বানিয়ালুলু

বানিয়ালুলু নামে যে একটা দেশ আছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় না এলে এটা কারও জানাই হতো না। জানা হতো না, লুলু নামে বানিয়ালুলুর একটা দাপ্তরিক ভাষা আছে এবং সোয়া কোটি লোক সেই ভাষায় কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে গিয়ে এই দেশটির অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গেছে। কীভাবে সেটা ঘটল, সেই কাহিনি একাধারে কৌতুকময়, চমকপ্রদ এবং কিছুটা শ্বাসরুদ্ধকরও বটে, কেননা এর সঙ্গে একজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার যোগ আছে। যিনি নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁর কথা আমি যথাস্থানে বলব। এখন শুরুর কথা শুরুতে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাতটি দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই সাতটি দেশ হলো ইরান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, চাদ ও উত্তর কোরিয়া। এর আগে মার্চে যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল ১৫টি দেশের ওপরে, সেই তালিকার সঙ্গে এটি মিলিয়ে পড়তে হবে। কিছু দেশের নাম উভয় তালিকায় আছে। ফলে যোগ-বিয়োগ করলে দেখা যাচ্ছে, মোট ১৭টি দেশের ওপর নানা মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। কোনো কোনো দেশের নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্রে একেবারেই ঢুকতে পারবেন না, আবার কোনোটির নাগরিকদের ঢুকতে বেগ পেতে হবে।
২৪ সেপ্টেম্বর যে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, সেটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন বিষয়ে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির একটি রিভিউ রিপোর্টের আলোকে এই নিষেধাজ্ঞা। দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে এটি স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে জারি করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এটি ছিল ওই দিন একই বিষয়ে জারি করা দ্বিতীয় আদেশ। এর ঠিক আধা ঘণ্টা আগে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে যে প্রথম আদেশ জারি করা হয়েছিল, তাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ছিল আটটি দেশের নাম। অস্বাভাবিক দ্রুততায় সেই আদেশ বাতিল করে দ্বিতীয় আদেশ জারি করা হয়। এতে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সাতটি দেশের নাম দেখা যাচ্ছে। যে অষ্টম দেশটির নাম কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি বানিয়ালুলু এবং এই দেশটির নাম আগে কেউ কখনো শোনেনি।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিশিয়াল ঘোষণায় কী করে অজানা একটি দেশের নাম এল, তা নিয়ে কেউ খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। অনেকেই এটাকে দাপ্তরিক প্রমাদ হিসেবে ধরে নিয়েছে। তা ছাড়া সাত দেশের ওপর আরোপিত নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে হই-হাঙ্গামা শুরু হয়, সবার নজর সেদিকে সরে গিয়েছিল। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতে হাঁফ ছেড়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন, হোয়াইট হাউসের আসন্ন বহু কেলেঙ্কারি মধ্যে অন্তত একটি আপাতত চাপা দেওয়া গেছে। তবে তাদের এই ভাবনা যে ভুল ছিল, বড়দিন আসার আগেই সেটা টের পাওয়া গেছে।
এখন আমি আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধুর কথা বলব। ২৪ সেপ্টেম্বরের প্রথম ঘোষণাটির দিকে তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন। দ্বিতীয় ঘোষণা আসা সত্ত্বেও তাঁর কোঁচকানো ভ্রু সোজা হয়নি। তিনি এর মধ্যে মরা ইঁদুরের গন্ধ পেয়েছিলেন। প্রশাসনের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র তাঁকে নিশ্চিত করেছে, ২৪ সেপ্টেম্বর কেলেঙ্কারির দিন বিকেলে হোয়াইট হাউসে ‘ইনার সার্কেল’ নামে পরিচিত প্রেসিডেন্টের অতি আস্থাভাজন উপদেষ্টা পরিষদ তাৎক্ষণিক একটি জরুরি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে এবং ওই দিন সন্ধ্যার আগেই কয়েকটি দপ্তরের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পুরো বিষয়টির মধ্যে একটি অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো ছিল এবং সবকিছুর ওপর গোপনীয়তার একটা চাদর টেনে দেওয়া হয়েছিল।
