যে কথা বলা হয়নি

>

সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন

বইমেলায় প্রকাশিত বই লেখার নেপথ্য কাহিনি নিয়ে এই আয়োজন, লিখেছেন লেখক নিজেই

১৯৭১ সাল। মার্চ মাস। সাত তারিখ। সেদিন বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বসে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ ভাষণটি শুনেছিলাম, সে সময় ভাবিনি সাতই মার্চের বিকেল নামে কোনো উপন্যাস আমি লিখতে পারব। ঠিক এর পরপরই অবশ্য ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে কিছু লিখব, কিন্তু কী লিখব তা জানতাম না। এসেছিল। তো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হলে মাঠ থেকে আমরা ফিরছিলাম স্বাধীনতার স্বপ্নের মগ্নচৈতন্যে বলীয়ান হয়ে। আমার সঙ্গে ছিল নমিতা স্যান্যাল, আমাদের বন্ধু। আমাদের সবারই সেদিন মনে হয়েছিল, পিছু হটার দিন আর নেই। সামনে যুদ্ধ। জীবনমরণ লড়াই।

অসাধারণ ওই ভাষণটি মাথায় নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি মাঠে। ভেবেছি ভিড় কমলে বের হব। মেয়েদের জন্য বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করা একটি জায়গা ছিল মঞ্চের কাছে। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন সেখানে, আমি ছিলাম তাঁর কাছাকাছি। খালাম্মার সঙ্গে কথা বলে বের হই একটু পরে। সামনে পড়ে একজন বাদামবিক্রেতা। বলে, ‘আপা, বাদাম কেনেন।’ ‘ঠিক আছে, দেন’ বলে আমি দাঁড়াই লোকটির সামনে। আমার হাতে বাদাম দিয়ে সে বলে, ‘মুইছা গেছে, মুইছা গেছে পূর্ব পাকিস্তান।’

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে লোকটির দিকে তাকাই আমি! নিজেও তো জানি, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে একবারও পূর্ব পাকিস্তান বলেননি। বাংলা, পূর্ববাংলা, বাংলাদেশ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ সেই মাঠে দাঁড়িয়ে বাঙালির জন্য এমন অবিনাশী কথা আর কী হতে পারে। এর মধ্যে বাদামবিক্রেতার দিকে তাকালে দেখতে পাই তার উজ্জ্বল হাসিমুখ।

নতুন স্বপ্নে রাস্তায় পা বাড়াই আমি ও নমিতা। যেতে যেতে নমিতা আমাকে বলল, ‘শুনলি ছেলেটার কথা?’

বললাম, ‘এই অসাধারণ ভাষণে বঙ্গবন্ধু মানুষকে একেবারে জাগিয়ে দিয়েছেন।’

নমিতা বলল, ‘ললনা পত্রিকায় তুই যে কলাম লিখিস, সেখানে এটা উল্লেখ করিস।’

বললাম, ‘এই ভাষণের অনেক পঙ্‌ক্তি আমার মাথায় গেঁথে গেল। ভবিষ্যতে এই ভাষণ নিয়ে লিখব।’

‘কী লিখবি?’

‘এখনো জানি না কী লিখব।’

আমি ও নমিতা দুজনে হেঁটে বাংলা একাডেমির সামনে এলাম। এটি আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান, আমার কর্মক্ষেত্র। ১৯৭০-এর জুলাই মাসে এখানে যোগদান করেছি আমি। এই তো গেল ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ যেসব বিদেশি বাংলা শিখেছেন, তাঁদের সনদ দিতে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বাংলা একাডেমিতে। সেদিনই প্রথম আমি তাঁকে স্বচক্ষে দেখি। তাঁর ভাষণ শুনি।

মনে পড়ে, বর্ধমান ভবনের সামনের বটতলায় সেদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সে সময় বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখা এবং সাত মার্চের ভাষণ শোনার যোগসূত্র আমার সামনে দেশ-জাতির নানা মাত্রার দরজা খুলে দিল যেন। আর ওই বাদামবিক্রেতার মুখচ্ছবিটিও গেঁথে থাকল আমার চিন্তায়। আজ ভাবি, সাতই মার্চের বিকেল-এর নেপথ্যে এ ঘটনাগুলোর ভূমিকাও তো কম নয়।

