ভূতলেখকদের রাজ্যপাট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভূতেরা যে বই লেখে, এমনকি সাড়াজাগানো বইয়ের লেখক হয়েও যশ-খ্যাতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে নিজেদের পরিচিতি মনুষ্যসমাজে হাজির করতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ বোধ করে না—এ কোনো নতুন তথ্য নয়। ইংরেজিতে যাঁদের বলা হয় ‘গোস্ট রাইটার’, সেই ভূতলেখকেরা পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায়ই কম-বেশি বিরাজ করেন, কোথাও কোথাও প্রবল বিক্রমে। কবে তাঁরা মর্ত্যে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন কিংবা কেই-বা আদি ভূতলেখক, যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে উত্তরসূরিরা নিজেদের পথ করে চলেছেন বলা মুশকিল। লেখালেখির প্রকাশ্য জগতে ভূতলেখকেরা যথার্থই আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা।
বলতে গেলে সভ্যতার গোড়ায়, পড়ালেখার প্রচলন হওয়ার সময় থেকেই ভূতলেখকদের নিয়ে কথাবার্তা ও নানা গুজব প্রচার পেয়ে আসছে। অবিশ্বাসীদের কাছে ধর্মগ্রন্থ যেমন ভূতলেখকদের কারসাজি, তেমনি বিশ্বনন্দিত কিছু ধ্রুপদি বইপত্রকেও (যেমন: হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড, অডিসি বা শেকস্‌পিয়ারের হ্যামলেটসহ বেশ কিছু নাটক ও সনেট) অনেকে ভুতুড়ে বলে আখ্যা দিতে গিয়ে কম খাটাখাটনি করেননি। আবার কিংবদন্তিতুল্য কয়েকজন লেখক-শিল্পীর বিষয়ে জানা যায়, জীবনের কোনো পর্যায়ে তাঁরা অন্যের হয়ে ভূতগিরি বা গোস্টিং করেছেন। যেমন মোজার্ট। অষ্টাদশ শতকের এই সংগীত-মহিরুহ একসময় অন্য সংগীতকারের হয়ে বেশ কিছু লিরিকই শুধু লিখে দেননি, সুরারোপ করেও তাঁদের খ্যাতির পরিচর্যা করেছেন। ব্যাপারটা অবশ্য পরে চাপা থাকেনি।
ভূতলেখক কারা? এক কথায় অন্যের হয়ে যাঁরা বইপত্র লিখে দেন—অবশ্যই মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। অন্যকে খ্যাতিমান করার এই প্রবঞ্চনায় সৃজনশীল, মননশীল ও আত্মজীবনীমূলক বই যেমন থাকে, তেমনি গবেষণাপত্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তৃতা-বিবৃতি, এমনকি ছাত্রছাত্রীদের টার্ম পেপারও নাকি বাদ যায় না। মূলত রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিক, খ্যাতনামা চিত্রতারকা, ক্রীড়াবিদদের আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণামূলক বই লিখতে ভূতলেখকেরা ভাড়া খাটেন। আবার এমনও শোনা যায়, অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের বাজারচলতি বই ছাপতেও গোস্ট রাইটারদের ভাড়া করে থাকে। সে ক্ষেত্রে কাজটা যে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের, বলার অপেক্ষা রাখে না। লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও রমরমা পসারের একজন লেখকের বইয়ের চাহিদা মেটাতে তাঁর পাঁচটা বইয়ের অনুকরণে-অনুসরণে অজ্ঞাত ভাড়াটে লেখক হয়তো দুটো বই লিখে দিলেন। কাজটা লেখকের অনুমোদনে তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে লেখক-প্রদত্ত গল্পকাঠামোর আলোকেও হয়ে থাকে। থ্রিলার বা রহস্যকাহিনির ক্ষেত্রে এটা বেশ কাজে খাটে বলে শোনা যায়। পাঠক মূল লেখকের বই ভেবে খুশিমনে বইগুলো কেনেন ও পড়েন। মূল বইয়ের চেয়ে ভুতুড়ে বই বেশি পাঠকপ্রিয় হওয়ার ঘটনাও কিন্তু বিচিত্র নয়।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল (স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল) আইয়ুব খানের আত্মজীবনীমূলক বই ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স-এর ভূতলেখক কে ছিলেন, এ নিয়ে যেমন নানা গুজব একসময় বেশ প্রচলিত ছিল, তেমনি এর বাংলা তরজমা প্রভু নয় বন্ধু কার ভূতগিরিতে সম্পন্ন হয়েছিল—এ প্রশ্নে আমাদের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় একজন বুদ্ধিজীবীর নাম প্রায়ই উচ্চারিত হতো। আসলে এ ধরনের ঘটনা না ঘটাই অস্বাভাবিক। কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান উইনস্টন চার্চিল বা জওহর লাল নেহরুর মেধা বা লেখাজোকার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন! আফ্রিকার স্বৈরশাসকদের থেকে শুরু করে বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটন—কার না বই ভূতদের লেখা!

