অগ্রন্থিত একগুচ্ছ পুরাতন পত্র

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে
১৮৯২
শ্রদ্ধাস্পদেষু
তিনখানি কৃষ্ণচরিত্র পাঠাইলাম। অনুগ্রহপূর্বক আপনি একখানি গ্রহণ করিবেন। জ্যোতিঃ ও রবিবাবু এখন কোথায় তাহা জানি না। এ কারণ তাঁহাদের জন্য দুইখানি পুস্তক আপনার নিকটেই পাঠাইলাম। অনুগ্রহ করিয়া তাঁহাদিগের কাছে পাঠাইয়া দিবেন। ভরসা করি আপনারা ভাল আছেন।
 ইতি তাং, ১০ই আগস্টশ্রী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি, উমাশশীকে
২৩৬ বৌবাজার স্ট্রিট, কলকাতা।
কল্যাণীয়াসু,

অত্যন্ত আবেগের মুখে তোমাকে পত্র লিখতে বসলাম। বেলা ৪ টে বাজে। এখনও কিছু খাই নাই। সমস্ত দিন উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে অবশেষে লিখতে বসলাম। জীবনে বোধকরি এমন দুর্দিন আমার আর আসে নাই। আজ নির্মমভাবে অপমানিত হয়েছি আমি। সমস্ত কথা লিখতে গেলে পত্র সুদীর্ঘ হবে খামে যাবে না। তাছাড়া কলমের মুখে সে কাহিনি লিখতেও লজ্জা হচ্ছে।

ভেবেছিলাম একথা কাউকে লিখব না—জানাব না—জীবনের এই দাম্ভিকতাপূর্ণ সাহিত্যিক ব্রতকে আজ হত্যা করব—মনে ভেবেছিলাম আজও পর্যন্ত যা লিখেছি যা আমার কাছে আছে সমস্তগুলোকে আগুনের মুখে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। আর জীবনে কলম ধরব না। তারপর এই তিনটের সময় স্নান করে অল্প শান্ত হয়ে তোমাকে পত্র লেখা স্থির করলাম। যদি তোমার কাছেও অপমানিত লাঞ্ছিত হই তাতেও আক্ষেপ থাকবে না। যেখানে বইয়ের দোকানদার অপমান করে সেখানে তুমিও যদি অপমান বা প্রত্যাখ্যান কর, তাতে এমন বেশি কি বোঝা বাড়বে।

আমার নতুন বইখানা নিয়ে বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম—সেখানেই এই ব্যাপার ঘটেছে। তারা একশো টাকা দিতে চেয়েছিল—বইখানার সমস্ত সত্ত্বের জন্য। আমি তাতে আপত্তি করে বলেছিলাম—সমস্ত সত্ত্ব কেন দেব? আর আপনারা অন্য কাউকে টাকা বেশি দেন। আর এটা তো আপনাদের—আমাদের জব্দ করে ঠকানো। কারণ আমরা যদি নিজে বই ছাপতাম তবে তো এইভাবে ঠকতাম না। বা আপনারা ঠকাতে সাহস করতেন না।—সে বললে কি জান? বললে, যদি পারেন তবে আমাদের কাছে আসেন কেন? আমি উঠে চলে এলাম—দোরের কাছ পর্যন্ত এসেছি—সে আমাকে শুনিয়েই বললে যত বেটা ভ্যাগাবন্ড (মানে ভিখারি) আসবে—এসে লম্বাই চওড়াই চাল মারবে। ছাপতে যদি নিজে পারিস তো ছাপ না দেখি! এখানে মরতে আসিস কেন? আমার সে সময় মনে হল আত্মহত্যা করি।...আর একবার আমি তোমার কাছে ভিক্ষে করছি। এই শেষবার। দু’শো টাকা তুমি আমাকে দাও।...না দাও-আমি রাগ করব না-অভিমান করব না। তবে এ জীবন-এ সাহিত্যিক জীবন শেষ করব।...
আঃ তারাশঙ্কর (১৯৩৪-৩৫ সাল)