চাকরি হারানো পাঁচ কর্মকর্তার একজন ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রেকর্ড শাখার আর্কাইভিস্ট। অক্টোবরের কোনো এক বিকেলে ম্যানহাটনের নবম ও দশম ব্লকের মাঝে ডেমি জোন্স নামে একটি ক্যাফেতে তাঁকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাঁর সামনে বসে ছিলেন বাতিকগ্রস্ত সেই সাংবাদিক। সাংবাদিকটিকে এখন থেকে আমরা র‍্যাট স্মেলার নামে ডাকব। আর্কাইভিস্ট ও র‍্যাট স্মেলার পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট সেখানে বসে ছিলেন। তাঁরা নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। কথা শেষে বিল মিটিয়ে তাঁরা ট্যাক্সি নিয়ে দুজন দুদিকে চলে যান।
শোনা যায়, র‍্যাট স্মেলার তাঁর দেড় কক্ষের ক্ষুদ্র অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচ হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু দলিলপত্রও জোগাড় করে ফেলেছিলেন তিনি। প্রতিবেদনের প্রস্তাবিত শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন: ‘বানিয়ালুলু একটি দেশের নাম’। আটলান্টিকের অপর পারে একটি ইংলিশ ট্যাবলয়েডের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল। তবে কেউ নিশ্চিত নন, নির্মীয়মাণ প্রতিবেদনের কোনো অসম্পূর্ণ খসড়া তিনি সেই পত্রিকার অফিসে পাঠিয়েছিলেন কি না। তত দিনে তাঁর প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নানাভাবে প্রচার পেতে শুরু করেছে। তিনি কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন, একটা পর্যায় পর্যন্ত সেটা জানাজানি হয়ে গেছে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি র‍্যাট স্মেলার নিখোঁজ হন। অনেকে বলেন, তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই অন্তর্ধানের যোগ আছে। থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
র‍্যাট স্মেলার একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রচারে নেমেছিলেন। তাঁর দাবি, ট্রাম্পের প্রথম ঘোষণায় কোনো দাপ্তরিক ভুল ছিল না। বানিয়ালুলু নামে একটি দেশের অস্তিত্ব সত্যি আছে। বেলজিয়াম বা দক্ষিণ আফ্রিকা বা প্যারাগুয়ে নামক দেশগুলো যেভাবে অস্তিত্বশীল, বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তফাতের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্যদেশের তালিকায় এটির নাম নেই, পৃথিবীর কোনো মানচিত্রে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না এবং কোনো ভূগোলের বইতেও এ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টের গোপন কুঠুরি থেকে র‍্যাট স্মেলার যেসব দালিলিক তথ্য-উপাত্ত হাত করেছেন, সেগুলোর ভিত্তিতে বানিয়ালুলুর কিছু বিবরণ দাঁড় করানো সম্ভব। তবে স্বীকার না করে উপায় নেই, সেই বিবরণ বড়ই অসম্পূর্ণ এবং জোড়াতালিময়। এগুলো দেশটি সম্পর্কে কোনো অখণ্ড, সংগতিপূর্ণ ছবি হাজির করে না। যেমন ধরা যাক, আমরা বানিয়ালুলুর রাজধানী শহরের নাম পাই না, অথচ রাজধানীর পুব প্রান্তে ইমাহাতি নামে যে একটি মহল্লা আছে এবং সেই মহল্লার ৩৩৬ ও ৩৩৭ নম্বর বৈদ্যুতিক খুঁটির মধ্যবর্তী দূরত্ব যে ১৮ গজ, এই অপ্রয়োজনীয় তথ্য আমরা জানতে পারি। দেশটির দাপ্তরিক ভাষা লুলুর নিজস্ব লিপি নেই, এই তথ্য একাধিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু আমরা জানতে পারি না, কোন ধার করা লিপিতে তা লেখা হচ্ছে। এক স্থানে খুবই পরোক্ষ একটি উল্লেখে বলা হয়েছে, নেপোলিয়নের অস্টারলিৎসের যুদ্ধজয়ের সময়কাল থেকে লুলু ভাষা মান্দারিন লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। কিন্তু এ থেকে অনুমান করার কোনো কারণ নেই, দেশটির সঙ্গে চীনা ভাষাভাষী অঞ্চলের ভৌগোলিক যোগ আছে।
