দীর্ঘ কবিতার প্রহর-১

>

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই সময়ের কবি টোকন ঠাকুর কবিতার ভাষায় লিখেছেন তাঁর সমকালীন অনুভূতি

টোকন ঠাকুর
গীতিময় বাংলা কবিতা


চৌদিকে এত শব্দ! শব্দ ছাড়া
শোবার জায়গা নেই আর, অবিরত শব্দের সংসার

শব্দ আসছে, শব্দ যাচ্ছে, শব্দ বলছে, ‘হ্যালো,
যেমন যাওয়ার কথা ছিল, তেমন কি দিন গেল?
যেমন দেখার কথা ছিল, যেমন থাকার কথা ছিল
তেমন কি আজ থাকো? চোখে তারাদের গ্রাম আঁকো?’

শব্দ ভাসছে, শব্দ কাশছে, শব্দ বাঁচতে চায়
শব্দ ঘুমোয়, শব্দ জাগে, শব্দ ওঠে, শব্দ বসে
শব্দ হাঁটে, শব্দ নাচতে চায়
শব্দ তোমার দুধের শিশু, শব্দ তোমার বুকের মধ্যে
লাজুক, হাসতে চায়—
হাসতে হাসতে, হাঁটতে হাঁটতে, নাচতে নাচতে
শব্দ ছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাস আর কি বলো?

সুতরাং এই শব্দশাসিত জীবন ধারণার মধ্যে বসে
লিখতে হচ্ছে ভালোবাসা একটি শব্দ!
দেখতে হচ্ছে, সম্পর্ক নির্ণীত হচ্ছে ভালোবাসা শব্দটির মধ্যে
ভালোবাসা শব্দটি ছাড়া কি আর ভালোবাসা হয় না?
প্রত্যাখ্যান শব্দটি ছাড়া কি প্রত্যাখ্যান হয় না
অন্তরঙ্গ শব্দটি ছাড়া কি আর অন্তরঙ্গতা আসে না?

অপাপবিদ্ধ বলতে বাংলা অভিধানে কী লেখা আছে?
অপাপবিদ্ধ বলতে তুমি কী ধারণা মনে মনে পোষণ করো

ঘর থেকে কি বাইরে যাই, প্রত্যেক দিন
নাকি বাইরে থেকে ফিরি ঘরে?
প্রশ্ন, মাথা কুটে মরে
তবু নৈঃশব্দ্য লিখে কি আমি একার্থ বোঝাতে পারি?
নৈঃশব্দ্য তোমাকে পাহাড়ের গান শোনাবে, সারা দুপুর?
নৈঃশব্দ্য তোমাকে দিনাজপুরের পোড়ো রাজবাড়ি দেখাবে,
একদিন?
নাকি নৈঃশব্দ্য তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেবে
সেই দৃশ্যের মুখোমুখি—
যেখানে সমস্ত কথারা চুপ করে বসে থাকে, কত যে সন্ধে
যেখানে সন্ধের আকাশকেও কী কারণে যেন মনে হয়
বিস্ময় আছে, এখনো তোমাকেও ধরিত্রী বলে ডাকতে পারি
মানুষের চোখের ভেতরে যে বর্ণমালা, যে শব্দ-নৈঃশব্দ্য, যে ভাষা
তা শব্দে আঁটে না, ভালোবাসা কখনোই
ভালোবাসা শব্দটির মধ্যে আঁটে না
স্বপ্ন কত দূর স্বপ্ন শব্দটির মধ্যে আশ্রয় পাই আর?

