'বাংলাদেশের তরুণদের শিল্পকর্ম প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সমৃদ্ধ'

>

এবারও ঢাকা আর্ট সামিটের শিল্পনির্দেশক ও প্রধান কিউরেটর ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট
এবারও ঢাকা আর্ট সামিটের শিল্পনির্দেশক ও প্রধান কিউরেটর ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট

শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় হয়ে গেল দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক এ চারুকলা প্রদর্শনী ‘ঢাকা আর্ট সামিট ২০১৮’। এ প্রদর্শনীর শিল্পনির্দেশক ও প্রধান কিউরেটরের দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন কিউরেটর ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। প্রথম আলো থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল মাহ্‌মুদ

প্রথম আলো: ঢাকা আর্ট সামিটে দর্শনার্থীদের প্রতিক্রিয়া এবার কেমন দেখলেন?

ডায়না: এক কথায় দুর্দান্ত! এই মুহূর্তে আপনি সেটার নমুনাও দেখতে পাচ্ছেন। পুরো প্রদর্শনীতে মানুষের ঢল।

প্রথম আলো: কিউরেট করার জন্য শিল্পকর্মের সঙ্গে বোঝাপড়াটা কীভাবে করেন কিউরেটরেরা?

ডায়ানা: একজন শিল্পী ও কিউরেটর দুজনের কাজ ভিন্ন। দেখা যায় কোনো শিল্পী প্রয়াত, কেউ কেউ জীবিত। একইভাবে তাঁদের প্রত্যেকের সৃষ্টিকর্মও ভিন্ন। শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাকে শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন। অন্যদিকে একজন কিউরেটরের কাজ সেগুলো দেখভাল করা। একজন কিউরেটরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, কীভাবে সমসাময়িক বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে শিল্পকর্মগুলোতে তুলে ধরতে হবে সেটা ভাবা। একটি প্রদর্শনীতে প্রতিটি শিল্পকর্ম ভিন্ন ভিন্নভাবে অনন্য। সেগুলোর ভাষা অনন্য। আমি শিল্পীদের সঙ্গে এই উদ্যোগে সামিল হয়েছি। আমার কাজই হলো সেগুলো দেখভাল করা। এই সামিটে কিছু অমূল্য শিল্পকর্ম আছে। তবে বাইরের শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে এখানে আসার জন্য আরও কিছুটা আস্থা অর্জন করতে হবে। এ জন্য আরও কিছু সময় লেগে যাবে হয়তো।

প্রথম আলো: তৃতীয়বারের মতো এ সামিটের প্রধান কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করলেন। বাঙালি জাতির শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানলেন কীভাবে?

ডায়ানা: এবারের সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি এখানে এবার অনেক সময় কাটিয়েছি। প্রায় পাঁচ মাস ধরে আছি। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছি। রাঙামাটি গিয়েছি, চট্টগ্রাম গিয়েছি। এমনকি সিলেটও বাদ যায়নি। এখানকার ইতিহাস এবং গানের যে সংস্কৃতি সেটা বোঝার চেষ্টা করছি আমি। বিশেষ করে কবিতা বোঝার চেষ্টা করেছি, যা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখানকার জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের সঙ্গেও আমি দেখা করেছি, কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বাংলায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সারাবিশ্বেই বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে রয়েছে। আমি যেহেতু সারা বিশ্ব ভ্রমণ করি, আমার চেষ্টা থাকবে সেগুলো এখানে নিয়ে আসার।

প্রথম আলো: আর্ট সামিটে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিভুক্ত শিল্পীদের কাজগুলোতে ব্যতিক্রমী উপস্থাপনায় লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি বা আদিবাসীদের সম্পর্কে কীভাবে জেনেছেন?

ডায়ানা: অনেকেই জানে না যে, আমার মা একজন আদিবাসী। ফিলিপাইনের কাছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে একটি দ্বীপ গোয়াম থেকে এসেছেন তিনি।

বাংলাদেশের সবাই বাংলায় কথা বলে। তারা মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন করে। বাংলা ছাড়াও এখানে আরও চল্লিশটির বেশি ভাষা রয়েছে। চাকমা সম্প্রদায়ের কথাই ধরুন। বাংলাদেশ ছাড়াও তারা মিয়ানমার, ভারতেও রয়েছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ। আমি সেখান থেকে শেখার চেস্টা করছি। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বাংলাদেশের মানুষকে একত্রিত করে রেখেছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের তরুণদের সমসাময়িক শিল্পকর্মগুলো সম্পর্কে আপনার মত কী? কাজগুলো কেমন?

ডায়ানা: সমসাময়িক শিল্পকর্ম নিয়ে কাজ করছেন এমন দুর্দান্ত কজন শিল্পী রয়েছেন বাংলাদেশে। তাঁদের এই শিল্পকর্ম বিশ্বের যে কোনো জাদুঘরে প্রদর্শন করার মতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এখানকার তরুণ শিল্পীদের শিল্পকর্মের ক্রেতাও আছে। যদিও এটা সত্য যে, তাঁরা টাকার জন্য শিল্পচর্চা করেন না। আমার কাছে বাংলাদেশের তরুণদের শিল্পকর্ম প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশ সমৃদ্ধ মনে হয়েছে, তুলনামূলকভাবে একটু ভিন্নও বটে। এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই তরুণ শিল্পীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

প্রথম আলো: ‘স্কলারস উইকেন্ড’ বলে যে আয়োজনটি সামিটে রাখা হয়েছিল, সেগুলো কতটা কার্যকর ছিল? কী উপকার হলো?

 ডায়ানা: এখানে সারা বিশ্বের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ মানুষেরা ছিলেন। বাংলাদেশের মেধাবী শিল্পীদেরও আমরা সেখানে দেখেছি। ঢাকা আর্ট সামিটের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, শিল্পীদের জন্য আন্তর্জাতিক সুযোগ সৃষ্টি। একজন আমেরিকান হিসেবে বাংলাদেশের শিল্প-ইতিহাস আমি লিখতে পারব না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের মানুষেরাই তাঁদের নিজেদের ইতিহাস গড়ে তুলবে। আমি নিজে বাংলা জানি না। কিন্তু যা আমি পারি তা হলো, একটা পদ্ধতি দাঁড় করানো। যেটা শিল্পীদের জন্য আন্তর্জাতিক সুযোগ তৈরি করবে।

প্রথম আলো: আপনি তো অনেক চিত্রকর্ম দেখেছেন। আমাদের তরুণদের চিত্রকর্মের ভবিষ্যত কী বলে মনে করেন?

ডায়ানা: কঠিন প্রশ্ন। এ ব্যপারে কিছু বলতে পারব না আমি। কিউরেটর হিসেবে বলতে পারি, এখানে একজন তরুণ শিল্পীর কাজ আমার ভালো লেগেছে। তাঁর শিল্পকর্ম চমৎকার।

প্রথম আলো: সফলভাবে আরও একটি সামিট শেষ করলেন। কী বলবেন এখন?

ডায়ানা: একটা কথা বলি, স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ সফল হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের একত্রিত থাকার ও একে অপরকে সাহায্য করার এই সংস্কৃতি আমার ভেতরে এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করেছে।

ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট

জন্ম ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে। নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে মুম্বাই আর্ট রুম বোর্ডের চেয়ারপারসনের দায়িত্বে রয়েছেন। ফুকুওকা এশিয়া আর্ট মিউজিয়াম ও হেনরি মুর ইনস্টিটিউটের রিসার্স ফেলো তিনি।