তিনি মারা যেতে চেয়েছিলেন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ডাক্তার বললেন, ‘আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি চাচ্ছেনটা কী?’ ‘আমি মরতে চাচ্ছি, স্যার।’

‘মরতে চাচ্ছেন, মারা যান। আমার কাছে এসেছেন কেন?’

‘আপনি যদি দয়া করে একটা উপায় বাতলে দেন।’

‘কী আশ্চর্য! কেউ মারা যাওয়ার জন্য ডাক্তারের কাছে আসে, তা এই জীবনে প্রথম শুনলাম। মানসিক রোগী কি না, কে জানে? দেখুন! আমি মানুষ মারার ডাক্তার নই। মানুষ বাঁচানোর ডাক্তার।’

‘মানুষের মরা-বাঁচার সবকিছুই তো স্যার আল্লাহর হাতে। ডাক্তারের হাতে নয়।’

‘তাহলে যথাস্থানে যান।’

‘যথাস্থান বলতে আপনি কোন স্থানের কথা বলছেন, বুঝলাম না। আমি তো হাসপাতালেই এসেছি। হাসপাতাল কি যথাস্থান নয়?’

‘আপনি দেখছি কথাবার্তা ভালোই বলতে পারেন। করেনটা কী?’

‘কিছুই করি না।’

‘মারা যেতে চাওয়ার একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। বলুন, মারা যেতে চান কেন?’

‘থ্যাংকস স্যার! যার কাছেই যাই, কেউই এ কথাটা জানতে চান না। আপনিই প্রথম জানতে চাইলেন।’

‘উত্তরটা এখনো পেলাম না।’

‘সে অনেক কথা, স্যার।’

‘এক কথায় বলুন।’

‘বিন্নি, মানে আমার স্ত্রী, অন্য লোকের সঙ্গে ভেগে গেছে। ভেগে গেছে শব্দটা ঠিক হলো কি না জানি না।’

‘আপনি কি কবিতা লেখেন?’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘শব্দ-টব্দ নিয়ে আর কারও মাথাব্যথা হয় না। মানে, অন্যরা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। বেশি মাথা ঘামলে অবশ্য ওষুধ আছে।’

মাথা কি স্যার কখনো ঘামে? মানে, জ্বর-টর ছাড়া?’

‘কী বললেন?’

‘স্যার, বেয়াদবি না নিলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?’

‘কী?’

‘আপনিও কি কবিতা লেখেন?’

‘হোয়াট!’

‘কথাটা বলার আগে আমি বেয়াদবি না নিতে বলেছি।’

‘আপনার এমন ধারণা হলো কেন যে আমি কবি?’

‘কবি না হয়েও তো কবিতা লেখা যায়!’

‘একটা উদাহরণ দেন তো।’

‘উদাহরণ আমি নিজে।’

‘মানে?’

‘আমি কবি নই, কিন্তু আমি কাব্যচর্চা করি।’

‘সেটা আপনি করুন, আপনার ব্যাপার। আমাকে দলে টানছেন কেন? কী কারণে আপনার মনে হলো আমিও কবিতা লিখি?’

‘আপনি নতুন ধরনের শব্দ সৃষ্টি করলেন, তাই।’

‘নতুন শব্দ সৃষ্টি করলাম! কোথায়, কীভাবে করলাম?’

‘ওই যে শব্দের পাশে টব্দ আর জ্বরের পাশে টর। এ শব্দ দুটো অভিধানে পাওয়া যাবে না, স্যার। আপনি জামিল চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি শব্দগুলো অভিধানে তুলে দিতে পারেন।’

‘জামিল চৌধুরী কে?’

‘মস্ত বড় পণ্ডিত, স্যার। অভিধান লেখেন।’

‘অভিধান কেউ লেখে নাকি? অভিধান তো সংকলন করা হয় কিংবা সম্পাদন করা হয়। থাকগে! আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলুন।’

‘সে তো অন্যের কাছে চলে গেছে, স্যার!’

‘এক স্ত্রী চলে গেলে বিকল্প চিন্তা করতে পারেন। তাই বলে সুইসাইড করতে হবে কেন?’