সাতই মার্চের বিকেল: সেলিনা হোসেন। প্রচ্ছদ: রফিকুন নবী, প্রকাশক: বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৮৪, দাম:৪৭০ টাকা।
সাতই মার্চের বিকেল: সেলিনা হোসেন। প্রচ্ছদ: রফিকুন নবী, প্রকাশক: বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৮৪, দাম:৪৭০ টাকা।

অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন। ললনা পত্রিকায় ‘সংবর্ত’ শিরোনামে যে কলাম লিখতাম, ১৯ মার্চ তাতে লিখলাম, ‘...কেউ তো বোঝেনি শাসিত মানুষের হৃদয়ে এত শপথ প্রদীপ্ত হয়ে আছে। জীবনের সবখানে আজ জীয়নকাঠির ছোঁয়া লেগেছে। ঘুম ভাঙা মানুষের দল পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে জড়তা বদ্ধতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে জাগরণে কণ্ঠ দিয়েছে।...প্রতিটি বাঙালির শপথে দীপ্ত আগুনঝরা হৃদয় আজ একটি হাতিয়ার। বাংলাদেশ সংগ্রামের ভূমি। এ দেশের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আজ আমরা আর একটি নবতর অধ্যায়ের সূচনা করেছি।’

এভাবে স্মৃতির পাতায় আমি গেঁথে রেখেছি সাত মার্চের বিকেলবেলা। কিন্তু উপন্যাসটি লেখার জন্য নিজেকে তৈরি করতে সময় নিয়েছি। কাহিনির গঠন, গল্প তৈরি করা নিয়ে ভেবেছি। এর মধ্যে একটি গবেষণাপ্রবন্ধ হাতে এল, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ বিষয়ে। প্রবন্ধটি পড়ার পর মনে হলো, এই সব বীর নারীকে রমনা রেসকোর্স ময়দান থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনব। নারী শুধু সম্ভ্রম হারানোর কারণে যুদ্ধের ইতিহাসে চিহ্নিত হবে না। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে বীর নারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু সমাজের অপরিশীলিত চিন্তার কারণে তাঁরা সমাজে প্রকৃত জায়গাটি পাননি। তো, ভাবনার ভেতরে গেঁথে রাখি বিষয়।

একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে জানতে পারি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা সাত মার্চের বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তুমি ১৫ মিনিট শুয়ে থেকে ভেবে নাও তুমি কী বলবে। এই সব উপাদান হাতে পেয়ে অবশেষে আমি উপন্যাসটি লেখার প্রস্তুতি নিলাম ২০১৫ সালে। কাহিনি তৈরির লক্ষ্য ছিল রেসকোর্স মাঠ থেকে যুদ্ধের ঘটনা। যুদ্ধের নানা দিক বর্ণনার জন্য আমার স্বামী আনোয়ারের কাছ থেকে সহযোগিতা নিলাম। আনোয়ার ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিল। ফলে যুদ্ধে ওর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার খুব কাজে লেগেছে।

সাতই মার্চের বিকেল উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষ। উপন্যাস শুরু হয় বঙ্গমাতাকে দিয়ে—ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে কীভাবে তিনি দেখেছিলেন দেশজুড়ে সাত মার্চের সেই বিকেলের চিত্র। আর উপন্যাসটি শেষ হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের সাত মার্চের বিকেলে রমনা রেসকোর্স মাঠে আবার এসে দাঁড়ায় নায়ক-নায়িকা। ওদের সঙ্গে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষ। ওরা পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনে গর্ভবতী নায়িকাকে বলে, ‘তুমি আমাদের মাতৃভূমি, তুমি আমাদের স্বাধীনতা, তোমাকে সালাম করি।’

এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান—এ-সম্পর্কিত নানা কিছু পড়েছি। কাজে লাগিয়েছি নিজের অভিজ্ঞতা আর কল্পনাশক্তি। সাতই মার্চের বিকেল-এর গল্প তো এভাবেই গড়ে উঠেছে।