মোহাম্মদ আইয়ুব খানের ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স, হিলারি ক্লিনটনের লিভিং হিস্ট্রি এবং বারাক ওবামার অডাসিটি অ্যান্ড দ্য হোপ—এসব আত্মজীবনীমূলক বই ভূতলেখকদের লেখা
মোহাম্মদ আইয়ুব খানের ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স, হিলারি ক্লিনটনের লিভিং হিস্ট্রি এবং বারাক ওবামার অডাসিটি অ্যান্ড দ্য হোপ—এসব আত্মজীবনীমূলক বই ভূতলেখকদের লেখা

দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের সম্ভবত লেখক হওয়ার স্বপ্নটা প্রায় মজ্জাগত। দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদের এ দেশেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁর কাব্যপ্রতিভার যে আচমকা বিস্ফোরণ লক্ষ করা গিয়েছিল, তা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দপ করে নিভে যাওয়ায় সেই কাঁচা পদ্যগুলো কোন ভূতের কলম থেকে বেরিয়েছিল—এ নিয়ে রং-রসিকতা কম হয়নি।
লেখার শক্তি বিবেচনায় ভূতলেখকদের পারিশ্রমিকে তারতম্য রয়েছে। মূল বিষয়, যাঁর নামে বইটা লেখা হচ্ছে, তাঁর ব্র্যান্ড ভ্যালু। নিউইয়র্ক টাইমস একবার হিলারি ক্লিনটনের স্মৃতিচারণামূলক বইয়ের খবর ফাঁস করে জানিয়েছিল, যিনি এটা লিখে দিচ্ছেন, তিনি মজুরি পাচ্ছেন পাঁচ লাখ ডলার, আর স্বয়ং হিলারি নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাবদ প্রকাশকের কাছ থেকে আগাম নিচ্ছেন আট মিলিয়ন ডলার। এ অবশ্যই অত্যন্ত উঁচু দরের পারিশ্রমিকের নমুনা। অন্তর্জালের বদৌলতে জানা যায়, ১৫০ থেকে ২০০ পৃষ্ঠার একটা বইয়ের জন্য একজন প্রতিষ্ঠিত গোস্ট রাইটারের পারিশ্রমিক ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার।
বলা নিষ্প্রয়োজন, গোস্ট রাইটারের জীবন বড়ই বিচিত্র। মূলত তাঁরা লেখক এবং অনেকেই শক্তিমান লেখক। কিন্তু সার্থক লেখকজীবনের কোনো স্বাদই তাঁরা পান না—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ-ও সত্য, তাঁরা তাঁদের আকাঙ্ক্ষাকে কখনোই সে পথে ধাবিত করেন না। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা কি তাই? একটা তুমুল সাড়াজাগানো বই অন্যের হয়ে লেখার পর বিস্তর টাকাকড়ি ব্যাংকে জমা পড়লেও নিজের শ্রমের বিনিময়ে অন্যের উত্তুঙ্গ ও মেকি খ্যাতি কি একটুও পীড়া দেয় না?
না, দেয় না। বলেছেন একজন ব্রিটিশ গোস্ট রাইটার এন্ড্রু ক্রফটস তাঁর কনফেশনস অব আ গোস্ট রাইটার বইয়ে। ক্রফটস একজন নামীদামি গোস্ট। দীর্ঘদিন কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখলেও স্বনামে প্রকাশিত বইটির কারণে তাঁর পক্ষে লোকচক্ষুর আড়ালে বা আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকা সম্ভব হয়নি। ফলে বিখ্যাত সাংবাদিকেরা ইদানীং তাঁর সাক্ষাৎকারও ছাপছেন। হোরাশিয়া হ্যারোড নামে লন্ডনের ইকোনমিক টাইমস-এর সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে ক্রফটস জানিয়েছেন, যেদিন থেকে তিনি নিজেকে গোস্টিংয়ে নিয়োজিত করেছেন, খ্যাতির মোহ-টোহ মাথা থেকে ঝেড়ে বিদায় করেছেন। যে কারণে অন্যের নামে লেখা বই পাঠক-সমাদর পেলেই তাঁর তৃপ্তি, আর মোদ্দা কথা কাজটা আনন্দদায়ক। তাঁর মতে, সব ধরনের অহংয়ের শেকড় সমূলে কেটেছেঁটে তবে এ কাজে নামতে হয়।
