আবার জমবে মেলা...

লেখিকা
লেখিকা

শিরোনামের গানটি যারা প্রবাসে এসে শুনেছেন, তাদের বেশির ভাগই নতুন এক ধরনের আবেগের মুখোমুখি হয়েছেন বলে আমার ধারণা। আজ থেকে দুই বছর আগে ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে যখন ভিক্টোরিয়া এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিলাম, তখন বুঝেছিলাম দেশের সঙ্গে সংযোগটা শিথিল হয়ে গেল হয়তো দীর্ঘ সময়ের জন্য।

ছোট্ট, ছিমছাম ও প্রায় জনশূন্য এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর ট্যাক্সিতে করে শহরে আসার পথে দুই পাশের বিরান প্রান্তর, বনানী ঘেরা লেক, অচেনা গাছের সারি দেখে মনে হচ্ছিল জনমানবহীন এই তল্লাটে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে না।
অনুমানটা মেলেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করার পর দু-একজন বাংলাদেশি সহপাঠী পেলাম। তারা অন্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী হলেও যোগাযোগ তৈরি হলো। তখনো জানতাম না ভিক্টোরিয়ায় শতাধিক বাংলাদেশি বাস করেন এবং তারা বাস করেন একটা বৃহৎ পরিবারের মতো। সে পরিবারের সদস্য হতে আমাকে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়নি।
২০১৫ সালের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম। দেখলাম বাংলাদেশে ফেলে আসা স্বজনদের মতো পরস্পরের আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে তারা বসবাস করেন কানাডার এই প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী দ্বীপে। যার অন্য নাম ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ড। এই দ্বীপে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সংগঠন ‘কানাডা বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ইন ভিক্টোরিয়া’ প্রায় সব সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতীয় দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এবারের পয়লা বৈশাখও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
জাতি হিসেবে আমাদের শৌর্য-বীর্য-সমৃদ্ধির ইতিহাস যতটা দীর্ঘ সংস্কৃতির ঐতিহ্য তার চেয়েও অনেক লম্বা। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণের সময় এই ভূখণ্ডে গঙ্গারিডই নামে আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা বাস করত, আড়াই হাজার বছর পার করেও আমরা তাদের সংস্কৃতি থেকে খুব বেশি দূরে সরে যাইনি। এর কারণ হয়তো হিমালয়ের পলিমাটি দিয়ে গড়া কোমল ও সতেজ প্রকৃতির ওপর আমাদের স্বতঃপ্রবৃত্ত নির্ভরতা।
ইউরোপ আমেরিকায় মানুষ বসবাসের জন্য যে কৃত্রিম আবাস গড়ে নিয়েছে তা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটা স্থায়ী বৈরিতাপূর্ণ দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের কাছে প্রকৃতিই এখনো প্রাণ। নদীর কুলকুল ধ্বনি, বর্ষায় ভেসে যাওয়া জনপদ, বান ডাকা জ্যোৎস্না, দখিনা বাতাস, নবান্ন, মধুমাস, সোনালি ফসলের মাঠ, বৈশাখের অগ্নিস্নান এখনো আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে।

নববর্ষ (১৪২৪) উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে সমবেতরা
নববর্ষ (১৪২৪) উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে সমবেতরা

সংখ্যার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় অভিবাসীর দেশ কানাডা। বিশ্বের ১৯০টি দেশের বিভিন্ন গোত্র-বর্ণ-ধর্মের মানুষ অভিবাসী হিসেবে কানাডায় বাস করেন। আমি যতটুকু দেখেছি এখানে বসবাসকারী কোনো দেশের মানুষ আমাদের মতো স্মৃতিকাতর নন। বরং মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত মিশ্র জাতীয়তার সৃষ্টি করেছেন তারা। সেটা ভালো না খারাপ তা বোঝার জ্ঞান আমার নাই। আর সেটা বুঝতেও চাই না। কিন্তু আমরা বাংলাদেশিরা এই দূর পরবাসে যে আমাদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছি সেটা বুঝতে পারি এবং সেটা নিয়ে আমি গর্বিত।
কানাডা আমার দ্বিতীয় প্রবাসজীবন। এর আগে সিঙ্গাপুরে কয়েক বছরের অনিয়মিত একটা প্রবাসজীবন কাটিয়ে এসেছি। এই নগর রাষ্ট্রে যারা বসবাস করেছেন বা বেড়াতে গেছেন তারা জানেন সেখানেও একটা মিনি বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। আমি ভিক্টোরিয়া ও ভ্যাঙ্কুভার ছাড়া অন্য শহরে যাইনি। শুনেছি টরন্টো, মন্ট্রিয়েল ও অটোয়ায় অনেক বড় বাংলাদেশি কমিউনিটি আছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও উৎসব-পার্বণে পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের অনুষ্ঠানাদির খবর পড়ে, ছবি দেখে বুঝতে পারি, কতটা নিবিড় দেশাত্মবোধ নিয়ে তারা প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন।
কানাডা বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ইন ভিক্টোরিয়া সংগঠন হিসেবে নবীন হলেও বাংলাদেশের বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, নববর্ষ, ঈদ—এ ধরনের দিবসগুলো ঘটা করে পালন করে থাকে। তাদের সর্বশেষ আয়োজিত অনুষ্ঠান ছিল নববর্ষ ও পিঠা উৎসব। গত ৭ মে ভিক্টোরিয়া স্কয়াইমল্ট রিক্রিয়েশন সেন্টারে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডে বসবাসকারী প্রায় ৭৫ জন বাংলাদেশি। আয়োজনে ছিল পোলাও, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, মিষ্টান্ন ও বিভিন্ন রকমের পিঠা।
আমাদের যে শিশুরা এই জনবিরল পাথুরে দ্বীপে বেড়ে উঠেছে, বাংলাদেশের সোঁদা মাটির গন্ধ তারা পায়নি। তারা জানে না বাংলাদেশে রাতের আকাশটা আরও গভীর কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। সন্ধ্যা হয় ঝিঁঝি পোকার ডাকে। মধ্য দুপুরে ঘর্মাক্ত মাঝিরা ডিঙা বায়। সবুজ মাঠে ফেরারি বাতাস নেচে যায়। এই শিশু কিশোরদের জন্য এ ধরনের উৎসব কিছু নতুন বার্তা বয়ে আনে। তারা আমাদের ঐতিহ্যগত খাবারের কথা জানতে পারে। সংগীত, নৃত্য, কবিতা, কৌতুকের সঙ্গে পরিচিত হয়।
এবারের অনুষ্ঠানে রুমা, সৈয়দ মুহাম্মাদ নাজিম উদ্দীন ও ফরিদ আহমেদ মনোজ্ঞ সংগীত পরিবেশন করে দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। বরাবরের মতো শিশুদের পরিবেশনাও ছিল মনোমুগ্ধকর। কানাডা বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ইন ভিক্টোরিয়া ঈদুল ফিতরের দিন একইভাবে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। আবার দেখা হবে প্রাণের মেলায়—‘বটতলা, হাটখোলা’। সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় আছি।

নন্দিনী রহমান: রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।