মিনিমাগনার চুমকুড়ি

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

এ শিরোনামে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের একটা গল্প আছে। এ লেখা সেই গল্পকে নিয়ে নয়। বরং একটা যোগ্য শিরোনামের অভাব পূরণ করতেই তাঁর শরণাপন্ন হওয়া। আমাদের প্রাত্যহিক যৌথ জীবনযাপনে মিনিমাগনায় কত কিছুই না হয়! বন্ধুত্বের বন্ধন, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক কোনো লেনদেনের মুখাপেক্ষী নয়, অন্তত হওয়ার কথা নয়; ব্যতিক্রম ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপার একই। কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে? যেখানে এক দিকে লেখক নিজে, অপর দিকে যাঁরা তাঁর লেখা ছাপেন? সশ্রম কারাদণ্ডভোগীর মতো লেখক লিখে যাবেন আর পত্রিকাওয়ালা ও প্রকাশকেরা তা ছেপে স্রেফ চুমকুড়ির বিনিময়ে তাঁর শ্রম সার্থক করবেন—এ ধারণা বহু যুগ ধরে পৃথিবীতে অচলগণ্য হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

 পত্রিকাওয়ালারা সব লেখককে সম্মানী দেন না, প্রকাশকেরা বই ছেপে লেখকের পাওনা মেটাতে যারপরনাই কুণ্ঠিত—এ মোটেও বিচ্ছিন্ন অভিযোগ নয়। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় শতভাগ সত্য, অন্তত আমাদের প্রেক্ষাপটে। যতদূর জানি, বাঙালি লেখকদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু লেখালেখি-জীবনের সেই গোড়ার দিকেই এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল লেখার বিনিময়ে লেখককে সম্মানী দেওয়ার একটা রেওয়াজ গড়ে উঠুক, তা যত ছোট অঙ্কেরই হোক। যে কারণে প্রতিষ্ঠিত পত্র-পত্রিকা তো বটেই, লিটল ম্যাগাজিনকেও তিনি এর আওতায় রেখেছিলেন। একবারের ঘটনা। মফস্বল থেকে লিটলম্যাগ সম্পাদক কবিতা চাইতে এসেছেন বুদ্ধদেবের কাছে। তিনি তাঁকে হতাশ করেননি, কথা দিলেন লেখা দেবেন, কবে দেবেন তা–ও। স্বাভাবিক কারণেই তরুণ সম্পাদক মহা-উত্তেজিত। বেচারির উত্তেজনায় পানি ঢালতে নয়, বরং কাজের কথাটা মনে করিয়ে দিতে বুদ্ধদেব জানালেন লেখার বিনিময়ে তিনি সম্মানী নিয়ে থাকেন, লেখা পাওয়ার পর সম্পাদক যেন তাঁর ঠিকানায় ১০ টাকা মানি-অর্ডারে পাঠিয়ে দেন। আমাদের এখানে কবি জসীমউদ্‌দীন ও কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান নিজেদের লেখালেখির যথাযথ সম্মানী ও রয়্যালটির বিষয়ে বরাবর জোর গলায় কথা বলতেন। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা জানি। প্রকাশকের দপ্তরের সামনে লোক জড়ো করে তুমুল হাঙ্গামা বাধিয়ে নিজের প্রাপ্য আদায় করে ছেড়েছিলেন।

কিন্তু রেওয়াজ যে গড়ে ওঠেনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শোনা যায়, শিবরাম চক্রবর্তীর মতো বিপুল পাঠকপ্রিয় লেখকও তাঁর খ্যাতনামা প্রকাশকদের হাতে চরম বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। কলকাতার সাম্প্রতিক খবর জানা নেই, তবে ঢাকার খবরের জন্য কোনো প্রযুক্তি খাটানোর দরকার পড়ে না।

