উদ্বাস্তু মানুষের মনের খোঁজে

>

আহমাদ মোস্তফা কামাল
আহমাদ মোস্তফা কামাল

বইমেলায় প্রকাশিত বই লেখার নেপথ্য কাহিনি নিয়ে এই আয়োজন, লিখেছেন লেখকে নিজেই

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে এ দেশে আসা বাস্তুচ্যুত কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। দেখেছিলাম, যারা জন্মভূমি ছেড়ে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে এখানে এসেছিল, তাদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ। এক ভাগ এখানে জমি কিনে বাড়ি করে থিতু হয়েছে, আরেক ভাগ যেকোনো কারণেই হোক বাড়ি করতে পারেনি। এই দ্বিতীয় ধরনের মানুষেরা সারা জীবন শুধু ভেসে বেড়িয়েছে। এ ধরনের ভাসমান, গৃহহীন, ঠিকানাবিহীন মানুষের মনোজগৎ কেমন হয়, তা নিয়ে দারুণ কৌতূহল ছিল আমার। খুব কাছ থেকে তাদের দেখেছি, দেখেছি তাদের জীবনযাপন, বুঝতে চেয়েছি তাদের মন। সেসব জানতে গিয়ে দুটি ব্যাপার খুব দাগ কেটেছিল মনে। প্রথমত, তাদের ভেতরে রয়েছে দেশ হারানোর এক দিগন্তব্যাপী হাহাকার; দ্বিতীয়ত, এ দেশে তাদের যেমন কোনো ঠিকানা নেই, তেমনি নেই কোনো স্বজনও, আর তাই পরিবারের সদস্যরা প্রাণপণে নিজেদের আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়—যেন সারাক্ষণই হারিয়ে ফেলার ভয় তাদের তাড়িয়ে নিচ্ছে! আমার নিরুদ্দেশ যাত্রা উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে তেমনই একটি পরিবার, এক বড় অংশজুড়ে তাদের জীবনযাপন আর মনোজগতের ছবি আঁকতে চেয়েছি। উদ্বাস্তু হলেও এই পরিবারের সবাই প্রাণপণে চেষ্টা করে যায় এ দেশেরই অংশ হয়ে ওঠার; একজন মুক্তিযুদ্ধে যায়, আরেকজন অংশ নেয় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, আরেকজন এ দেশের নিসর্গের সঙ্গে গড়ে তোলে এক নিবিড় ও আত্মিক সম্পর্ক। আর তাদের কথা বলতে গিয়েই এসেছে আরও অনেক চরিত্র, এসেছে নানা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ: দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, বাস্তুত্যাগী মানুষের হাহাকার, নতুন দেশে টিকে থাকার সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, ফের দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ, আবার দুর্ভিক্ষ, সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি।

এত রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এলেও কোনো রাজনৈতিক বা ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস লিখতে চাইনি আমি। চেয়েছি ব্যক্তি-মানুষের গল্প বলতে, ব্যক্তি-মানুষকেই কেন্দ্রে রাখতে, তাদের বিষাদ ও বিপন্নতা, আনন্দ ও বেদনা, বিষণ্নতা ও নিমগ্নতার ছবি আঁকতে।

