নানা রণেশ দাশগুপ্তর মালা

রণেশ দাশগুপ্ত (১৫ জানুয়ারি ১৯১২—৪ নভেম্বর ১৯৯৭)
রণেশ দাশগুপ্ত (১৫ জানুয়ারি ১৯১২—৪ নভেম্বর ১৯৯৭)

রণেশ দাশগুপ্ত নামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর প্রথম পড়েছিলাম তাঁর চারটি প্রবন্ধের ছোট্ট এক সংকলন শিল্পীর স্বাধীনতা প্রশ্নে। সংকলনটি ছিল পাঠ্যতালিকাভুক্ত। শিল্পীর যে স্বাধীনতা থাকতে হয়—লেখার ক্ষেত্রে, চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে—বিষয়টি সম্ভবত প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জানার সুযোগ ঘটে প্রবন্ধগুলো পড়ে। শিল্পীর স্বাধীনতা যে ‘ধনিকতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্রী’ রাষ্ট্রকাঠামোয় দুই রকমের হতে পারে, দুই মতবাদে শিল্পীর স্বাধীনতা বা শিল্পীর সংকট ভিন্নতর হতে পারে, সংকট থেকে উত্তরণের পথও আলাদা আলাদা হয়, সেই ধারণাও আমার ছিল না। এই বইয়ের পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে তাঁর উপন্যাসের শিল্পরূপ পড়েও মনে হয়েছে এগুলো সাহিত্যের কোনো অধ্যাপক, তাত্ত্বিক বা বিশ্লেষকের লেখা। তবে আলো দিয়ে আলো জ্বালা, আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ, সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ: একালের উপমহাদেশ অগ্নি-আখরে, রহমানের মা ও অন্যান্য এবং তাঁর অনূদিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর কবিতার বই পাঠে তাঁর প্রতিভার বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
তাঁর পেশা ছিল সাংবাদিকতা। লিখতেন বহু বিচিত্র বিষয়ে। সৃষ্টিশীল লেখায় যেমন নিবিষ্ট ছিলেন, তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বনিয়োজিত ছিলেন মননশীল রচনায়। অত্যন্ত নিভৃতচারী এবং ঋষিতুল্য মার্ক্সবাদী এই পণ্ডিত মানুষের মুক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও প্রগতিশীলতার সাধনা করেছেন।
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ দুই খণ্ডে তাঁর রচনাসমগ্র (২০১২ ও ২০১৪) প্রকাশ করেছে। অগ্রন্থিত রণেশ দাশগুপ্ত (২০১২) বের করেছে প্রকাশনা সংস্থা জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। পাঠকের জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর: রণেশ দাশগুপ্তর দুই ধরনের রচনাবলির পরও সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে তিন শতাধিক পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এক বই—যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা
রণেশ দাশগুপ্ত ক্রমাগত লিখেছেন দুই বাংলার বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্রিকায়। কিন্তু নিজে নিজের গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। প্রকাশক বা শুভানুধ্যায়ীরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেই তাঁর রচনাগুলো মলাটবন্দী হয়েছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত সযত্নে সংগ্রহে রেখেছিলেন রণেশ দাশগুপ্তর বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের লেখা। রণেশ দাশগুপ্তর কাছ থেকে সরাসরি বা লোকমারফত পেয়েছিলেন লেখাগুলো। সংগ্রহে রাখা সেই লেখাগুলো সম্প্রতি এক সমৃদ্ধ ভূমিকাসহ তিনি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন রণেশ দাশগুপ্তর এই বই।

বইয়ে রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু লেখা, যেগুলো অনেক আগেই গ্রন্থাকারে পাঠকের হাতে পৌঁছানো দরকার ছিল। সেই অপারগতা স্বীকারও করেছেন সম্পাদক মতিউর রহমান, ‘তিনি জীবিত থাকতে যদি এই কাজটি করতে পারতাম, বাংলাদেশের পাঠকের হাতে শিল্পসাহিত্যের এই বইটি তুলে দিতে পারতাম, তাহলে রণেশদা আনন্দিত হতেন। সেটা পারিনি বলে আমি গভীরভাবে ব্যথিত।’

কেবল এই স্বীকারোক্তির জন্য নয়, বইয়ের ভূমিকাটি নানা কারণে পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সব ধরনের পাঠকের জন্য ভূমিকাটি অবশ্যপাঠ্য। নাতিদীর্ঘ এই ভূমিকায় ব্যক্তি রণেশ দাশগুপ্তর জীবনযাপন, তাঁর চিন্তাচর্চার জগৎ, তাঁর পারিপার্শ্বিকতা, সেই সময়ের প্রগতিশীল তরুণদের ওপর তাঁর চিন্তার প্রভাবের ছোট ছোট চিত্র উঠে এসেছে। ব্যক্তি রণেশ দাশগুপ্তকে চেনার বেশ কিছু সূত্র পাওয়া যায় এই ভূমিকা থেকে। তাঁর জীবনযাপন প্রসঙ্গে মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘রণেশদা ঢাকার তাঁতীবাজারের এক বাসার দোতলার এক কোঠার ছোট্ট একটা ঘরে থাকতেন। ঘরে দাঁড়ানো যেত না। কেবল কোনো রকমে শুয়ে-বসে কাজ করতেন, ঘুমোতেন। কলকাতার লেনিন স্কুলেও একই ধরনের পরিবেশে থাকতেন। সেখানে ছিল একটিমাত্র চৌকি। তাতে বসেই করতেন পড়াশোনা, লেখালেখি থেকে শুরু করে সবকিছু।’