এ প্রসঙ্গে ক্রফটসের বক্তব্য যথেষ্ট সোজাসাপ্টা। তাঁর মতে, পৃথিবীতে মানুষ তার প্রয়োজনের সব কাজকর্ম নিজে করে না, অনেক কিছুই অন্যকে দিয়ে করায়; তা বাড়িঘর বানানো বা যন্ত্রপাতি মেরামত—যেকোনো কিছুই হতে পারে। এ ছাড়া আউটসোর্সিংয়ের ব্যাপারটা যেখানে সারা বিশ্বে প্রচলিত, সেখানে বই লেখার মতো কাজে কেন একই নীতি প্রযোজ্য হবে না? যুক্তি যেমনই হোক, এ থেকে একজন গোস্ট রাইটারের মনমানসিকতা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। ক্রফটস এখানেই থেমে থাকেননি। নিজের কাজ সম্বন্ধে তাঁর বইয়ে কৌতূহলোদ্দীপক যে তথ্যটি দিচ্ছেন তা এ রকম: অনেক ক্ষেত্রেই ভাড়ায় বই লেখা মানে বিস্তর টাকাকড়ি কামানোর পাশাপাশি দুনিয়ার সেরা পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষালাভ। উদাহরণ হিসেবে বলছেন, ধরা যাক ডারউইনের হয়ে যদি কাউকে দ্য অরিজিন অব দ্য স্পিসিস বা এডওয়ার্ড গিবোনের হয়ে দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার লিখতে হতো, তাহলে ব্যাপারটা কি এমন হতো না যে, টাকা ঢেলে বিশ্বসেরা মনীষীরা তাঁদের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানভান্ডারের দরজা মেলে ধরেছেন, যাতে সেসবকে বইয়ে রূপ দেওয়া যায়? শিক্ষালাভের এমন অকল্পনীয় সুযোগ আর কী হতে পারে!
কিন্তু কথা হলো, ডারউইন, গিবোন, কার্ল মার্ক্স, মিশেল ফুকো তাঁদের বইপত্র গোস্টদের দিয়ে লেখাননি। বিশ্বনন্দিত কোনো মনীষীই তা করেননি। সুতরাং ভূতগিরি বা গোস্টিং করতে গিয়ে সেরা পণ্ডিত, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকদের কাছে একাধারে শিক্ষালাভ ও অর্থ উপার্জনের বিষয়টি আত্মরক্ষাপ্রসূত কল্পনাবিলাস বই কিছু নয়।
তবে এ কথা সত্য, ভূতলেখকেরা নামজাদা ব্যক্তিদের আত্মজীবনী-জাতীয় বই লিখতে গিয়ে তাঁদের বিষয়ে এমন সব চাঞ্চল্যকর খবরাখবর পেয়ে যান, যা এক অর্থে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের মতো ঘটনাই বটে। সে ক্ষেত্রে অর্থ উপার্জনের বাইরে ভূতগিরির অন্য প্রাপ্তি হচ্ছে, বিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্ষমতাধর বা খ্যাতিমান মানুষজনের সংস্পর্শে আসা এবং তাঁদের সম্বন্ধে নিবিড়ভাবে তাঁদের জানা।
একজন ভূতলেখক নিজের অভিজ্ঞতার বয়ান দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, তাঁকে একবার মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। থাকা-খাওয়া, আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা সাত তারকা হোটেলে। উদ্দেশ্য এক ধনাঢ্য বৃদ্ধের শেষ ইচ্ছা পূরণে তাঁর জন্মদিনে এই ভূতকে ‘সারপ্রাইজ’ হিসেবে উপস্থাপন করা, যাঁর আত্মজীবনী লেখার প্রকল্পে বৃদ্ধের নাতি-নাতনিরা তাঁকে ভাড়া করছেন।
ভূতলেখকের কাজে নিজের জ্ঞানগম্যি বা আমিত্ব ফলানোর সুযোগ নেই। এ কাজের মূল সার্থকতা যিনি তাঁকে ভাড়া করেছেন তাঁর জবানিতে তাঁকে যতটা সম্ভব ‘অথেনটিক’ বা মূলানুগভাবে উপস্থাপন করা—তাঁর চিন্তাভাবনা, কল্পনাশক্তি, বলার ভঙ্গিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে লেখার প্রস্তুতি নেওয়া, যাতে বইটা যে তাঁরই লেখা—এ ধারণায় কোনো ফাঁকফোকর থেকে না যায়। এদিক দিয়ে কাজটা বলার অপেক্ষা রাখে না, সহজসাধ্য নয়।
গোস্টিং বা ভূতগিরি কি বেআইনি? প্রমাণসাপেক্ষে যেকোনো ধরনের অনৈতিক কাজ বা জোচ্চুরির মতো এ-ও বেআইনি হতে বাধ্য, যদিও এটা নির্ভর করে দেশে দেশে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থার ওপর।