বানিয়ালুলু সম্পর্কে কিছু বিবরণে শুধু যে সংগতির অভাব প্রকট তা-ই নয়, কিছু বিবরণ পরস্পরবিরোধীও বটে। যেমন ধরা যাক, কয়েকটি উল্লেখ থেকে মনে হতে পারে, দেশটি সিরিয়া ও আজারবাইজানের মাঝামাঝি কোনো মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। আবার অপর একটি উল্লেখে মনে হবে, দেশটি বাল্টিক সাগর–তীরবর্তী। অথচ নামের ধ্বনিবিন্যাসের কারণে অনেকের অনুমান, বানিয়ালুলুর অবস্থান আফ্রিকা মহাদেশের কোথাও। অনেকে লাতিন আমেরিকাকেও সন্দেহে রাখতে পারেন। অনেকে আবার বসনিয়ার শহর বানিয়া লুকার সঙ্গে এটির নামের মিলকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন। তবে অবস্থান নিয়ে যত ধোঁয়াশাই থাক না কেন, দুটি বিষয় সন্দেহের ঊর্ধ্বে। প্রথমত, বানিয়ালুলু কোনো দ্বীপদেশ নয়। এটির অবস্থান পৃথিবীর বৃহৎ মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলোর কোনো একটিতে। দ্বিতীয়ত, দেশটি বিষুবীয় অঞ্চলের দেশ নয়।
র‍্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর ভূ-প্রকৃতি, কৃষি, জলবায়ু ও মানুষের জীবনযাত্রা–সংক্রান্ত যেসব দলিল জোগাড় করেছেন, আমি বলব, সেগুলো বরং অনেক বেশি সুসংগত আর বিশদ। কিছু বিবরণ রেমব্রান্টের ছবির মতো জীবন্ত। একটি বিবরণে আদ্দিশ নামে একটি পাহাড়ের পাদদেশে সাত সদস্যের একটি পরিবারের এক দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা আছে। পরিবারের একটি মেয়ে পাতকুয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলছে। এমনকি সেই বালতির প্রতিটি রিভেটে হলুদ মরিচার বিবরণও আমরা পাই। বসতভিটা থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি নদী, যার নাম যদিও উল্লেখ করা নেই, তবে সেই নদীর স্বচ্ছ জলের তলদেশে খেলা করা প্রতিটি মাছের নামধামসহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া আছে। সেই বিবরণ এত নিখুঁত যে মাছের প্রতিটি আঁশ থেকে ছুটে আসা রোদের ঝিলিকও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
র‍্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষের বোটানি বইয়ের (রুশ ভাষায় ভাষান্তরিত) পঞ্চম অধ্যায়ের পুরোটাই হাতে পেয়েছেন। সেখানে বানিয়ালুলুর ছয় ধরনের বায়ুপরাগী ফুলের প্রস্থচ্ছেদের ছবি দেওয়া আছে। পাঁচটি ফুল অতি পরিচিত। ষষ্ঠ ফুলটি আমাদের জবা ফুলের মতো দেখতে হলেও একটু ভালো করে তাকালে পাপড়ির বিন্যাসের অমিলগুলো চোখে পড়বে।
ষাটের দশকে দেশটিতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল বলে একটি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোথাও বলা হয়নি বানিয়ালুলুর প্রধান ফসল কী। ভুট্টাজাতীয় একটি ফসলের উল্লেখ এক স্থানে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাইলে তা হবে অতি সাধারণীকরণ।
র‍্যাট স্মেলার দেশটির গ্রামাঞ্চলে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের দীর্ঘ ক্লান্তিকর বিবরণ দিয়েছেন। তা থেকে সেখানকার লোকাচার, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। এমনকি যে চারটি বিয়ের গীতের লিরিক তুলে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে প্রচলিত লোকবিশ্বাস এবং অধিবাসীদের যৌথ মনোজগৎ সম্পর্কে কিছু বিষয় সহজে অনুমান করা যায়। শিয়াল আর কাকের চালাকি নিয়ে কয়েকটি উপদেশমূলক শিশুতোষ গল্পের একটি সিরিজ এ ক্ষেত্রে সোনার খনি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এগুলো থেকে অনুমেয়, সেখানকার কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোয় এখনো কৌম সমাজকাঠামোর প্রভাব প্রবল এবং শহরাঞ্চলে অর্থবিত্তের চেয়ে দৈহিক শক্তি ও বংশপরিচয়কে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়।
র‍্যাট স্মেলার দেশটির মুদ্রা ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সামান্য কিছু বিবরণ হাজির করতে পেরেছেন। এ ছাড়া দেশটির শিল্প অঞ্চলে অবস্থিত একটি কারাগারের পঞ্চাশজন কয়েদির অপরাধের বিবরণ থেকে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, এমনকি আর্থসামাজিক কাঠামো সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
মোট কথা, র‍্যাট স্মেলার যেসব বিচ্ছিন্ন দলিল ও বিবরণ উদ্ধার করেছেন, সেগুলো জোড়া লাগিয়ে বানিয়ালুলুর একটি ছবি দাঁড় করানো যায় বটে, তবে সেই ছবি একটা বিবর্ণ পারিবারিক অ্যালবামের ফাঙ্গাস–আক্রান্ত গ্রুপ ছবির মতোই ধোঁয়াশাময়। তাতে প্রকাশিত অংশের চেয়ে অপ্রকাশিত অংশই বেশি।
র‍্যাট স্মেলারের প্রতিবেদনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, সমগ্র বিশ্বের চোখে ধুলা দিয়ে বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব কী করে এত দিন গোপন রাখা সম্ভব হলো বা এ নিয়ে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড়ের কারণ কী—এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা এতে নেই। এ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত বা অনুমানের সূক্ষ্ম সূত্রও হাজির করতে পারেননি তিনি। আমার মনে হয়েছে, গোপনীয়তার এই রহস্য ভেদের চেয়ে দেশটির বিবরণ দেওয়ার দিকেই র‍্যাট স্মেলারের ঝোঁক ছিল।
এসব বিবরণ থেকে কতগুলো সাধারণ জিনিস যৌক্তিকভাবে প্রতিপন্ন হয়। প্রথমত, বানিয়ালুলু কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। মান্দারিন লিপি গ্রহণ, রুশ ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বইপত্রের উপস্থিতি এবং সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে এটির যোগাযোগ আর দশটা দেশের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘটছে। র‍্যাট স্মেলার এমনকি তুরস্কের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের বানিয়ালুলু সফর এবং দেশটি থেকে গ্রানাইট পাথর আমদানি–সংক্রান্ত একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন।
এরপরও বানিয়ালুলুর অদৃশ্য থেকে যাওয়ার বিষয়টি, আমার চোখে, সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে দুর্জ্ঞেয় রহস্যগুলোর একটি। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে এই বিষয়টিতেই র‍্যাট স্মেলারের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
আমি নিজে এ বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করে অবশেষে বুঝতে পেরেছি, এ ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতির সুযোগ নেই। বানিয়ালুলুর অনস্তিত্ব কোনো অভিপ্রায়হীন নিরীহ ঘটনা নয়। এর পেছনে চরাচরব্যাপী ষড়যন্ত্রের সুদীর্ঘ জাল বিছানো। সেই জাল ভেদ করা শুধু যে অসম্ভব তা-ই নয়, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও। আমরা বড়জোর ষড়যন্ত্রটির প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু আঁচ-অনুমান করতে পারি, এলোপাতাড়ি ঝোপঝাড় পেটাতে পারি।
বানিয়ালুলুর অনস্তিত্বের দুটি লক্ষণীয় দিক আছে। প্রথম কথা হলো, এটির উপস্থিতি বিশ্বের যৌথ মানব অনুধাবন থেকে এমন বিশেষ কায়দায় মুছে ফেলা হয়েছে, যেন ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই এর অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ অবলোপন প্রক্রিয়াটির একটি ব্যাক-প্রোজেকশন এফেক্ট (পশ্চাৎ-প্রক্ষেপ প্রভাব) বিদ্যমান। এটি অর্জন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কেননা দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অতীত ও বর্তমানের তাবৎ ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ সে ক্ষেত্রে সুকৌশলে প্রতিস্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব অবলোপনের সঙ্গে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের যোগ আছে। এই অবলোপন প্রক্রিয়াটির সাফল্যের সঙ্গে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে বিস্তৃত একটি সুবিশাল ব্যবস্থার টিকে থাকা না–থাকার প্রশ্ন জড়িত।