‘সুইসাইডের বিষয়টা আমি ডিসাইড করে ফেলেছি। তবে নিজে নিজে করব না। আত্মহত্যা মহাপাপ। এমন একটা উপায় যদি পাওয়া যায় যে আত্মহত্যা করলাম না, আবার মারাও গেলাম।’

‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’

‘আপনি যদি একটা ইনজেকশন পুশ করে দেন, যেটা দ্রুত কার্যকর হয়, রোগীর কোনো কষ্ট হয় না।’

‘আপনি তো রোগী নন। আর মারা যেতে হলে কষ্ট তো করতেই হবে। তবে মৃত্যুর স্বাদ যে আসলে কী, তা আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারল না। মানুষের পক্ষে সেটা বলা সম্ভবও নয়।’

‘কেউ অর্ধেক মারা গিয়ে ফিরে এলে সেটা সম্ভব।’

‘অর্ধেক মারা যাওয়া আবার কী?’

‘মরতে মরতে আবার বেঁচে যাওয়া। মানে মৃত্যুর ঘর থেকে ফিরে আসা।’

‘এ রকম অ্যাবসার্ড বিষয়ে কথাবার্তা বলে কোনো লাভ নেই। আমরা মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।’

‘মূল প্রসঙ্গ তো আমার মৃত্যু।’

‘না। মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে আপনার বেঁচে ওঠা। আপনার স্ত্রী আপনাকে ত্যাগ করলেই আপনি মৃত্যুচিন্তা করবেন, এটা ঠিক নয়।’

‘মৃত্যুচিন্তা নয়, স্যার! একবারে সরাসরি মৃত্যু।’

‘আমি এ বিষয়ের ঘোর বিরোধী। এই সামান্য কারণে...’

‘কারণটা সামান্য মনে হতে পারে। তবে এর মধ্যে চার অক্ষরের শব্দটা যদি ঢুকে না পড়ত!’

‘চার অক্ষরের শব্দ মানে?’

‘ভালোবাসা।’

‘এর মধ্যে ভালোবাসা এল কী করে?’

‘নতুন করে আসেনি, আগে থেকেই ছিল। আমি আমার স্ত্রীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।’

‘সেই জন্যই বুঝি প্রাণ দিতে চাচ্ছেন?’

‘এক্সাক্টলি। আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন, স্যার! আমার ভালোবাসা কেবল মুখের কথা নয়। আমি সত্যি সত্যি তার জন্য প্রাণ দিতে পারি।’

‘তাকে পাওয়ার জন্য, নাকি তাকে হারানোর জন্য?’

‘পাওয়ার আর কোনো আশা নেই। হারানোর কথা বলতে পারেন।’

‘কিন্তু যে আপনার ভালোবাসার দাম দিল না তার জন্য দুঃখ করে লাভ কী?’

‘ভালোবাসা তো লাভ-ক্ষতির চিন্তা করে না, স্যার!’

‘উনি যে আপনার সঙ্গে বিট্রে করেছেন, সে কথা তো সত্য?’

‘বিট্রে করেছে কি না, কী করে বলি?’

‘উনি আপনাকে ছেড়ে চলে গেলেন কেন?’

‘ছেড়ে যাওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।’

‘মানে?’

‘যার সঙ্গে আমার স্ত্রী ঘর ছেড়েছে, সে খুবই বিত্তবান মানুষ। অঢেল টাকাপয়সা। দেখতেও রাজপুত্রের মতো। মেয়েরা তো রূপবান পুরুষই পছন্দ করে, তাই নয় কি স্যার?’

‘হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে।’

‘অন্যদিকে আমাকে দেখুন, আমি দেখতে মোটেই সুন্দর নই। চলনসই চেহারা। আর টাকাপয়সা তো দূরের কথা, একটা চাকরি পর্যন্ত আমার নেই। স্ত্রীকে কেবল একটা জিনিসই দিতে পারতাম—ভালোবাসা। আজকাল ওটা কে চায়?’

‘আপনার জীবনে যা ঘটেছে, তার জন্য আপনি তাকে দায়ী করেন না?’

‘দায়ী আমি নিজে। নিজের দায় স্বীকার করেই তো সিদ্ধান্ত নিলাম, এ জীবন আর রাখব না।’

‘খুবই কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত।’

‘আমি মহাপুরুষ নই, কাপুরুষ হলে কী-ই বা আসে-যায়?’