এটা সত্যি যে এই উপন্যাসের এক প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন এবং নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের ছবি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন আমি কাছ থেকেই দেখেছিলাম। সেই সময়ের তরুণেরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। অনেক দিনের সাধ ছিল, এই বীরোচিত প্রতিরোধের গল্প লিখব কোনো একটি উপন্যাসে। কিন্তু ইতিহাসের কোনো এক পর্ব নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলে সমস্যায় পড়তে হয় লেখকদের। যেহেতু ঘটনাগুলো খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা বেঁচেবর্তে আছেন এখনো, তাই ঔপন্যাসিকের পক্ষে অবাধ কল্পনার জগতে বিচরণ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। সেই ঝুঁকি এড়াতে অনেকেই ডকুমেন্টেশনের পথ বেছে নেন। উপন্যাসে তুলে দেন ইতিহাস বইয়ের পাতা, সংবাদপত্রের কাটিং ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে এ রকম উপন্যাস বেশ কিছু লেখা হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডকু-ফিকশন’। একজন লেখক ডকু-ফিকশন লিখতেই পারেন, কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি এ ধরনের উপন্যাস গ্রহণ করতে পারিনি। মনে হয়েছে, ইতিহাস জানতে হলে ইতিহাসগ্রন্থই পড়ব, উপন্যাস নামের ডকু-ফিকশন কেন? যেহেতু পাঠক হিসেবে এগুলোকে গ্রহণ করার ব্যাপারে আমার দ্বিধা আছে, তাই আমি ওই পথ পরিহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম, আমি উপন্যাসই লিখব, ডকু-ফিকশন নয়। তথ্যের ভারে উপন্যাস যেন জর্জরিত হয়ে না যায়, খুব সচেতন থাকতে হলো সে বিষয়ে। কিন্তু তাতেও সমস্যা কাটল না। দুটি বিপরীত মেরুর বিষয় আমি এক উপন্যাসে মেলাতে চাইছি, ব্যাপারটা সহজ নয়। হ্যাঁ, দেশভাগ যেমন রাজনৈতিক বিষয় আর দেশত্যাগ করা কিংবা বাস্তুচ্যুত হওয়া সেই রাজনীতিরই বিষফল; তেমনি সামরিক শাসন আর এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনও রাজনৈতিক বিষয় এবং এর ফলে তছনছ হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন হলো তার ফলাফল—তবু দুটি বিষয় এক নয়। দেশত্যাগ বা বাস্তুচ্যুত হওয়ার মধ্যে, ঠিকানা না থাকা বা ভাসমান জীবনের মধ্যে একটা গভীর বিষাদ থাকে, থাকে অশ্রুসজল বেদনা, করুণ অসহায়ত্ব, কেবল কোনো রকমে টিকে থাকার সংগ্রাম, আশ্রয়হীনতার দুর্বহ বেদনা আর তাদের বুকের গভীরে থাকে দ্বন্দ্ব, ক্ষরণ, প্রশ্ন—এই দেশ কি তাদের? যেখানে কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, স্বজন নেই, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, সেই দেশ নিজেদের হয় কীভাবে? দেশ মানে আসলে কী? তাহলে যে দেশ ছেড়ে এসেছে তারা, সেটি কি তাদের? তা-ও তো নয়! ওখানেও যে কিছু নেই। তাহলে কোনটা তাদের দেশ? এ রকম হাহাকারময় প্রশ্ন তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় এবং এসব নিয়ে ভাবতে গেলে মনটা কোমল আচ্ছন্নতায় ভরে ওঠে, হৃদয় আর্দ্র হয়, চোখ হয়ে ওঠে অশ্রুতে পূর্ণ। অন্যদিকে সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে থাকে তারুণ্যের তীব্র প্রাণশক্তি, একরোখা দেশাত্মবোধ, দেশকে বাঁচাবার গভীর-আন্তরিক-একান্ত প্রতিজ্ঞা, থাকে দ্রোহ-প্রতিবাদ-ক্রোধ-ক্ষোভ। এই দুই ব্যাপার তো একসঙ্গে যেতেই চায় না। তবু তাদের এক বিন্দুতে মেলানোর চেষ্টা করে গেলাম। আরেকটি ব্যাপারও ছিল। উপন্যাস তো কেবল ঘটনার বর্ণনা নয়, এর একটা নান্দনিক দিকও থাকতে হয়। পড়তে গিয়ে পাঠকের নান্দনিক তৃষ্ণা যদি না-ই মেটে, তাহলে তো মন থেকেই হারিয়ে যায় সেই উপন্যাস।