 এর পেছনে কারণ অনেক। একটা অন্যতম কারণ লেখক নিজে। অনেক লেখক, বিশেষত তরুণ লেখকেরা নিজের টাকায় বই ছাপেন। এই সেলফ পাবলিশিং ব্যাপারটা পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায়ই রয়েছে, তবে আমাদের এখানকার মতো প্রকাশকের হাতে আত্মমর্যাদা, বিবেকবুদ্ধির পুরোটা সঁপে দিয়ে নয়। এর পাশাপাশি অন্য যে বড় শ্রেণিটা রয়েছে, তারা ধরেই নেয় প্রকাশক যখন বই ছাপতে রাজি, চাওয়ার আর কী থাকতে পারে! এই দুই ধারার ফলে যে প্রবণতার তৈরি হয়েছে তার শিকার অন্যরা, যাঁরা প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিনামায় সইসাবুদ করেও প্রাপ্য রয়্যালটি পান না, পেলেও ঠিকমতো পান না। ব্যতিক্রম আছে, তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হয়, খানিকটা হইচইও, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ব্যস, ওই পর্যন্ত। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম—শেষমেশ তো প্রকাশকই ভরসা, বই বের করাটা যে জরুরি। তার মানে লেখকদের হীনম্মন্যতা এ জন্য দায়ী। তবে হ্যাঁ, বিশেষ কোনো প্রয়োজনে আপনি একটা বই বিনা সম্মানীতে ছাপতে দিতেই পারেন। সে অন্য প্রসঙ্গ।

এ গেল এক দিক। অন্য যে দিকটা রয়েছে তা হলো—মিনিমাগনায় লেখা কি উচিত? এর কাটকাট জবাব হতে পারে, উচিত মনে না করলে লিখবেন না, কেউ তো জোর খাটাচ্ছে না! কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এত সোজাসাপটা প্রত্যাঘাত যেমন প্রত্যাশিত নয়, তেমনি এর মাধ্যমে কোনো ফয়সালাও হয় না। মূল বিষয়টাকে এভাবে দেখা যেতে পারে: লেখক যখন লিখতে বসেন, নিজের তাড়নায়ই তিনি কাজটা করেন, আর পরে যখন পত্র-পত্রিকার সম্পাদক বা প্রকাশক তা ছাপেন, তখন এর সঙ্গে পণ্যমূল্য যুক্ত হয়ে যায়। ফলে দায়িত্বটা তখন দ্বিতীয় পক্ষের ওপরই বর্তায়। সহজ-সরল চিত্র। ভুল বোঝার বা ইচ্ছাকৃতভাবে একে জটিল করে তোলার কোনো সুযোগ নেই।

এখানে প্রকাশক বা পত্রিকা সম্পাদক যে প্রশ্নটা তুলতেই পারেন, তা এই: আমরা কি সব লেখকের লেখা চেয়ে এনে ছাপি? কত লেখা বা বই-ই তো অযাচিতভাবে আমাদের হাতে আসে। লেখকের অনুরোধ-উপরোধ বা গুরুত্বপূর্ণ কারও সুপারিশে (?) সেসব ছাপতে হয়। বক্তব্যটি অনেকাংশে সত্য হলেও, এর দায় পুরোপুরি লেখকের এ কথা বলার অকাট্য যুক্তি নেই। এ জন্য যে এ জাতীয় বইয়ের মধ্যে কিছু বই তো উন্নত মানের, এমনকি অসামান্যও হতে পারে, যে কারণে পাঠক-আদৃত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনেও সক্ষম। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, প্রয়াত শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বইটি যে প্রকাশনী থেকে প্রথম বের হয়েছিল তা লেখকের নিজ উদ্যোগ ও তাগাদায়ই হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের মাইলফলক এ ঔপন্যাসিকাটির জন্য আমার জানামতে শহীদ কানাকড়িও পাননি। যে কথাটা বলতে চাচ্ছি, বই প্রকাশে লেখক উদ্যোগী হলেও বইটা যদি ভালো হয় এবং কিছুটা হলেও পাঠকপ্রিয়তা পায় তাহলে লেখককে অবশ্যই তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া প্রকাশকের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব। উন্নত দেশে সেলফ পাবলিশিংয়ের ক্ষেত্রেও লেখক-প্রকাশকের যে চুক্তি হয় তাতে এ রকম শর্ত থাকে, আর তা মেনে চলা ব্যবসায়িক রীতিনীতির মধ্যেই পড়ে। মাগনা লেখাকে কীভাবে দেখেন? হেমিংওয়েকে একবার এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘লেখক নিজে উদ্যোগী হয়ে সম্মানী-পারিশ্রমিক ছাড়াই লেখা ছাপতে দিতে পারেন, কিন্তু আপনি যদি সম্পাদক বা প্রকাশক হোন, আর উন্নত মানের লেখা আশা করেন তাহলে টাকার ব্যাপারটা গোড়াতেই মাথায় রাখতে হবে। না হলে, যা পাবেন তা হতে পারে ভালো লেখকের লেখা, কিন্তু গুণে-মানে সাধারণ। বিনা পয়সায় আমি এককালে বিস্তর বাজে লেখা ছেপেছি।’

