প্রান্তজনের সখা

>

শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬—২৫ জানুয়ারি ২০১৮)  ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২
শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬—২৫ জানুয়ারি ২০১৮) ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২

আমৃত্যু তিনি লিখেছেন নিম্নবর্গের মানুষকে নিয়ে। কথাশিল্পী শওকত আলী প্রয়াত হয়েছেন সম্প্রতি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ আয়োজন

১৯৭৯ সালের কথা। স্কুল ছেড়ে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি জগন্নাথ কলেজে। সাহিত্যের প্রতিটি ক্লাসেই নিয়মিত উপস্থিত থাকি। প্রতিদিনই দেখি প্যান্টের ওপর হাফশার্ট পরে কলেজে আসেন আমাদের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। গায়ের রংটি কালো, কাঁচা-পাকা চুলের মানুষটির ঋজু দেহ, নিম্নকণ্ঠ এবং কলেজে খুবই জনপ্রিয় তিনি। তাঁর পায়ে স্যান্ডেল, কাঁধে ঝোলানো থাকে মোটা কাপড়ের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। ভালো করে লক্ষ করলে লম্বা খাড়া নাকসমেত তাঁর চেহারার অনন্যতায় চোখ না আটকে যায় না। কথাশিল্পী শওকত আলী। ১৯৬৫ সাল থেকে এই কলেজে পড়াচ্ছেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন, চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ শক্তি, তাঁর সারল্য—সব নিয়ে এমন এক ব্যক্তিত্ব যে অল্প দিনেই স্যারকে ভালোবেসে ফেললাম। খুঁজে খুঁজে সদ্য পড়ে নিয়েছি তাঁর প্রথম গল্পের বই উন্মূলবাসনা। এগারোটি গল্পের সবগুলোই যে মনে ধরেছিল তা নয়। তবে ওই বয়সেই এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে রংপুর-দিনাজপুরের সাধারণ মানুষের প্রবৃত্তি, তাদের লোভ-কাম-প্রেম, ক্ষুধা ও অবদমন, আশা ও নিরাশার প্রতি কী অসামান্য দৃষ্টি এই লেখকের! পরম মমতায় তিনি তুলে ধরেছেন উত্তরাঞ্চলের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, জ্যোৎস্না আর অন্ধকারের ধুলামাটি আর কাদামাখা জীবন। তাঁর গল্পের মানুষেরা ওই অঞ্চলের রহস্যময় প্রকৃতির মতোই যেন মাটি আঁকড়ে থাকা আদিম ও বন্য মানুষ। আর লেখায় এই আদিম-বন্যতার উপস্থাপনাই কখনো কখনো রূপ নিয়েছে যৌনতায়; এবং তা হয়ে উঠেছে অনিবার্য। তাঁর গল্পের মানুষ ও প্রকৃতিকে তাই ছিঁড়ে আলাদা করারও জো নেই। শওকত আলীর লেখকসত্তার পরিচয়টি ওই বই পড়ার পর থেকেই আমার মনের মধ্যে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। অনার্সে উঠতে উঠতেই তখন পড়ে ফেলি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ লেলিহানসাধআর উপন্যাস যাত্রা

