একুশে ফেব্রুয়ারির টার্নিং পয়েন্ট

>

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক

বইমেলায় প্রকাশিত বই লেখার নেপথ্য কাহিনি নিয়ে এই আয়োজন, লিখেছেন লেখক নিজেই

‘একুশ আমার গর্ব, একুশ আমার অহংকার’—এমন সব কথা হরহামেশা শোনা যায়। একুশ তথা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে একাধিক হাতে বই লেখা হয়েছে। আমিও লিখেছি। এসব তৎপরতা ফেব্রুয়ারি মাস এলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

বছর দুই আগে প্রথম আলো থেকে একুশে নিয়ে লেখার আমন্ত্রণ, ফেব্রুয়ারির একুশ দিনে একুশে নিয়ে লেখার জন্য। কী লিখব এবার। আগের বছর শহরে-গ্রামেগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের বিস্তার নিয়ে লিখেছি। এবার ভাবনা, একুশের ঘটনাবলি ও একুশের ইতিহাস থেকে ভিন্ন কী খুঁজে বের করা যায়, যা পাঠকদের পছন্দসই হবে। অথচ গতানুগতিক পুরোনো ইতিহাসের পুনরুক্তি হবে না। থাকবে ভিন্ন ধরনের কথা, কিন্তু তা একুশের প্রকৃত ইতিহাসের বাইরে নয়।

ইতিহাস-রাজনীতি নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লেখার সুবাদে একটি তাৎপর্যময় শব্দ, ইংরেজি শব্দ বারবার আমাকে আকর্ষণ করেছে। ‘টার্নিং পয়েন্ট’ শব্দটির জুতসই বাংলা ব্যবহার আমার অনেক লেখায় ধরা আছে। ইতিহাসের তাৎপর্যময় বাঁকফেরা বা সন্ধিক্ষণ, সন্ধিস্থল বা ক্রান্তিলগ্নরূপে নানা ভাষ্যে শব্দটির প্রকাশ ঘটেছে আমার একাধিক লেখায়।

এসব ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো, ভাষা আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস-কাহিনির তাৎপর্যপূর্ণ, বাঁকফেরা মুহূর্তের ঘটনাগুলো তো আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। ভাষা আন্দোলনের এসব ক্রান্তিক্ষণের ঘটনা এ পর্যন্ত কেউ লেখেননি। এগুলোকে সঠিক গুরুত্বে ও তাৎপর্যে তুলে ধরেননি। এগুলো নিয়ে দিনলিপির মতো করে লেখা যায়। ব্যস, মুশকিল আসান।

কারণ ভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে একুশের বিস্ফোরক আন্দোলনে এ রকম ক্রান্তিকালীন ঘটনার অভাব নেই। অগ্নিকণার মতো ছোট ছোট ঘটনা যেমন এই পর্বে, তেমনি এর আগেও ঘটেছে। অনেকটাই অভাবিত, অপ্রত্যাশিত ঘটনার অগ্নিকণা আন্দোলন তৈরিতে অনুঘটকের চেয়েও গুরুতর ভূমিকা পালন করেছে। সেগুলোকে চিহ্নিত করে কিছুটা বিশদ বিবরণে প্রকাশ ভাষা আন্দোলনবিষয়ক মনোযোগী পাঠকের জন্য উপাদেয় ও উপভোগ্য হবে বলে মনে হয়েছে।

একুশের মুহূর্তগুলো: আহমদ রফিক। প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল। প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৭, পৃষ্ঠা: ৮০, দাম: ১৬০ টাকা।
একুশের মুহূর্তগুলো: আহমদ রফিক। প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল। প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৭, পৃষ্ঠা: ৮০, দাম: ১৬০ টাকা।