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি, রাজনারায়ণ বসুকে
১৩ নভেম্বর ১৮৮৬
ওঁ
I stand reproved! সংসর্গজা দোষগুণা ভবন্তি। এ মুলুকে একজনও নিস্তারিখ লোক আজ পর্য্যন্ত অন্বেষণ করিয়া পাইলাম না—অজ্ঞাতসারে আমি তাহাদের দলভুক্ত হইয়া পড়িয়াছি,—আমি তারিখী হইলাম—ইহা স্মরণ করিলে আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়,—আমি একটা ভয়ানক Precipice এর উপর ছিলাম—আপনি ভাস্যে আমাকে বলিলেন তাই আমার চেতন হইল—নহিলে আমার কি দশা হইত বলিতে পারি না! ভারতীতে আমার দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদ দেখিয়াছেন কি?—তদ্বিষয়ে আপনার কলামের কতিপয় আঁচড় is what I am in need of। যোগীন এখন কি করিতেছেন—তাঁহাকে আমার আন্তরিক আশীর্বাদ দিবেন। আপনার ওখানে কয়জন ব্রাহ্ম? তাঁহারা কি দলীয় ব্রাহ্ম, না বিশুদ্ধ ব্রাহ্ম? যদি বিশুদ্ধ ব্রাহ্ম হ’ন তবে তাঁহাদিগকে আমার কোলাকুলি এবং নমস্কার দিবেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কি আমার পরিচিত? আপনি যদি আমাকে কোন-না-কোন একটা উপলক্ষে formally নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠান (উপলক্ষ একটা ছুতা মাত্র), তবে আমি gladly দেওঘরে আপনার Cheering atmosphere-এ ঝাঁপ দিই—নচেৎ আমার নিজের পয়সা খরচ করিয়া যাইতে হয়—Which is out of the question, as my purse contains only বিশুদ্ধ÷ space—Pure Kantian Space.
[দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর]

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র চিঠি, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে
Dr. Md. Shahidullah    University of Dacca
M. A., B. L. (Cal.) Dipl. Phon. (Paris)       P. o. Ramna, Bengal
Docteur de l Universite’ de Paris, Dated 26.9.1938.
জনাব সাহিত্যবিশারদ সাহেব,
তস্লীম অন্তে আরয। আপনার পত্র যথাসময়ে পাইয়াছিলাম। D. P. I. হইতে মন্তব্যের জন্য পুস্তক আমার নিকট আসিয়া থাকে। এই জন্য পূর্ব্বে আমার কোন মন্তব্য দেওয়া উচিত হইবে না। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন প্রভৃতির মন্তব্যসহ আপনি গবর্ণমেন্টের নিকট বৃত্তির জন্য দরখাস্ত করুন। স্থানীয় S. D. O. কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সুপারিশ থাকলে ভাল হয়। D. P. I. আমার নিকট মন্তব্য চাহিলে অনুকূল মত প্রকাশ করিতে কখনই কুণ্ঠিত হইব না।
|আলাওলের পদ্মাবতীর কথা মনে আছে। ইহা সম্পাদন শেষ করিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ছাপার বন্দোবস্ত করা কঠিন হইবে না। ইহাতে আপনার কিছু নজরানাও প্রাপ্তি ঘটিবে। কিন্তু আমি ঢাকায় ও আপনি চট্টগ্রামে। কাজেই কার্য্য কিরূপে হইবে স্থির করিতে হইবে। আমার মনে হয় আপনি পাঠান্তরসহ পাণ্ডুলিপি আমার নিকট পাঠাইলে, আমি পাঠ স্থির করিয়া Text প্রস্তুত করিতে পারি। অবশ্য আপনাকে একটী tentative text প্রস্তুত করিয়া পাদটীকায় পাঠান্তর দিতে হইবে। আলাদা একখানি পুঁথি আমাদের পুঁথিশালায় আপনাকে প্রদান করিতে হইবে। এইরূপ নিয়ম আছে। নচেৎ পুস্তক বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত হয় না। আপনার নিকট আমি কিয়দংশ text পাঠাইয়াছিলাম তাহার পাদটীকা এ পর্যন্ত পাই নাই। আমার নিকট আপনি কিছু পাণ্ডুলিপি এবং একখানি পুঁথি আজ এ সম্বন্ধে আপনার মত জানিতে ইচ্ছা রাখি। আমি ২৮শে তারীখে ঢাকা ত্যাগ করিতে পুনরায় ১৮ই অক্টোবর ফিরিতে আশা রাখি। ভাল আছি। কুশল কামনা করি। ইতি
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