শওকত আলী শ্রেণিসচেতন মানুষ, রাজনৈতিক অনুসন্ধিৎসা, ইতিহাস আর ঐতিহ্যচেতনা তাঁকে সজাগ রেখেছে আমৃত্যু। অল্প বয়সে জেল খেটেছেন। জীবনের অনেকটা সময়জুড়ে লেখক শিবিরের কর্মকাণ্ডে মন-প্রাণ সমর্পিত ছিল তাঁর। নিরন্তর গ্রামবাংলার পথঘাট চষে বেড়িয়েছেন আর তন্ন তন্ন করে দেখেছেন পুরুষানুক্রমে শোষিত-নির্যাতিত খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বলিষ্ঠ অদম্য বেঁচে থাকার ধরন। কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ওদের দেহ-মনের উত্তাপে নিজের বোধকে করেছেন শাণিত। যে কারণে শিল্পকুশলতার চেয়ে লেখায় ইতিবাচক জীবনের বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর কলমে। একটা সুনির্দিষ্ট সমাজভাবনার আলোতেই তিনি স্পষ্ট করতে চাইছেন তাঁর লেখনীর জগৎকে। লেলিহানসাধ গল্পগ্রন্থের শওকত আলী উন্মূলবাসনার লেখককে অতিক্রম করে গেছেন এখানেই। এরপরই তো ছোটগল্প রচনায় মৌলিক অবদানের জন্য পেলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পরপরই ১৯৭৭-এ পেলেন যাত্রা উপন্যাসের জন্য লেখক শিবির আয়োজিত ‘হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার’।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটে আতঙ্কিত বাবা-মায়ের সঙ্গে আমিও ছিলাম ঢাকায়, লক্ষ্মীবাজারের নন্দলাল দত্ত লেনের একটি বাড়িতে। এক দিন পরই আব্বা আমাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে পাঠিয়ে দিলেন। কী ঘটেছিল সেই রাতে, তার আগে আর পরে? মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১১ বছর পর যাত্রা উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আবার মুখোমুখি হলাম সেই সময়টার। কিন্তু সেটা বড় কথা নয় বরং আশ্চর্য হলাম অন্য এক শওকত আলীর পরিচয় পেয়ে। উন্মূলবাসনা, লেলিহানসাধ-এর সেই লেখকই কী অবলীলায়ই না অন্য একটি জনপদের ভিন্ন রকম এক আখ্যান তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে! ২৫ মার্চ রাতের ঘটনায় আতঙ্কিত, বিমূঢ়, দ্বিধাগ্রস্ত মানুষেরা পালাচ্ছে শহর ছেড়ে গ্রামে। রায়হান নামের মধ্যবিত্ত এক তরুণ কলেজশিক্ষকও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রয়েছেন সেই দলে। কিন্তু প্রতিরোধে শামিল না হয়ে এই পালিয়ে বেড়ানোটাকে তিনি মানতেও পারছেন না কিছুতেই। নিজেকে নিজে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, বোঝাচ্ছেন। বহির্বাস্তব আর অন্তর্বাস্তবের দ্বন্দ্বে, গ্লানি ও নীচতায় ক্ষতবিক্ষত মানুষটিকে যেভাবে রূপায়িত করা হয়েছে তাতে এ-ও মনে হয়েছে ওই চরিত্রের মনোবিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে লেখকের আত্মরূপই বুঝি মূর্ত হয়ে চলেছে বইটির ঘটনা পরম্পরায়। যাত্রাএকদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের মানবিক ইতিহাস, অন্যদিকে তেমনি দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ সময়কে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্তের আত্মমুখী মানসপ্রবণতার অন্তর্গত রক্তক্ষরণের শিল্পিত বিবরণ।

যদ্দুর মনে পড়ে উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষাসফরে যে কটা ঐতিহাসিক স্থানে গিয়েছি, স্যারের অনুসন্ধিৎসু মনের তীক্ষ্ণ সৃজনশীল পর্যবেক্ষণ আমাদের কয়েকজন ছাত্রের মধ্যে অসম্ভব প্রেরণা জুগিয়েছিল। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান আর ইতিহাসে তাঁর আগ্রহের গভীরতায় চমকে যেতাম আমরা। তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি বহুদিন ধরে তিনি কী এক অসাধারণ অন্বেষণে রয়েছেন। কলেজে দেখতাম স্যার প্রায়ই হেঁটে হেঁটে চলে যেতেন আহসান মঞ্জিলের দিকে, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে, ভাস্কর রাশার ডেরায়। সেখানে বাংলার প্রাচীন ভাস্কর্য নিয়ে গভীর গল্পে মেতে যেতেন দুজনে। এ কথা রাশা ভাইয়ের কাছে পরে শুনেছি, গল্পে গল্পে তিনি বুঝি হেঁটে যেতেন সান্ধ্যকালের প্রাকৃতজনদের মধ্যযুগে। যার কেন্দ্র ছিল গৌড়, পুণ্ড্রবর্ধন। শাসনামল ছিল পাল আর সেন রাজাদের। ১৯৮৪-তে প্রকাশ পেল তাঁর প্রদোষেপ্রাকৃতজনউপন্যাস। একেবারে চমক লেগে গেল সাহিত্যপাড়ায়। সংস্কৃতবহুল ও সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহার দিয়ে ধ্রুপদি চালের বিদগ্ধ আনকোরা নতুন বাক্যগঠন প্রক্রিয়ায় লেখা কয়েক শ বছর আগের বাংলাদেশের বাস্তবতা যেন পুনরুজ্জীবিত হয়ে ধরা দিয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। এর বিষয় বিন্যাসের মধ্যে বৃহত্তর ও ক্ষুদ্র জীবনের স্রোত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, ইতিহাসের সৃজনশীল বিনির্মাণ সার্থক হয়ে উঠেছে। এ যেন আবহমান কালের বাংলা ও বাঙালির প্রত্মানুসন্ধান। আর তাতে উদ্‌ঘাটিত হয়েছে অন্ধকারে পড়ে থাকা অন্তেবাসী আমাদের পূর্বপুরুষের নিদারুণ জীবন ও সংবেদনশীলতা।