একুশের চেতনা আর স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। অথচ ১৯৭৫ সালে কলকাতায় গিয়ে আর ফিরলেন না। এ বিষয়ে মতিউর রহমান তুলে এনেছেন নতুন এক তথ্য, ‘এত দিন আমরা জানতাম, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কলকাতায় গিয়ে আর দেশে ফেরেননি।...কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাতের ভাষ্যমতে, রণেশদা ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শুরুতেই তাঁর এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে কলকাতায় যান। তারপর আর ফেরেননি।’ মতিউর রহমানের প্রশ্ন, ‘তাহলে কি তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন?’

যেসব শিল্পী-রাজনীতিক-সংস্কৃতিকর্মী-লেখক দেশ ও জাতিকে সারা জীবন অকাতরে দিয়ে গেছেন, সেসব মহৎ ব্যক্তির প্রতি মতিউর রহমান একধরনের টান অনুভব করেন। তার ফসল আমরা দেখেছি খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০ বইয়ের (২০১৫) ক্ষেত্রে। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আগলে রেখেছিলেন ১৯৫০ সালে খাপড়া ওয়ার্ডে আত্মাহুতি দেওয়া দেশপ্রেমিক রাজবন্দীদের তথ্য, নানা স্মৃতিকথা। একইভাবে শহীদ নূর হোসেনের বাবার সঙ্গে কথোপকথন আর স্মৃতিকথার ভিত্তিতে লিখেছেন বই (যৌথ) শহীদ নূর হোসেন। অত্যন্ত নিভৃতচারী সাংবাদিক-লেখক রণেশ দাশগুপ্তর প্রতিও রয়েছে তাঁর আন্তরিক টান; যা গুরুর প্রতি শিষ্যের ঋণ স্বীকারের মতো।

ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের বহুমুখী কর্মতৎতরতা ছিল। সেসবের নেপথ্যে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তাদের প্রকাশিত একুশের সংকলনগুলোর সুন্দর ও সময়োপযোগী নাম নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের যতগুলো একুশে সংকলন আমরা বের করেছিলাম, সেগুলোর পরিকল্পনায় তাঁর সাহায্য নিয়েছি। সেগুলো ছিল সেই সময়ের সেরা সংকলন। প্রায় প্রতি সংকলনেই তাঁর লেখা থাকত।...সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের এই সংকলনগুলোর নাম আমরা তাঁর কাছ থেকে নিতাম। কী সুন্দর সময়োপযোগী নাম ছিল সেগুলো! শুধু তা-ই নয়, তাতে যেন সমসাময়িক ভাবনাচিন্তা প্রতিফলিত হয়, সেদিকে খেয়াল করে তিনি নামগুলো দিতেন; যেমন প্রতিধ্বনি (১৯৬৪), বিক্ষোভ (১৯৬৫), ঝড়ের খেয়া (১৯৬৬), সূর্যজ্বালা (১৯৬৭), অরণি (১৯৬৮), নিনাদ (১৯৬৯)। তাঁর দেওয়া নাম আমরা একবাক্যে মেনে নিতাম।’

এই বইয়ের প্রায় তাঁর প্রতিটি লেখার মধ্যে নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সালে ‘একুশের একটি জরুরি কথা’ নামের এক প্রবন্ধে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে একটি চলচ্চিত্রের ধারণা দিয়ে গেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। চলচ্চিত্র প্রস্তাব-পরিকল্পনায় তিনি এমন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করার কথা বলছেন, যার বাস্তবায়ন ঘটলে সত্যিই এক অভাবনীয় কাজ হতো।

নতুন প্রকাশিত এই বইটির নাম রণেশ দাশগুপ্তর দেওয়া নয়, তাঁর একটি প্রবন্ধ থেকে বইয়ের নামটি দিয়েছেন মতিউর রহমান। রণেশ দাশগুপ্ত সারা জীবন যেসব বিষয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন, যেসব মানুষকে তিনি পছন্দ করতেন, যে ধরনের অনুবাদে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তার সব ধরনই এই বইয়ে রয়েছে। বইটিকে রণেশ দাশগুপ্তর সামগ্রিক প্রতিভা কিংবা তাঁর এযাবৎকালের প্রকাশিত নানা স্বাদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ-স্মৃতিকথা-অনুবাদের এক সম্মিলন বলা যেতে পারে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’, ‘কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী’, ‘রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘জেলখানার গল্প’, ‘অনুবাদ কবিতা’—এই আটটি অধ্যায়ে মূলত রণেশ দাশগুপ্তর চিন্তাচেতনার মৌলিকত্বই ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজের বিচিত্র প্রতিভাকে বলেছেন ‘নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা’। সেই বিবেচনায় যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা বইকে যদি রণেশ দাশগুপ্তর নানা ধরনের প্রবন্ধ-অনুবাদ নিয়ে গাঁথা একটা মালা বলা হয়, ভুল তো হবে না নিশ্চয়!

যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা

রণেশ দাশগুপ্ত

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: মতিউর রহমান

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৭

৩২৮ পৃষ্ঠা, দাম ৫৫০ টাকা।