দু-দুবার বাজেয়াপ্ত হয়েছিল যে বই

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

প্রথমা প্রকাশন সমাজ ইতিহাস গ্রন্থমালা শিরোনামে যেসব পুরোনো অথচ গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করছে, সেই সিরিজেরই সদ্য প্রকাশিত বই খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের লেখা ভাসানী যখন ইউরোপে। বইটির রচনার একটি নেপথ্য পটভূমি রয়েছে। সেই পটভূমি তুলে ধরেছেন প্রকাশক মতিউর রহমান খুবই সুন্দরভাবে, প্রাঞ্জল ভাষায়। তিনি জানাচ্ছেন, ‘১৯৫৪ সালের নির্বাচনী বিজয়ের পর যুক্তফ্রন্টের তিন নেতার অন্যতম এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা থেকে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বার্লিনে অনুষ্ঠেয় শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য ইউরোপে রওয়ানা হন। প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন খোন্দকার মোহম্মদ ইলিয়াস।...কিন্তু তাঁরা লন্ডনে থাকাকালেই পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় ও ৯২-ক ধারা জারি করে। মওলানা ভাসানীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। হুমকি দেওয়া হয়, তিনি দেশে ফিরলে তাঁকে বিমানবন্দরেই গুলি করে মারা হবে।’ এই হুমকির ঘটনাই মওলানা সম্পর্কে ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের সাংবাদিক মহলে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে। এই আগ্রহ থেকেই তাঁরা পাকিস্তানের তখনকার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিদেশে থাকাকালে এ সময় তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যে বক্তব্য দেন, তার ভেতর দিয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন-দর্শন ও তাঁর নিজস্ব বিশ্ববীক্ষা। লন্ডনের একটি পত্রিকা এ সময়ই ভাসানীকে ‘ফায়ার ইটার মওলানা’ বলে অভিহিত করে। বইয়ে তা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে।

বইটি পড়ার পর আমরা জানতে পারি, মওলানা ভাসানী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের শেষ পর্যন্ত বার্লিন শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এর নেপথ্যে ছিল লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের অনমনীয় অসহযোগিতা। তাই ভাসানী ও তাঁর সফরসঙ্গীরা ইউরোপে দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকা পড়তে বাধ্য হন। কিন্তু ভাসানীর দলটি ছিল অদম্য। তাঁরা নিশ্চুপ, নির্বিকার হয়ে বসে থাকেননি। আটকা পড়ার এই সময়েই তাঁরা মতবিনিময় করেন প্রবাসী বাঙালি এবং পাশ্চাত্যের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও অন্য শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে। তাঁদের কাছে তুলে ধরেন স্বদেশের চলমান রাজনীতির চালচিত্র। আলোচনা হয় বিশ্বপরিস্থিতি নিয়েও। জোরালো বক্তব্য দেন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। এসব আলোচনায় মওলানা ভাসানীই মুখ্য হয়ে ওঠেন। এ বইয়ে আছে তার সমূল বিবরণ।

বলা ভালো, ভাসানী ও তাঁর সফরসঙ্গীরা বার্লিন শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও পরে বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত অন্য একটি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে কত যে বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, এ বইয়ে আছে তারও প্রায় বিস্তারিত বিবরণ। তাঁদের মধ্যে আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ভক্ত এবং তুরস্কের মাটি থেকে বিতাড়িত আরেক কবি নাজিক হিকমত আর চিলির তখনই বিশ্বখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা।

ইউরোপের মাটিতে অবস্থান করে ভাসানী শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে আটকা পড়ে থাকেননি, দেশ, দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিসম্পৃক্ত ঘটনাবলিও তাঁকে সমভাবে আলোড়িত করেছে প্রতি মুহূর্তে। দেশ থেকে নানা সূত্রে দেশের চলমান রাজনীতির খবর পাচ্ছেন। সেসব তাঁকে বিদ্ধ করছে তিরের ফলার মতো। যোগাযোগ হচ্ছে জুরিখে অবস্থানকারী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকার ব্যাপারে মওলানার মনোভাব নেতিবাচক। খবর পাচ্ছেন দেশের ভেতরে শেখ মুজিবকে অমানুষিকভাবে প্রহার করা হয়েছে। তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

ভাসানী যখন ইউরোপে বইতে এমন কিছু সত্য উচ্চারিত হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে এমন কিছু তথ্য, যার ফলে পাকিস্তানের সামরিক সরকার দু-দুবার গ্রন্থটিকে বাজেয়াপ্ত করেছিল—একবার ১৯৫৮, আরেকবার ১৯৬৫ সালে। বইয়ের লেখক খোন্দকার ইলিয়াসের বিরুদ্ধেও দায়ের করা হয়েছিল মামলা, জারি করা হয়েছিল হুলিয়া। এ সবই আজ ইতিহাস।

স্মৃতিকথা আর উপন্যাসের ভঙ্গিতে লেখা এই বই এ দেশের একটি নির্দিষ্ট সময়ের দলিল। এক দুরূহ রাজনৈতিক সংকটকালের নিবিড় চালচিত্র। রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে ভাবিত প্রত্যেকেরই এটি পড়া আবশ্যক। 

 ভাসানী যখন ইউরোপে

খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস

 প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশ কাল: নভেম্বর ২০১৭, ২৭২ পৃষ্ঠা, দাম: ৫০০ টাকা।