আবু সয়ীদ আইয়ুব
আবু সয়ীদ আইয়ুব

আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিঠি, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে
১৪, ওয়ালিউল্লা লেন
পোঃ পার্ক স্ট্রীট
১৩.০৫. ৪১
সুহৃদ্বরেষু
শুক্রবার সকাল ৯টায় আমার কোনো কাজ নেই, তবে অরবিন্দবাবুকে নিয়ে আসবেন কি না সেটা নির্ভর করে তার হাতে কতখানি সময় আছে তার উপর। নিশ্চয়ই তিনি জোর পড়াশোনা করছেন, এবং পরীক্ষার ফলাফল সম্বন্ধে নির্লিপ্ত নন। এদিকে আমি তো চার পাঁচ বছর লজিকের কোনো বই স্পর্শ করিনি, বছর দেড়েক ফিলসফিই পড়িনি। তার উপর আমার স্মরণশক্তি শোকাবহ। স্বীকার করছি তত্ত্বকথায় আমার উৎসাহ আছে, আর তর্কের চোটে বুদ্ধি মোটের উপর মন্দ খেলে না। তবে এটা কি কোনো কাজের কথা হল? অবশ্য কেউ যদি অখণ্ড অবসর হাতে নিয়ে মনের আনন্দে নিষ্কাম দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়, আমি তাতে যোগ দেবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। আমরা দু’জনই তাতে অল্পস্বল্প লাভবান হতেও পারি। কিন্তু আমার পড়াশোনার বর্তমান দুর্যোগে আমাকে সভয়ে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতেই হবে যদি কেউ ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর রেখে প্রশ্নোত্তরের দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে স্বর্ণ-রৌপ্য পদকের আশা মনে নিয়ে মোকাবিলায় আসেন। আর অরবিন্দবাবুর পক্ষে তাই কি স্বাভাবিক নয়, পরীক্ষার মোটে দু’মাস পূর্বে তাই কি উচিত নয়?
এটাও অবশ্য সম্ভব যে আমি দিন দশেকের মধ্যে লজিকের বইগুলোর উপর (আদালতের ভাষায় যাকে বলে) নজরে ছানি বুলিয়ে নিই, এবং অরবিন্দবাবুর সঙ্গে যেদিন যে বিষয়ে আলোচনা করব তার আগের দিন তার জন্য তৈরি হয়ে নিই। কিন্তু একে Professionalism আর আমি তো আপাতত amateur।
[আবু সয়ীদ] আইয়ুব

অন্নদাশঙ্কর রায়
অন্নদাশঙ্কর রায়

অন্নদাশঙ্কর রায়ের চিঠি, রাধারাণী দেবীকে
 বাঁকুড়া
১৩ই জুন ১৯৩১
প্রীতিভাজনাসু,
আমার পোষ্টকার্ডখানি আপনাদের হাতে পড়বে জানলে ওতে আরো কয়েকটি কথা সংযোজন করতুম।
বিবাহের দেশকালোত্তর আদর্শই হচ্ছে যোগ্যের সঙ্গে যোগ্যের যোজনা। সুতরাং আপনাদের বিবাহ, একটি সুদুর্ল্লভ সত্যিকারের বিবাহ।
বিবাহ রাত্রিটিতে বিবাহের শেষ নয় বিবাহের শুরু। অয়মারম্ভ, শুভায় ভবতু। সাহিত্যের দিক থেকে উভয়ের কাছ থেকে পূর্ণতর ও পরিণত-তর সৃষ্টির প্রত্যাশা রাখি। সমাজের দিক থেকে প্রেম-প্রজাত দিব্যসুন্দর সন্তানের প্রতীক্ষা করি।
লোকভয় যেন আপনাদের বিক্ষিপ্ত না করে। আমার একটি কবিতায় লিখেছি—অজানিত সমধর্ম্মা কত/দেশে দেশে আমাদেরি মতো/জীবন, মাতাল।/উহারাই মোদের সমাজ/মান যেন উহাদেরি মাঝ/লভি চিরকাল।
আমরা যেমন আনন্দের মধ্যে আচ্ছন্নের মতো বাস করছি, অনুমান করি আপনারাও তেমনি। বিরহটাকে বোধকরি আপনারা পূর্ব্ব হতেই উদ্যাপন করে চুকিয়ে দিয়েছেন। অতএব আর দুঃখ কিসের?
উদার হৃদয় স্নেহপ্রবণ সৎসাহসিক নরেন্দ্রবাবুকে আমার শ্রদ্ধা ও আপনাকে আমার নমষ্কার জানাই। “লীলাকমলের” সমালোচনায় যদি আপনার প্রতি কোনোরূপ অবিচার করে থাকি তবে সেটা মনে করে রাখবেন না। একটি প্রসঙ্গ তাতে উল্লেখ করতে ত্রুটি হয়েছে, সেটি আপনার ঋতুপ্রীতি। “লীলাকমলে”র অধিকাংশ দল বিকশিত হয়েছে প্রকৃতির নিয়মে। ইতি।
কুশলপ্রার্থী, শ্রীঅন্নদাশঙ্কর রায়
* আত্মীয়স্বজনের মনে কষ্ট দেবার দুঃখটা বিরহের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান পাবার যোগ্য নয়। সেইজন্যে এই ফুটনোটে ওর উল্লেখ। অর্থাভাব সম্বন্ধেও সেই কথা। এসব দুঃখকে ভুলে থাকা যায় না—এরা যে অনবরত হুল ফোটাতে থাকে। তবু এদের জ্বালা কিছুই নয় মিলনের মূল আনন্দটির স্নিগ্ধতার অনুপাতে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌

