে কেন? তুমি আমাদের বন্ধু ভাবো, তাই এঁকেছো।’

ইঁদুরছানাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে প্রকৃতি এবার বিরক্ত হয়ে গেল। বলল, ‘তোমরা এখন বিরক্ত কোরো না তো, আমি এখন খেলব।’

 ‘আমাদের সঙ্গে খেলো।’ ইঁদুরগুলোর আবদার।

 ‘না, এখন আমি তোমাদের সঙ্গে খেলব না। আমি এখন মোবাইলে গেম খেলব।’

 ‘আচ্ছা খেলো। কিন্তু আমরা তোমায় বিরক্ত করব না। তুমি শুয়ে শুয়ে খেলবে আর আমরা বালিশের পাশে চুপটি করে বসে থাকব।’

 ‘আচ্ছা থাকো। কিন্তু কোনো দুষ্টুমি করবে না।’

 ‘শুধু একটা কথা!’ ছোট্ট ইঁদুর দুটো আবার আবদারের সুরে বলে, ‘আচ্ছা বলো তো, এই যে তুমি মোবাইল নিয়ে কার্টুন দেখছ, গেম খেলছ, এটা না করে আমাদের সঙ্গে খেলতেও তো পারো। আমরা অনেক মজা করব।’

 ‘কিন্তু মোবাইলের খেলার চেয়ে বেশি মজা কি দিতে পারবে?’

 ‘খুব পারব। একদিন কী হয়েছে জানো? আমি আর আমার বোনেরা মিলে তোমার বাবার জামার পকেটে যে সুন্দর সাদা রঙের পিপপিপ যন্ত্রটা, মানে মোবাইলটা থাকে, সেটা নিয়েছিলাম। তুমি সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে থাকো, তাই আমাদের খুব হিংসা হয়েছিল। পিপপিপ যন্ত্রটা নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের ঘরে। তখন মা খুব ভয় পেয়েছিল। বলেছিল, “এটা ছোটদের জন্য ভালো নয়। অনেক অসুখ করে। তোমরা কখনো এটা ধরবে না।” আমরা মাকে বললাম তোমার কথা। বললাম “চোঁচোঁচোঁ, চিঁচিঁচিঁ”—মানে প্রকৃতি যে সারাক্ষণ এই যন্ত্রটা নিয়ে থাকে, ওদের বুঝি কিছু হয় না? মা কী বলল জানো? বলল, “মানুষের শিশুদেরই ক্ষতি হয় বেশি।” এখন তুমিই বলো। তোমাকে তো আমরা বন্ধু মনে করি। তোমার যদি অসুখ করে তাহলে আমাদের ভালো লাগবে?’

প্রকৃতি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল। বলল, ‘হুম, বুঝলাম। কিন্তু কী করব বলো? আমার কি কোনো খেলার সাথি আছে? কোনো বন্ধু আছে? আমি তো স্কুল থেকে ফিরে সারাক্ষণ একা একা থাকি। মা-বাবা অফিস থেকে আসে সেই বিকেলে, কখনো রাতে। কীভাবে আমার সময় কাটে বলো? আমার তো মাঠে গিয়ে খেলতে ইচ্ছে করে, পুকুরে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। নদীর কাছে, সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। পাখিদের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে। সবই তো বই আর টিভিতে দেখি। আমাদের শহরে কোথায় আছে এসব বলো?’

 ‘হুম, তোমার অনেক দুঃখ। আর দুঃখ পেয়ো না। আমরা এখন থেকে আরও বন্ধু বানাব। তাদের সঙ্গে খেলব। চলো, আমরা কাক পাখিদের ডাকি। ওই দেখো দুইটা চড়ুই পাখিও তোমাদের জানালার কার্নিশে বসে আছে। আর তোমাদের ঘরে যে চারটা টিকটিকি থাকে, ওদেরও ডাকা যেতে পারে।’

বুদ্ধিটা বোধ হয় প্রকৃতির পছন্দই হলো। সে বলল, ‘কিন্তু তেলাপোকাদের নেব না। ওরা অনেক দুষ্টু। আমার স্কুলব্যাগ, আমার লাল জুতার মধ্যে বসে নোংরা করে।’

 ‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, ওদের আমরা দলে নেব না।’

 ‘শোনো ঈ, প্রজাপতিদের নিতে পারো। মাঝেমধ্যে আমাদের ঘরে আসে। আর আমাদের বাড়ির গ্যারেজে যে কালো বিড়াল থাকে, ওকেও। কিন্তু মা যে ওকে ঘরে আসতে দিতে চায় না...’

 ‘ও আসতে পারবে। আমরা চুপিচুপি দরজা খুলে দেব আর ও চলে আসবে। যদিও বিড়ালের সঙ্গে আমাদের খুব একটা বন্ধুত্ব নেই। তবু তুমি যখন বলছ...’

এরপর সবাই অবাক হয়ে দেখল, প্রকৃতির আর মোবাইলে মন নেই। এখন তাঁর অনেক খেলার সাথি। ইঁদুরছানা ই আর ঈ, প্রজাপতি প আর পৃ, কালো বিড়াল ম্যাও, চড়ুই পাখি চ আর চো, চার টিকটিকি ট, ঠ, ড, ঢ আর কাকের দল। ওরা বারান্দায় বসে খেলে। বিড়ালের পিঠে উঠে ই, ঈ মজা করে। চড়ুই পাখি বসে প্রকৃতির কাঁধের ওপর। প্রজাপতি উড়ে উড়ে টিকটিকির সঙ্গে খেলে। আবার কখনো ওরা সবাই মিলে গোল হয়ে বসে। যে যার ভাষায় গান করে। প্রকৃতি বলে, ‘তোমরা এক কাজ করো। চুপটি করে আমাদের ডাইনিং টেবিলের ওপর এসে বসো।’

সবাই একযোগে বলে, চিঁ চিঁ, কা কা, পিউ পিউ, প্রো প্রো...ইত্যাদি। এর মানে দাঁড়ায়, ‘কেন কেন?’

প্রকৃতি বলে, ‘আগে বসো, তারপর দেখতে পাবে।’

সবাই টেবিলের ওপর গিয়ে বসে। প্রকৃতি নিয়ে আসে রং পেনসিল আর ড্রইং খাতা। বলে, ‘এখন আমি তোমাদের সবার ছবি আঁকব। কিন্তু শর্ত হলো কেউ নড়াচড়া করবে না। আমার আঁকা শেষ হবে তারপর সবাই দেখবে।’

চড়ুই উড়ে এসে একটা রং পেনসিল ঠোঁটে করে নিয়ে নেয় নিজের কাছে। কাক বলে, ‘এই চ তুমি তো দেখি খুব দুষ্টু। দিয়ে দাও। না দিলে কিন্তু তোমার ছবি আঁকা হবে না।’ সবাই চুপটি করে বসে। প্রকৃতি সবার ছবি আঁকতে থাকে। ই, ঈ দুষ্টুমি করে বলে, ‘প্রকৃতি চলো মোবাইলে গেম খেলি।’ প্রকৃতি বলে, ‘ই, ঈ, তোমরা দেখি খুব দুষ্ট! দেখছ না আমি এখন সবার ছবি আঁকছি। আর মোবাইল তো পচা একটা খেলনা। এর চেয়ে তোমাদের সঙ্গে খেলতে, তোমাদের ছবি আঁকতে কত কত মজা!’

ই আর ঈ-র এখন দাঁত গজিয়েছে দুটো। সেই দাঁত বের করে ওরা মুচকি হাসে।