হাটখোলার কে এম দাশ লেনের শুরুতেই হাতের বাঁ দিকে একটা চারতলা বাড়ি শওকত আলীর। বাড়ির সামনে ছোট্ট খোলা মাঠ। তারই এক প্রান্তে বাড়ির পেছন দিকে গোটা দুই ঝুপড়িঘর। ওই সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোলেই বদরুদ্দীন উমরের বাসা আর একটু এগোলে বোগেলভেলিয়ায় আচ্ছন্ন গেট পার হয়ে খোলা প্রান্তরের ওপারে হলুদ একতলা পুরোনো ধাঁচের বাড়িতে থাকেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ডানে মোড় নিলেই দেখা যায় আমার স্কুলের এক সহপাঠীর বাবা চিত্রশিল্পী শফিউদ্দীন আহমেদের বাড়ি। এ পথে আমার কত যে আসা-যাওয়া! শওকত স্যারের বাসায় গেলেই দেখি সিঁড়িতে, বারান্দায় খেলা করছে অনেকগুলো শিশু। তাদের কেউবা ন্যাংটা, কারও পরনে প্যান্ট আছে তো উদোম শরীর। নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে। কুকুর আর বিড়াল নিয়ে মেতে আছে কেউ কেউ। কৌতূহল মেটাতেই একদিন ভাবিকে জিজ্ঞেস করি, এরা কারা? মুচকি হেসে তিনি বলেন, তোমার স্যারের পোষ্যি।

ওদের বাবা-মা দিনের বেলায় এখানে-ওখানে কাজ করে আর রাতের বেলা দল বেঁধে স্যারের বাসায় খায়। ঠাটারি বাজারের কাছে জয়কালী মন্দির লাগোয়া একটা দোকানে প্রায়ই আমরা আড্ডা দিই। মাঝেমধ্যেই দেখি রিকশার পাদানিতে দেড়মণি একটা চালের বস্তা রেখে সিটের ওপর কোনোমতে বসা লুঙ্গি পরা শওকত স্যারের ডান হাতে সদাই ভর্তি বিশাল চটের ব্যাগ আর বাঁ হাতে ধরা গোটা চারেক মোরগের ঠ্যাং। স্যারের ঘন ঘন এই পরিমাণ বাজার করার রহস্য এত দিনে পরিষ্কার হলো।

জগন্নাথ কলেজে আমাদের ছাত্রজীবন শেষ হলে স্যারের সঙ্গে আর নিয়মিত যোগাযোগ রইল না। মাঝেমধ্যে যেতাম, তা-ও ক্ষীণ হয়ে এল একসময়। ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কলম চলছিল তাঁর। অবিরাম না হলে বত্রিশটি উপন্যাস আর পাঁচটি গল্পগ্রন্থসহ আরও অনেক রকম লেখার বিশাল ভান্ডার গড়ে ওঠে কী করে?

পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর অনেক লেখাই পড়েছি কিন্তু লেখালেখির অন্তিমে এসেও উপন্যাস নাঢ়াই-এ-ও দেখি শওকত আলী তাঁর নিজ মহিমায় হাজির থেকেছেন। শিল্পী একসময় তো নিজের গড়া বৃত্ত নিজেই ভাঙেন কিন্তু শওকত আলী তা করেননি, যতখানি সম্ভব আভরণহীন থেকেছেন, সরল করতে চেয়েছেন লেখনীকে। নাঢ়াইউপন্যাসটিতে লোভ, লালসা, সম্পদ, আর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের নানান চক্রান্তের বিরুদ্ধে আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিধবা ফুলমতির লড়াই একপর্যায়ে একাকার হয়ে যায় গরিব কৃষকের তেভাগার লড়াইয়ের সঙ্গে। এই ‘নাঢ়াই’ বা লড়াইয়ের যে বিস্তৃতি তারই রূপায়ণ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। উপন্যাসের মানুষজন, পটভূমি, কাহিনি, সংলাপ—সবই আঞ্চলিক ও গভীরভাবে মাটিলগ্ন। নাঢ়াইতে তিনি মৌখিক ও প্রাকৃতভাষাকে অসাধারণ দক্ষতায় প্রমিত ভাষার মান্যতা দিতে পেরেছেন। একটি উপভাষা তুলে এনে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা ভাষার বৈচিত্র্য।

বিষয় আর আঙ্গিক নিয়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে ষাটের দশকে আধুনিকায়নের যে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঢেউ লক্ষ করা গেছে, সেই প্রথম ঢেউয়ের ঝাপটাতেও শওকত আলী মাটি আঁকড়ে থেকেছেন, সেই আধুনিকতার তরঙ্গে গা ভাসাননি কিছুতেই। শওকত আলীর এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘শওকত আলীকে আমার কখনো কখনো মনে হয় শাক্ত সন্ন্যাসী, রক্তই তাঁর কাছে সবচেয়ে দামি। তাঁর লেখায় গরিবের ঘামই মিশে থাকে না, রক্তের আঁশটে গন্ধও ঘ্রাণে পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি ধরে থাকেন কুলবিদ্যার মতো তাঁর সেই জনজীবনের কঠিন মাটি।’