সৈয়দ ওয়ালউল্লাহ্‌র চিঠি, মাহমুদ শাহ কোরেশীকে
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্পা
কিস্তান দূতাবাস
১৮, রু লর্ড বায়রন
প্যারিস (৮)
পিএস ২/১০/৬১        ২ এপ্রিল, ১৯৬২
প্রিয় কোরেশী,
যান্ত্রিক অনুবাদের জন্য ইউনেস্কোর ফেলোশিপের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে টেলিফোনে যে আলাপচারিতা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে লিখছি।
২. আপনি যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুবিধামতো যদি আপনার জীবনবৃত্তান্ত পাঠান, তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব। পাকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটি চেয়ে পাঠিয়েছে।
আপনার একান্ত (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্)
 

সংকলক ও টীকাকার: ভূঁইয়া ইকবাল

এখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৯-১৮৯৪), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২), আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১)—সাহিত্যজগতের এই সাত কৃতী ব্যক্তিত্বের সাতটি অগ্রন্থিত চিঠি পত্রস্থ হলো। চিঠিগুলো ১৮৮৬ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে, অর্থাৎ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে লেখা। এই পত্রকারদের মধ্যে মাত্র দুজনের—শহীদুল্লাহ্ ও অন্নদাশঙ্করের কিছু চিঠি গ্রন্থাকারে প্রকাশ লাভ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের চিঠি পাওয়া গেছে সবচেয়ে কম, মাত্র ১০টি (দেখুন, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলীর সাহিত্য সংসদ সংস্করণের অষ্টাদশ মুদ্রণ, কলকাতা ১৪২৩)। তবে এই গুচ্ছের চিঠিগুলো পত্রিকা ও সংকলনে প্রকাশিত হলেও গ্রন্থভুক্ত হয়নি।

 আমাদের সংগৃহীত বঙ্কিম-পত্রটি আজতক প্রাপ্ত একাদশ পত্র। এটি প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত বিশ্বভারতী পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় (শ্রাবণ ১৩৪৯) বঙ্কিমের হস্তাক্ষরে পণ্ডুলিপি চিত্রে প্রকাশ পায়।

 সংকলিত চিঠিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজনারায়ণ বসুকে (১৮২৬-৯৯) লেখা রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি ছিলেন কবি, গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, বাংলা ভাষায় প্রথম শর্ট হ্যান্ড ও স্বরলিপির উদ্ভাবক এবং মেঘদূত-এর তরজমাকার। তাঁর বিখ্যাত কাব্য স্বপ্নপ্রয়াণ (১৮৬০)। অনুজ রবীন্দ্রনাথ চারণ করেছেন তাঁর স্মৃতি: ‘...স্বপ্নপ্রয়াণের কত পরিত্যক্ত পত্র বাড়িময় ছড়াছড়ি যাইত তাহার ঠিকানা নাই।...তিনি বিস্তর লেখা ফেলিয়া দিতেন। সেইগুলি কুড়াইয়া রাখিলে বঙ্গ সাহিত্যের একটি সাজি ভরিয়া তোলা যাইত।’ (জীবনস্মৃতি, বিশ্বভারতী ১৪১৮ পৃ.৬৮)। বাক্স তৈরি বিষয়ে তাঁর গ্রন্থ বক্সমেট্রি (১৯১৩)। চিঠিটি বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৫৯ সংখ্যায় মুদ্রিত।

