'আমার ছবিই আমার অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ'

‘ডালিম’, শিল্পী: আফ্রিদা তানজিম
‘ডালিম’, শিল্পী: আফ্রিদা তানজিম

আফ্রিদা তানজিম—মেয়েটি সবার কাছে পরিচিত ছিল মাহি নামে—তাঁকে, মানে চিনতাম মেলা আগে থেকে। গুলশানকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রদর্শনীতে দেখতাম, সম্ভবত আরেক চিত্রশিল্পী সোহান বা অন৵ কারও সঙ্গে। আফ্রিদার সঙ্গে থাকত বলে তাদের ধূসর দেখাত, এতই উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। একবার ইমরুল হাসান, রক মনু, আনিকা শাহ, ইমরান ফিরদাউস এবং আরও কেউ কেউসহ (আজকে আর স্পষ্ট মনে নেই) ঠিক হলো, গুলশান এক আর দুইয়ের মাঝে একটা প্রদর্শনী চলছে, ওটা দেখতে যাব। সেখানে রহিমা আফরোজ মুন্নী—মুন্নী আপার সঙ্গে দেখা। তিনি কবি। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিলেন আফ্রিদার সঙ্গে। আফ্রিদা মুন্নী আপার মেয়ে। তো, গুলশানের ওই প্রদর্শনীতে তাঁর ছবিও ছিল। কী ছবি আজ আর তা মনে করতে পারব না। আর ভিড় ছিল বলে দেখাও হয়নি মনোযোগ দিয়ে। সেই প্রথম তাঁর কাজ দেখা। আক্ষরিকভাবে। পরে ভালো করে দেখি ‘বাছ-বিচার’ সাইটে। সেটা ছিল অনলাইনভিত্তক প্রদর্শনী। আর বলাই বাহুল্য, অন্য রকম ছিল সেই অভিজ্ঞতা। জানতাম, আফ্রিদা তখন পড়ছেন ইংরেজিমাধ্যমে, ও লেভেল সম্ভবত। ইংরেজিমাধ্যমে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের দূর থেকে দেখে যেভাবে জানতাম, গড়পড়তা, কিন্তু আফ্রিদার ছবি আমার ধারণাই পাল্টে দিল। ওটাকে তাঁর কাজের প্রথম প্রদর্শনী হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। ১২ জানুযারি কলাকেন্দ্রে শুরু হয়েছে আফ্রিদা তানজিমের দ্বিতীয় প্রদর্শনী। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের কিউরেশনে। সেই প্রদর্শনী দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে এ লেখা।

 দুই

‘মাই আর্ট ইজ দ্য অনলি প্রুফ অব মাই এক্সিসটেন্স’—কলাকেন্দ্রে চলমান আফ্রিদার প্রদর্শনীতে তাঁর বক্তব্যের একটি মাত্র লাইন এটা। কিন্তু লাইনটা পড়লেই বোঝা যায় শিল্পী নিজে কতটুক ওতপ্রোত তাঁর ছবিতে। ফলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি লিখতে পারেন, ‘আমার ছবিই আমার অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ।’ আফ্রিদার ছবিতে কোথাও একটুও ভান নেই। যেন তাঁর সবটাই উৎসারিত তাঁর প্রতিটি কাজে। বিশেষ করে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিগুলোতে। একজন আফ্রিদা এখানে নানাভাবে উপস্থাপিত। যেমন বিষয়ে, তেমনি মাধ্যমের ট্রিটমেন্টে। কোথাও কোলাজ, কোথাও অয়েল প্যাস্টেল, চারকোল, অ্যাক্রিলিকে। কোথাও এতটুকু স্থির নন তিনি, খুব অস্থির। এই অস্থিরতা মাধ্যমগত ট্রিটমেন্টে এত প্রকট, অন্তস্থ আফ্রিদাকে যেন ধরে রাখতে পারছে না, বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসছে। তাই কাগজ ছিঁড়ে গেছে কোথাও কোথাও। টেক্সট হাজির হয়েছে। পুরো ক্যানভ্যাসে প্রতিধ্বনিত সেই টেক্সট তথাকথিত ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে মুখ যেন। আফ্রিদার এত ক্ষোভ-রাগ কিসের প্রতি? করপোরেট সংস্কৃতি, তথাকথিত যান্ত্রিকতা, আশপাশের খুন-ধর্ষণ বা এ-জাতীয় অসহনীয় বাস্তবতার প্রতি? এর প্রতিফলন আছে বটে, কিন্তু শিল্পী যেন আরও নিজের কাছে যেতে চান, আরও কাছে। সেটি কি জীবনানন্দ দাশ কথিত ‘বিপন্ন বিস্ময়’? হয়তোবা। না-ও হতে পারে। তবে আফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতি যখন অসংখ্য রঙের ডট-স্ট্রোকে আকার পায়, অথবা ক্ষত-রক্তাক্ত, কোথাও কোথাও চোখের মণি ব্লার, চোখের নিচে আরও একটি চোখ, আরও ঝাপসা, তখন খুব স্বাভাবিক আমরা অস্বাভাবিকভাবেই বিহ্বল হয়ে পড়ি। আক্রান্ত হই। মনে হয়, শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতির নাকে লেগে থাকা রক্ত আমাদের ধবধবে সাদা কাপড়ে বুঝি লেপটে গেছে! আমরা মুছতে চাচ্ছি সেই দাগ, অন্তত লুকাতে, যেন আর কেউ না দেখে, আমাদের তো পালিয়ে বাঁচতে হবে। না?