ইদানীং লেখকেরা বিস্তর লেখা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা নিজস্ব ব্লগে লিখে থাকেন। সম্মানী-পারিশ্রমিকের প্রশ্নই ওঠে না। কে দেবে সম্মানী! আর বাস্তবতা তো এই, ডিজিটাল এ যুগে যদি এত এত লেখার সঙ্গে অর্থযোগ থাকত, তাহলে অন্তর্জালের ঝুলি সমৃদ্ধ হওয়ার বদলে অনেকটাই বিরান পড়ে থাকত। তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে, লেখক স্বেচ্ছায়ই শুধু নয়, উৎসাহী হয়েও বিনা মূল্যে নিজের লেখা প্রকাশ করছেন। আটলান্টিক ম্যাগাজিন–এ মারিয়া পাপোভা এক নিবন্ধে এ নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ ওয়েবসাইট বিনা সম্মানীতে লেখা ছেপে কী প্রকাশনা জগতে পেশাদারি লেখকদের আনাগোনা বন্ধ করে দিচ্ছে, নাকি মিনিমাগনায় লিখতে আগ্রহী সব ধরনের লেখকদের জন্য দরজা খুলে দিচ্ছে? বলা নিষ্প্রয়োজন, দুটোই সত্য। সেই সঙ্গে এ-ও সত্য যে অনেক ওয়েবপেজ ও অনলাইন পত্রিকা তাদের লেখকদের সম্মানী দিয়ে থাকে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের এখানে দুই-একটা অনলাইন পত্রিকা সব লেখকের ক্ষেত্রে না হলেও এ রীতি মেনে চলে।

 লেখাটা শুরু করেছিলাম কাগজে মুদ্রিত লেখালেখি বা বই নিয়ে। সেখানেই ফিরে আসি। অনেকেই এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। একজন এমনও বলছেন, বিনা সম্মানীতে যাঁরা লিখে থাকেন তাঁরা নিজেদের আত্মমর্যাদাই বিসর্জন দেন না, উপরন্তু বেগার খাটার অনুকূলে একধরনের শ্রেণি-পক্ষপাতও তৈরি করেন, যা চরম অনাকাক্ষিত। বলার ধরন কঠোর হলেও এ বক্তব্যের যথার্থতা অস্বীকারের উপায় নেই। প্রকাশনা কোনো শৌখিন কাজ নয়, উৎপাদনব্যবস্থার সব কয়েকটা উপাদানই এখানে বর্তমান, আর যেহেতু এটা প্রথমত ও শেষতক নিখাদ ব্যবসা, এর মূল জোগান বা কাঁচামাল আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসবে তা হতে পারে না।