‘অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে আপনি আপনার স্ত্রীকে কোনো দোষ দিতে পারছেন না।’

‘দোষ দিতে চাচ্ছি না। আসলে তার কোনো দোষ নেই। একজন মানুষ নিজের অবস্থান বিবেচনা না করে যে কাউকে ভালোবাসতে পারে। ভালোবাসা তো কোনো নিয়ম মানে না।’

‘তাই বলে নিজের স্বামীকে ফেলে অন্য একজনের কাছে চলে যাওয়া? এটা জাস্টিফাই করেন কী করে? এটা একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।’

‘লুকিয়ে যায়নি, স্যার। লুকিয়ে গেলে বিশ্বাসঘাতকতা বলা যেত। এটা তেমন কেস নয়।’

‘আপনি একজন অদ্ভুত মানুষ! আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে অন্যজনের কাছে চলে গেছেন। তার বিরহে আপনি আত্মঘাতী হতে চাইছেন, অথচ আপনি তাঁর কোনো দোষ দেখছেন না।’

‘সে কোনো দোষ করলে তো দোষ দেখব!’

‘আশ্চর্য!’

‘কিছুই আশ্চর্য নয়, স্যার! তার প্লাস পয়েন্টগুলো একবার দেখুন। সে সুন্দরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, চমৎকার কথাবার্তা বলতে পারে, তাই স্বভাবতই সে উচ্চাভিলাষী। পাশাপাশি আমার মাইনাস পয়েন্টগুলো কি বলব?’

‘প্রয়োজন নেই। আগেই তো সেসব কথা বলেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই।’

‘আমিও বাড়তি কথা বলতে চাই না। আপনি শুধু আমার একটা উপায় বাতলে দেন। কীভাবে আমি মারা যেতে পারি। মারা যাওয়ার শর্টকাট কোনো পথ।’

‘এ বিষয়ে শর্টকাট কোনো পথ আমার জানা নেই। তবে একটা পরামর্শ আমি আপনাকে দিতে পারি।’

‘বলুন।’

‘আপনি ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়া চলে যান।’

‘তেঁতুলিয়ায় কী আছে, স্যার?’

‘এ বিষয়ে আপনি আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। আমি অবশ্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াই বলতাম। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।’

‘আপনার কথাবার্তা খুবই রহস্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। আমি এসেছিলাম মারা যাওয়ার একটা প্রকৃষ্ট পন্থার খোঁজে। আপনি আমাকে তেঁতুলিয়ার পথ দেখাচ্ছেন।’

‘আমি এ বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না। আপনি এখন যেতে পারেন।’

‘যাচ্ছি, স্যার। তবে আপনি যখন বলেছেন তেঁতুলিয়া যেতে। আমি তেঁতুলিয়া যাব। কিন্তু কার কাছে যাব, কার সঙ্গে দেখা করব, সেসব কিছুই বলছেন না। মনে হচ্ছে তেঁতুলিয়া গেলেই আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়ে যাবে। আরেকটা কথা স্যার...’

‘আর কোনো কথা নয়। আপনি আসুন।’

‘অন্য বিষয়ে, স্যার।’

‘আপনি যান তো!’

‘আপনার ভিজিট। মানে আপনার ভিজিটের টাকাটা...’

‘আমি আপনাকে কোনো ব্যবস্থাপত্র লিখে দিইনি। সুতরাং আমাকে কোনো ভিজিট দিতে হবে না।’ ‘আচ্ছা, আপনার নাম নিশ্চয়ই ইফতেখার উদ্দীন খান।’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘আপনার হাতে যে ব্যাগটা আছে, তাতে লেখা আছে।’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই ব্যাগে আমার স্ত্রীর চিঠিপত্রগুলো রাখা আছে, বিয়ের আগে সে আমাকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিল। বিয়ের পর কিন্তু একটা চিঠিও লেখেনি।’

‘এসব আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাকে জানিয়ে লাভ কী? আপনি এখন যান।’

‘যাচ্ছি, স্যার। তেঁতুলিয়া! আজই যাব। আসসালামু আলাইকুম।’

কথোপকথন এখানেই শেষ। পরদিন ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়াগামী বাস দুর্ঘটনার একটি সচিত্র খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হলো। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মোট তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের পরিচয় জানা গেছে। সেই একজন নিহত ব্যক্তির নাম ইফতেখার উদ্দীন খান।