এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ!

তুন করে পাব বলে—মারুফুল ইসলামের কবিতা বই। বইয়ের ভূমিকায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘...নতুন করে পাব বলের পেছনে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নতুন করে পাব বলের কবিতাগুলির বিষয়বৈচিত্র্য ব্যাপক। বেশির ভাগ কবিতা লিরিকধর্মী। ছন্দে, চলনে প্রতিটি কবিতায় এক-একটি বিরল মুহূর্ত উন্মোচিত এবং কবিতার শেষে, যখন এর দর্শন একটা সংহতির পথে যাচ্ছে, হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের একটি গানের পঙ্‌ক্তি ভেসে আসে, যা আসে সেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির পথে। কবিতাটিতে এরপর অনেকগুলো মাত্রা খুলে যায়। নতুন করে পাব বলে যেন এক বিস্ময়ের পৃথিবী, যা মারুফ দেখেন একটি জানালার ভেতর দিয়ে, যে জানালাটা সংবেদনশীল চিন্তার, ভাবনার।’

ওপরের ভাষ্য থেকে বই সম্পর্কে প্রাথমিক যে ধারণা তৈরি হলো, এবার পাঠক হিসেবে তা মিলিয়ে নেওয়ার পালা।

এই কাব্যগ্রন্থে কবিতার স্বতন্ত্র কোনো নাম নেই, কবিতাগুলো বিন্যস্ত হয়েছে নম্বর দিয়ে, সিরিজ আকারে। বলার কথা হলো, এ বইয়ের কেন্দ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রতিটি কবিতা শেষ হয়েছে তাঁর স্মরণ নিয়ে।

মোট ১০৮টি কবিতা খণ্ডের মিলনরূপ ও প্রবাহিত বিকাশ একীভূত হয়ে যখন নতুন করে পাব বলে গ্রন্থের সমাচার দিল, তাতে একজন মারুফুল ইসলাম ভুবন যাত্রায় অনুভব করলেন ‘কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’। তারপরেই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

ভাষাকে ধারণ করে, বর্ণকে রক্তাক্ত করে, অধিকারকে বারুদে ছেনে যে দেশের জন্ম, তার নাম বাংলাদেশ। গ্রন্থের প্রথম কবিতায় পাওয়া যায় কবির ভ্রমণ পরিসর—সুমিদা নদী, টেমস নদী, আটলান্টিক শহর, জুরিখ থেকে প্রশান্ত মহাসাগর—সর্বত্রই কবি দেখেন বাংলাকে। স্বদেশপ্রেমের এই অনুভবে বন্ধু আছে, প্রিয়তমা আছে, সন্তান আছে, রয়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। তাই তো ঠিক পরের কবিতায় বুড়িগঙ্গা এসে হামাগুড়ি দেয়, ধ্বংসের ছাই আর রক্তের উত্তাপ পাশাপাশি পড়ে থাকে। সৃষ্টির মহত্তম উপাদান হয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক পাঁজরে তৈরি হয় বিজয় দুর্গ—‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’—এ-তো আমাদেরই পোঁতা খুঁটি, এ-তো আমাদেরই পিপাসার জল।

একটি কবিতার দিকে তাকানো যাক: ‘ডোরাকাটা বাঘ মশাল জ্বালায় বনে/ হৃদয়ের ঝড়ে কাল বোশেখির নাম/ কে নয়ন তুলে তাকায় ঈশান কোণে/ ঘুম ভেঙে পাই সুনীল মেঘের নাম।’

লক্ষণীয়, ছয় মাত্রায় ‘মশাল জ্বালায়’ থেকে ‘হৃদয়ের ঝড়ে’-এর তাপ ও গতি; ঈশান কোণ কিংবা মেঘের নামে-এর আহ্বান—‘তুমি যত দূর আমি তত দূর হাঁটি’; ক্রমান্বয়ে ভেতরে এগোলে, এই যে রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে চলা কিংবা তাঁর করাঙুল স্পর্শ করে বলা ‘আরো একটু বসো তুমি, আরো একটু বসো’—তা যেন কবির লগ্ন হওয়ার অভিপ্রায়ে, মগ্ন থাকার কাব্যচিত্রে বিধৃত।

বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে কবিতার প্রেমময় ছবিগুলো কখনো মাটিমগ্ন হয়; এবং সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দৃশ্যমান হন মধুসূদন, চণ্ডীদাস, কাহ্নপা, লালন, হাছন, নজরুল; জীবনানন্দও নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যান জলে। আর আমরা অপেক্ষায় থাকি এক ভাষা-নির্মাণের কারিগরের, রাঙামাটির পথ মাড়ানো এক পথিকের।

নতুন করে পাব বলে বইয়ে দেখা মেলে আনন্দময় মারুফুল, চিত্রপূর্ণ মারুফ, গাঢ় বোধের এক কবি মারুফুল ইসলামের। এতে বেদনা যে নেই, তা বলি না। আনন্দ যে দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তা-ও নয়। তবে এই কবিতার হ্যাংওভার শেষ হলে জাগে যেন দ্বিগুণ তৃষ্ণা—আবার পড়তে থাকি কবিতাগুলো। দেখি যে নতুন করে, নতুন স্বরে ঠাকুরের বল স্কন্ধে ধরে, রবীন্দ্রনাথের ঢল শিরোধার্য করে দাঁড়িয়ে আছেন মারুফ। এর মধ্যে আবশ্যই আছে নান্দনিকতা ও অভিনবত্ব। বইয়ের ৮৪ সংখ্যক কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করি:

‘তবু ডাকে ক্ষুৎপিপাসা গান

 কবিতার ছায়াতে

হঠাৎ করে ছন্নছাড়া ঝড়বাতাসের নিমন্ত্রণ

তাড়াহুড়োর পাতার ভাঁজে পাঁজর বাজে এস্রাজে

তোমায় নতুন করে পাব বলে

 হারাই ক্ষণে-ক্ষণ’।

নতুন করে পাব বলে

মারুফুল ইসলাম

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১৭, ১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।