নিরুদ্দেশযাত্রা: আহমাদ মোস্তফা কামাল। প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা:৩৬৮, দাম:৫৬০ টাকা।
নিরুদ্দেশযাত্রা: আহমাদ মোস্তফা কামাল। প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা:৩৬৮, দাম:৫৬০ টাকা।

লেখা শুরু করার আগে এসব ভাবছিলাম বহুদিন ধরে। বহুদিনের ভাবনা-চিন্তার পর লিখতে শুরু করেছিলাম ২০১২ সালে। তখনো জানি না, উপন্যাসটি ঠিক কত দূর পর্যন্ত ডালপালা মেলবে। এক-চতুর্থাংশ লেখার পর হঠাৎ এক বিপর্যয়ে থেমে গেল লেখা। বেশ কিছুদিন বন্ধ্যা সময় পার করে আবার লেখায় ফিরলাম ঠিকই, কিন্তু উপন্যাস আর এগোয় না। গল্প লিখি, প্রবন্ধ লিখি, মুক্তগদ্য লিখি, কিন্তু উপন্যাসটি শেষ করতে না পারার যন্ত্রণা সদাসর্বদা মাথা উঁচিয়ে থাকে। দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে থাকি, মাসের পর মাস। প্রতিদিন টেবিলে বসি, ভাবি, কল্পনায় নির্মাণ করতে চাই অলিখিত গল্পটি, তবে লেখা আর হয় না। ভাবি, এই শেকড়হীন, ভাসমান, বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোকে নিয়ে আমি কী করব? কী পরিণতি তাদের? এই সব মানুষ তো কোথাও পৌঁছায় না, পৌঁছাতে পারে না, তাদের কোনো গন্তব্যই থাকে না আসলে। এসব ভাবতে ভাবতেই মনে হলো, যে স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, এ দেশের তরুণেরা সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেমেছিলেন যে স্বপ্ন নিয়ে, তা তো পূরণ হয়নি। অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক ‘উন্নয়ন’, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য তো অর্জিত হয়নি। গড়া হয়নি একটি উদার-গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল-সাম্যের সমাজ! বরং তার উল্টো দিকেই চলেছে এই দেশ, যেন দেশেরও কোনো গন্তব্য নেই। এই সব ভাবতে ভাবতেই অবশেষে গত বছর, মানে ২০১৭ সালে, আবার মনে হলো, সেই ঘোর, সেই স্রোত যেন ফিরে এসেছে। লিখতে বসে গেলাম, একটানা সাত মাস লিখে তৈরি হলো প্রথম খসড়া। সত্যি বলতে, এই সময়টিতে কী ঘটেছে তা আমি ঠিকঠাক বলতেও পারব না। কীভাবে যে রচিত হয় একটি উপন্যাস, গল্প বা কবিতা; অথবা কীভাবে সৃষ্টি হয় একটি সুর, তা কি সত্যিই বলতে পারেন কেউ? সৃষ্টির মুহূর্ত বড় রহস্যময়, ব্যাখ্যাতীত, প্রায় অধরা; আর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া সম্ভবত ঘোরগ্রস্ততার আরেক নাম। লেখার পর সম্পাদনা করার সময় হয়তো সচেতন হতে হয়, ফিরে তাকালে কিছু যুক্তি-টুক্তিও খুঁজে পান লেখক; কিন্তু এ-ও মনে পড়ে, তাঁর লেখার মুহূর্তে তিনি অনেকখানিই সমর্পিত হয়েছিলেন সেই ঘোরের কাছে, যা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে; নির্ভর করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর, যা ছাড়া গল্প-উপন্যাসের মতো দীর্ঘ রচনা লিখে ওঠা সম্ভবই নয়। সেই ঘোরমত্ততার ভেতরে থাকতে থাকতেই উপন্যাসটি শেষ হলো একসময়। দেখলাম, সে তার নিজের গতিতেই এগিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত এল। দেখা গেল, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক নো-ম্যানস ল্যান্ডে, দেশটাও তাই। সবাই গন্তব্যহীন, সব যাত্রাই নিরুদ্দেশ যাত্রা।