দেশটির অবলোপনপ্রক্রিয়া কীভাবে এতটা কার্যকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে, এ বিষয়ে আমার একটি অনুমান আছে। অনুমানটি কয়েক মাস আগে আমার মধ্যে বিদ্যুৎ–ঝলকের মতো উঁকি দেয়, যখন আমি দক্ষিণ আমেরিকায় হিস্পানি উপনিবেশ বিস্তারপ্রক্রিয়া নিয়ে উত্তর–ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদ টমাস মানরোর একটি বই পড়ছিলাম। মানরো দেখিয়েছেন, কী করে হিস্পানি কনকিস্তাদোররা একটি বিশাল অ্যাজটেক মন্দির অক্ষত রেখেও সেটির অস্তিত্ব মুছে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরের দেড় হাজার সিঁড়ির একটি পাথরও না সরিয়ে, দেয়াল থেকে প্রাচীন দেবতাদের একটি মূর্তিও অপসারণ না করে পুরো মন্দিরটি এমনভাবে গায়েব করা হয়েছে, কোথাও কোনোভাবে এটি আর দেখতে পাওয়া যায় না। যে অভিনব কায়দায় এ কাজ করা হয়েছে, টমাস মানরো সেটার নাম দিয়েছেন কালচারাল ডিসইন্টিগ্রেশন। মন্দিরসংক্রান্ত সব অখণ্ড তথ্যকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক উপাত্তে ভেঙে ফেলে এমন বিশেষ কায়দায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য তথ্যের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়ে তা কলুষিত করা হয়েছে যে এগুলো উদ্ধার ও সমন্বিত করে মন্দির–সংক্রান্ত কোনো অভিন্ন অনুধাবন কারও পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ফলে কারও অনুধাবনে মন্দিরটি একটি প্রাচীন ফলদ বৃক্ষ, কারও অনুধাবনে একটি প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ড আবার অধিকাংশের অনুধাবনে এটি একটি লন্ড্রির দোকান হিসেবে হাজির হয়।
হতে পারে বানিয়ালুলুর ক্ষেত্রে এ রকম নিখুঁত ব্যাক-প্রোজেকশন এফেক্ট অর্জন করা সম্ভব হয়েছে ওই একই কালচারাল ডিসইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে মানতে হবে বানিয়ালুলুকে ফিরিয়ে আনার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই। দেশটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমরা বড়জোর মার্কিন সাংস্কৃতিক প্রক্ষেপগুলোর মধ্যে বানিয়ালুলুর ছিন্নভিন্ন অস্তিত্বের পরোক্ষ কিছু আভাস খুঁজে নিতে পারি মাত্র। এ জন্য আমাদের পর্যবেক্ষণ শক্তিকে বিশেষ কায়দায় প্রখর ও শাণিত করে নিতে হবে। অনুসন্ধানী চোখে তাকাতে হবে হলিউডের স্টুডিওগুলো থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর উৎকাল্পনিক কাহিনি ও সংলাপের দিকে, কান পাততে হবে রক-অ্যান-রোলের প্রতিটি ড্রাম বিটের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র অবকাশবিন্দুতে, বার্নস অ্যান্ড নোবেলের প্রতি তলার প্রতিটি নিউ অ্যারাইভালের প্রতি পাতার দুটি লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলোর বিন্যাস লক্ষ করতে হবে, এবং এমনকি নিউইয়র্কের প্রতিটি সড়কের ফুটপাতের ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দেওয়া কফির মগ লক্ষ করতে হবে গভীর অভিনিবেশে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা বানিয়ালুলুর খুবই পরোক্ষ উল্লেখের কোনো কোনো আণুবীক্ষণিক টুকরো হয়তো মাঝে মাঝে শনাক্ত করতে সক্ষম হব।
র‍্যাট স্মেলারের প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। অনেকে তাঁর অনুপস্থিতিকে জবরদস্তিমূলক অন্তর্ধানের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন। তবে আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও দুটি সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেওয়া যাবে না। বানিয়ালুলুর বিবরণ সরবরাহ করতে গিয়ে দেশটির ব্যাপারে র‍্যাট স্মেলারের ক্রমবর্ধমান মুগ্ধতা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। হতে পারে, দেশটিতে পাড়ি জমানোর কোনো গোপন সুড়ঙ্গ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। অথবা তিনি আদৌ নিখোঁজই হননি। অজস্র তথ্য আর উল্লেখের মধ্যে বিশ্লিষ্ট হয়ে তিনি হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ম্যানহাটনেরই রাস্তায় রাস্তায়, আমাদের পাশে পাশে।