আত্মপ্রতিকৃতি
আত্মপ্রতিকৃতি

 

তিন

আফ্রিদা তানজিম নামের আফ্রিদা অংশটুকুর ‘আ’ বাদ দিলে পাই ফ্রিদাকে। ফ্রিদা মানে মেহিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর কথা বলছি। ফ্রিদা কি আফ্রিদার প্রিয় শিল্পী? নিশ্চিত নই, হওয়ার সুযোগও নেই আর। কিন্তু আফ্রিদা যখন ম্যানিপুলেশনের আশ্রয় নিয়ে ফ্রিদা কাহলোর বিখ্যাত পেইন্টিং ‘টু ফ্রিদাস’-এর একজন হয়ে পড়েন, আফ্রিদা আর ফ্রিদা দুজনেরই মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। এটি কি একজন নারীর সঙ্গে আরেকজন নারীর সাফরিংসের চিরায়ত যোগাযোগ? ঋতুচক্র নিয়ে আফ্রিদার আঁকা অন্য একটি ছবি কি এখানে সূত্র হিসেবে আসতে পারে? নিশ্চিত নই আমরা। এই অনিশ্চয়তাই ভালো। এতে আফ্রিদার ছবিকে দেখার অনেকগুলো জানালা উদার হবে আমাদের সামনে। তাঁর ছবিতে ফ্রিদার সঙ্গে সঙ্গে মুঙ্কের ‘স্ক্রিম’ও যুক্ত হয়েছে, কোলাজে। এসেছে রিকশা পেইন্টিংয়ের ভাষার আদলে হাতি-সিংহ ইত্যাদির গানের আসরের ছবিও বা করপোরেট কালচারের অংশত। বিভিন্ন প্রাণী টেবিলে বসে আছে। জন্তুর মাথা অথচ মানুষের দেহ নিয়ে। স্যুট-টাই পরে। এই যে রিকশা পেইন্টিংয়ের ভাষাকে ছবিতে নেওয়া অথবা একদম আন-অর্থোডক্সভাবে ভাঙা ডালিমকে স্তনের মতো করে কোলাজ, দুই ভ্রুর মাঝে কেটে নেওয়া মুখের প্রতিস্থাপন বা কেটে বসানো হাতের আঙুলের অংশত—এগুলো আমাদের ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি করে। এটাই আফ্রিদার শক্তি। তাঁর এই শক্তি আমাদের অস্বস্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলুক। নড়ে বসি যেন, অন্তত কিছুটা। যাতে অন্য আফ্রিদারা পৃথিবী আলো-হাওয়ার শরিক রয়ে যায়।

সব শেষে দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে যাওয়া আফ্রিদাকে ভালোবাসা। সবাইকে তাঁর প্রদর্শনীটি দেখার আমন্ত্রণ। ২৭ তারিখ পর্যন্ত এটা চলবে কলাকেন্দ্রে।