 সংকলিত দ্বিতীয় চিঠির লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই চিঠির সাল উল্লেখ নেই। বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রের দ্বিতীয় ও পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ ১৮৯২-এ প্রকাশিত। সম্ভবত চিঠিটি ওই বছর লেখা। চার বছর পর রবীন্দ্রনাথ লিখবেন কৃষ্ণচরিত্রের সুদীর্ঘ আলোচনা, ‘কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থ স্বাধীন মনুষ্যবুদ্ধির জয়পতাকা উড্ডীন করিয়াছেন। তিনি শাস্ত্রকে ঐতিহাসিক যুক্তিদ্বারা তন্ন তন্ন রূপে পরীক্ষা করিয়াছেন এবং চির প্রচলিত বিশ্বাসগুলিকেও বিচারের অধীনে আনয়ন পূর্বক অপমানিত বুদ্ধিবৃত্তিকে পুনশ্চ তাহার গৌরবের সিংহাসনে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়াছেন।...দেখাইয়াছেন, যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নহে, যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র।’ (‘আধুনিক সাহিত্য’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ৯ম খণ্ড)। বঙ্কিমের এই চিঠিটি বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ, ১৩৪৯ সংখ্যায় মুদ্রিত।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমৃত্যু সংযুক্ত ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান তাঁর কীর্তিস্তম্ভ। বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত এবং বাংলা সাহিত্যের কথা (দু-খণ্ড) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের (১৮৭১-১৯৫৩) সঙ্গে যৌথভাবে আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য সম্পাদনায় আগ্রহী ছিলেন। এ চিঠিটি আহমদ শরীফ সংগ্রহ থেকে গৃহীত এবং এখন অব্দি অপ্রকাশিত।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয়দান সংক্ষিপ্ত পরিসরে অসম্ভব। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর নাম সমুচ্চারিত। বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রকাশকের মনোভাব ও আচরণ এই পত্রে প্রকাশিত। তারাশঙ্করের এ চিঠিটি তাঁর স্ত্রী উমাশশীকে লেখা। ১৯৮৩ সালে নবনীতাদেব সেন প্রকাশিত টুকরো চিঠি সংকলনে এটি প্রকাশিত হয়।

অন্নদাশঙ্কর রায় মননশীল ও সৃজনধর্মী সব ধরনের সাহিত্যসৃজনে সিদ্ধি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী তাঁর সাহিত্যিক আদর্শ। তিনি অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যশিল্পী রূপে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। আইসিএস অফিসার হিসেবে ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম-কুষ্টিয়ায় অবিভক্ত ভারতে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পত্র সংগ্রহ, মন-মননের পত্রালি ঢাকা থেকে প্রকাশিত (স. আবুল আহসান চৌধুরী)। এই চিঠি কবি রাধারাণী দেবীকে (১৯০৩-৮৩) লেখা (ছদ্মনাম অপরাজিতা)। তাঁর রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘তোমার ভাষার সঙ্গে তোমার লেখনীর পরিহাস কুশল সখীত্ব দেখে বিস্ময় লাগে।...তোমার বাণীতে তোমার নিজের কণ্ঠস্বর খুব স্পষ্ট।...তোমার লেখায় যে ভঙ্গী যে রঙ্গ যে কঠাক্ষ হাসির যে কল কল্লোল ভাষার যে বিচিত্র নাট্যলীলা বাংলা সাহিত্যে আর কারো কলমে সে এমন করে চঞ্চল হয়ে ফুটে ওঠেনি।’ (উদ্ধৃতি: টুকরো চিঠি, নবনীতা দেবসেন, প্রকাশিত, ১৯৮৩)।

 আবু সয়ীদ আইয়ুব বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচক ও দার্শনিক। আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, পান্থজনের সখা, পথের শেষ কোথায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। বিশ্বভারতী ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, কোয়েস্ট সাময়িকী সম্পাদনা করেন। এই চিঠিটি অনুষ্টুপ, শারদীয় ১৯৯৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।

 ইংরেজিতে লেখা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র একটি চিঠি সৈয়দ আবুল মকসুদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। পাঁচটি চিঠির বাংলায় তরজমা (মশিউল আলমকৃত) প্রথমে ভোরের কাগজে (১৪ এপ্রিল ১৯৯৭) এবং পরে আবদুল মান্নান সৈয়দের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ ও সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত অগ্রন্থিত রচনা সংকলনে স্থান পেয়েছে। এখানে সংকলিত চিঠিটি মাহমুদ শাহ কোরেশী সংবর্ধনা গ্রন্থ (ঢাকা, ২০০১) থেকে গৃহীত। চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।

চিঠিগুলোতে সেই সময়কার বানান ও ভাষারীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। শেষে এ পত্রাদি সংগ্রহের ক্ষেত্রে নেহাল করিম ও যাহেদ করিমের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।