তবু ব্যাপ্ত শূন্যতা না লিখে আকাশ লিখে ফেলি
অনেক জড়িয়ে থাকার তাৎপর্যে লিখি ভালোবাসা
ভালোবাসা ইটালিক হয়ে যায়
তবু অনেক আহতবোধ লেখ্য হয় না
অনেক মর্মরধ্বনি অনুচ্চারিত থেকে যায়
অনেক ফুলের নাম অজানাই থেকে যায়
অনেক পাখিকে আমরা চিড়িয়াখানায় দেখতে পাই
অনেক নদীর ভাষা টলমল করে চোখের তারায়

অনেক কবিতা অমুদ্রিত থেকে যায়, বালিশের নিচে
পাণ্ডুলিপি রেখে কবি মরে যায়
অনেক শব্দ তার তরঙ্গে পৌঁছাতে পারে না
রেলব্রিজ কেঁপে ওঠে, মানুষেরা আসে আর যায়
রেলব্রিজ মনে হয় অপেক্ষা কমিয়ে দেয়
রেলব্রিজ মনে হয় ছায়া-ছায়া সন্ধ্যা হয়ে আসে
রেলব্রিজ মনে হয় বাংলা কবিতা হয়ে ওঠে
রেলব্রিজ মনে হয় ডাক দেয়, ‘আয়—’

রোদ উঠেছে সকালবেলা, আমি রোদের ভাই
দুপুরবেলা আমিও তখন দুপুর হয়ে যাই
তুমি, নিজের কাছে লুকাও যা, অনির্বচনীয়
আমি তাই

এসব কথাই ভাবতে ভাবতে, লিখতে লিখতে দেখি
বুকের মধ্যে শহর নিয়ে তরুণ কবি হাঁটে
সেই শহরে বিকেল নামে—ছাদে ওঠে বিকেল
বিকেল দাঁড়ায় রেলিং ঘেঁষে, বালিকাব্রতী বিকেল
সেই বিকেল কি শব্দের মধ্যে আঁটে

শব্দ ভাঙে, শব্দ রাগে, রাগে উধাও হয়
শব্দ দিয়েই ও পোড়ামেঘ, তোমার সঙ্গে
আমার পরিচয়
শব্দ যতই সীমিত হোক, অসীমে তার ঝোঁক
হ্যাঁ চেয়েছি, আমাকে সবাই বলুক না হয়
শব্দ ধরা লোক
শব্দ ধরতে নৈঃশব্দ্যে ঘাপটি মেরে একা
লিখে দিচ্ছি মেঘের পরে মেঘগুলো সব
আমার নতুন লেখা—
এই তুমি মেঘ পড়তে পারো?
এই তুমি মেঘ ধরতে পারো?

কবিতা, তোমাকে পড়তে চাই
কবিতা, তোমাকে ধরতে চাই
কবিতা, তোমাকে পড়তে পারে
তোমাকে ধরতে পারে
কবিতা, কবিকে একা রেখে চলে যায় পাঠিকার ঘরে
ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রজাপতি, তাতেই তো
ঘরখানা নড়ে
এদিকে জামার বোতাম ছিঁড়তে থাকে ঝড়ে।

কী বলব যে দুঃখের কথা আর
তুরীয় ঝড়ের শব্দে ভেঙে যায় প্রচণ্ড সংসার
সংসারজুড়ে শব্দ উড়ছে, শব্দ ঘুরছে, ‘হাই,
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ভালোবাসতে যাই—’

ভালোবাসলে বেঁচে ওঠা যায়
ভালোবাসলে নেচে ওঠা যায়
ভালোবাসলে আগুন জ্বলে বুকে
ভালোবাসলে মৃত্যু আসে সুখের

সুখ শব্দটির উৎপত্তি-ব্যূৎপত্তি কিংবা বিস্তার
কাকে বলে তা লিখে লাভ কী
সুখ শুধু পাবার, পাব, মনে মনে
মন রেখে যাচ্ছি মাখামাখির প্রয়োজনে

খর্খরে হাওয়া, তুমি বলে দিয়ো গাছের শুকনো পাতারে
গীতিময় বাংলা কবিতা, বসন্তে সে-ও কীভাবে
কবিকে পুড়িয়ে মারে!