দাঙ্গার উপন্যাস

অমৃতসর থেকে পালিয়ে লাহোরে আসার পর নিসার আলীর সঙ্গে দেখা হলো দোস্ত মোহাম্মদের। শিল্পী: রফিকুন নবী
অমৃতসর থেকে পালিয়ে লাহোরে আসার পর নিসার আলীর সঙ্গে দেখা হলো দোস্ত মোহাম্মদের। শিল্পী: রফিকুন নবী

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মাত্র ৮৭ পৃষ্ঠার স্বল্পকলেবরের উপন্যাস আনারকলি। লিখেছিলেন সেই ১৯৬৩ সালে, একেবারে তাঁর তরতাজা যৌবনে। ছাপা হয়েছিল সেকালের বিখ্যাত সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালীর বিশেষ সংখ্যায়। পাক্কা ৫৪ বছর পর উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন প্রমাণ করল, তারা সত্যিই পাকা জহুরি। ১৯৪৭ সালের ভারতবিভক্তির পরিণতি-সৃষ্ট ভয়াবহ রক্তাক্ত দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে, উর্দু, পাঞ্জাবি ও হিন্দি ভাষায় যত ব্যাপকভাবে গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে, সেই তুলনায় বাংলা ভাষায়—দুই বাংলা মিলিয়ে—এ ক্ষেত্রে কাজের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে স্বল্পই। এই প্রেক্ষাপটে যখন দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে লেখা একটি উপন্যাস আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়, তার কলেবর যত ক্ষীণকায়ই হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত পটভূমিতেই তা একটি স্মরণীয় ঘটনা।

আনারকলি উপন্যাসের পটভূমি বাংলার ভূখণ্ড নয়, সুদূর অমৃতসর ও লাহোরের মাটি—১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত যে দুটি ভূখণ্ডের একটি পাকিস্তান, অন্যটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভয়াবহ রক্তাক্ত দাঙ্গার ভেতর দিয়ে বাংলার মতো তখন পাঞ্জাবও হয় দ্বিখণ্ডিত। সেই দাঙ্গাই এই উপন্যাসের নায়ক নিসার আলীকে সর্বস্বান্ত করে, বাস্তুচ্যুত করে। দাঙ্গাকারীদের হাতে প্রাণ হারায় তার ছোট ভাই, নিকটাত্মীয়-স্বজন। কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে অমৃতসর ছেড়ে লাহোরে চলে আসে নিসার। কিন্তু স্মৃতিমেদুরতা বা নস্টালজিয়া তার পিছু ছাড়ে না, নিরন্তর তাড়িয়ে ফেরে অমৃতসরের স্মৃতি। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা তাকে বাধ্য করে লাহোরের আনারকলি মার্কেটের সব সেরা এক জুতার দোকানে চাকরি নিতে। সেলসম্যানের চাকরি। আশ্রয় পায় দোস্ত মোহাম্মদ নামের এক ট্রাকচালকের বাসায়। ফুরসত পেলেই নিসার টাঙ্গা গাড়ি ভাড়া করে লাহোরের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে বেড়ায়। নিজের কলেজজীবনের কথা মনে পড়ে। আত্মীয়স্বজনের কথাও। এমন সব স্মৃতিসিক্ত ঘটনা ছাপিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই তার জীবনে আসে প্রেম। দোস্ত মোহাম্মদের মেয়ে আমিনার প্রেমে পড়ে সে। তবে দ্বিধা ছাড়ে না তাকে। আমিনার বাবা দোস্ত মোহাম্মদ কি মেনে নেবে তাদের সম্পর্ক? আমিনার সঙ্গে ঘর করতে চাইলে কি সম্মতি দেবে সে? এত সব দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতরেও আমিনার সঙ্গে নিসারের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। দোস্ত মোহাম্মদের অনুপস্থিতিতে দুজন নানা জায়গা বেড়াতে যায়। একদিন দেখা গেল আমিনা ও নিসারের মনে পরস্পরের প্রতি সম্পর্কগত যে ধোঁয়াশা ছিল, সেটা কেটে গেছে। এ সময় দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে প্রেম-ভালোবাসার প্রগাঢ় উষ্ণতায় আরক্তিম হয়ে ওঠে তারা।
এরপর থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হয় নিসারের মনে। এখন আর গোপনভাবে নয়, আমিনাকে সে সরাসরি চায়, বিয়ে করে চিরসঙ্গী করতে চায় তাকে। কিন্তু মুখ ফুটে আমিনার বাবা দোস্ত মোহাম্মদকে কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না নিসার। একদিন সে সুযোগও আসে। আমিনাকে বিয়ের প্রস্তাব নিসারকে দিতে হয় না, প্রস্তাবটি দিয়ে বসে দোস্ত মোহাম্মদই। এভাবে, ‘খুব বিব্রত দেখাল দোস্ত মোহাম্মদকে। নিসার বলল, “আপনি না থাকলে লাহোরে আমি না খেয়ে মারা যেতাম। আমার সব ছিল, কিছু নেই। আপনার এখানে আমি এত ভালো আছি, এত যে, এর শোধ দিতে পারব না।”
‘দোস্ত মোহাম্মদ তখন বলল, “পাগল তুমি। শোধ কিসের?”
‘তারপর গলা নামিয়ে যোগ করল, “ভাবছিলাম, আমার আমিনা বেটিকে তোমার হাতে তুলে দিই। আমার চোখের সামনেই থাকবে। শোধ কিসের?”
‘অন্ধকারেও তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি চোখে পড়ল নিসারের। যে কথাটা সে নিজে বলার জন্য এ কদিন অবিরাম চেষ্টা করে এসেছে, তা এত সহজে হয়ে গেল।’
এ কথা শোনার পর নিসারের খুশির অন্ত নেই। দোস্ত মোহাম্মদ ‘উৎসব’ করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে যখন, তখনই কাহিনির মোড় ঘুড়ে যায়। লাহোরের মাটিতে নিসার পেয়ে যায় তার ছোট ভাইয়ের খুনিকে। দ্বিধাহীন চিত্তে সে-ও খুন করে তাকে। ধরা পড়ে চলে যায় জেলে।
দোস্ত মোহাম্মদের কথা দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হয় এভাবে: ‘কী তাজ্জব। ন বছর একসঙ্গে থেকেও নিসারের কুচরিত্র তার মালুম হয়নি। আমিনা বেটির ওপর নেক নজর আছে আল্লার।’
সৈয়দ শামসুল হক জানেন কীভাবে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর বিস্তার দেখাতে হয়, কঠোর বাস্তবতাকে কীভাবে কথাসাহিত্যের স্বরূপে বিম্বিত করতে হয়। আনারকলি তাঁর সেই ধরনের উপন্যাস, যা পড়ার পর প্রতি পদে পদে মনে পড়ে তাঁর অনুপস্থিতি আর অভাব।


আনারকলি
সৈয়দ শামসুল হক
প্রচ্ছদ: রফিকুন নবীর অলংকরণ অবলম্বনে মাসুক হেলাল
অলংকরণ: রফিকুন নবী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৭, ৮৭ পৃষ্ঠা
দাম: ১৬০ টাকা।