দুই

আমার এই ভাবনা নিয়ে কথা বলি প্রথম আলোর দুজন সাংবাদিকের সঙ্গে। তাঁদের একজন সিনিয়র, আমার ঘনিষ্ঠজন। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীজন মেধাবী-মননশীলতা ও বয়সের কারণেই বোধ হয় তাঁর একটু দ্বিধা, সংশয় ও সামান্য খুঁতখুঁতানি। ‘এতে কি ফেব্রুয়ারির একুশ দিনের খোরাক মিলবে?’ তাঁর প্রশ্ন। তাঁকে আশ্বস্ত করি, হ্যাঁ, মিলবে। সে দায়িত্ব আমার। প্রয়োজনে ভাষা-বিতর্কের সময় পরিসরটিকে কিছুটা বাড়িয়ে নিলেই চলবে।

তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। আরও কিছুক্ষণ এ বিষয়ে আলোচনার পর সংশ্লিষ্টজনের দ্বিধা কেটে গেলে বিষয়টির যোগ্যতা নিয়ে আস্থা অনেক বেড়ে গেল। নির্ভার মনে তাঁরা উঠলেন। কিন্তু এবার আমার দিক থেকে দুশ্চিন্তা শুরু হলো। সত্যি একুশ দিনের উপযোগী এতগুলো ঘটনার কি খোঁজ মিলবে একুশের ইতিহাসে? মিলবে, যদি ভাষা-বিতর্কের, অর্থাৎ বাংলা ভাষার ব্যবহারবিষয়ক পটভূমিতে ইতিহাসকে প্রসারিত করা যায়। আর সেটা মোটেই যুক্তিহীন হবে না, কারণ বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক তো আজকের নয়। এর সূচনা সৈয়দ সুলতান থেকে আবদুল হাকিম প্রমুখ একাধিক কবির। নেপথ্যে কাজ করেছে ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব। সেসব রক্ষণশীলতা, সীমাবদ্ধতা জয় করেই তাঁদের শৈল্পিক যাত্রা।

লেখা শুরু করতে গিয়ে দেখা গেল ক্রান্তিক্ষণের ঘটনা কম নয়। কোনোটি ছোট, কোনোটি বড় ঘটনা। কিন্তু আন্দোলনে জ্বালানিশক্তি জোগাতে কোনো দিক থেকে কেউ কম শক্তিমান নয়। কখনো একই রকম একটি সাদামাটা ইশতেহার—যেমন ১৯৫১ সালের ১১ মার্চের আন্দোলন দিবসটি স্মরণে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানানো ইশতেহারটি বাস্তবিক শহর ঢাকায় এবং অন্যত্র বেশ ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিল।

এভাবে তর্কের পর এক অনুঘটকধর্মী ঘটনার পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয় ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর ইতিহাসচর্চায়। বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা মস্তিষ্ককোষে ঘণ্টা বাজাতে থাকে। সহজ হয়ে ওঠে লেখার কাজ। একুশের বিশেষ মুহূর্তগুলো একে একে সামনে এসে দাঁড়ায়। একুশের চেতনার ছাপ পড়তে থাকে পাণ্ডুলিপিতে। সেই সঙ্গে কয়েকটি একুশে অর্থাৎ ‘শহীদ দিবস’ উদ্‌যাপন অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। এদের মধ্যে দু-একটি নেতিবাচক হলেও লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকেনি। অবিশ্বাস্য নয়, নীতির প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিস্থিতির প্রকাশ। এমনটি ইতিহাসে মাঝেমধ্যে ঠিকই ঘটেছে।

বিগত বছরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির দিনগুলোর ক্রান্তিক্ষণের ধারণা নিয়ে ‘একুশের মুহূর্তগুলো’রূপে প্রথম আলোয় প্রকাশ পেতে থাকে। অবশ্য সুনির্দিষ্ট হিসেবে পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এসব লেখার কোনো কোনোটি নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রকাশও জেনেছি।

হয়তো তাই লেখক-প্রকাশকের যৌথ আগ্রহে ‘একুশের মুহূর্তগুলো’র বই আকারে প্রকাশ। একুশের ইতিহাস থেকে ভিন্নমাত্রিক ঘটনার প্রকাশনা পাঠক কীভাবে নেবেন, সেটা নির্ভর করে তার মেজাজ-মর্জি ও রুচির ওপর। লেখক হিসেবে এটুকু বলতে পারি, যেকোনো ইতিহাসের ধারায় ছোটখাটো শিলালিপিও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে।