এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর অনধিক ১২ পৃষ্ঠার বিশেষ আয়োজনে ছাপা হয়েছে ‘রাষ্ট্রভাষা না মাতৃভাষা’ শিরোনামে একটি কথোপকথন। শিবব্রত বর্মনের সঞ্চালনায় ভাষাবিষয়ক এই কথোপকথনে ভাষা-বিশ্লেষক, অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক ও মোহাম্মদ আজম যেসব কথা বলেছেন, তার সবকিছু তর্কাতীত নয় কিংবা কিছু বিষয় নিয়ে আরও ভাবনার অবকাশ আছে।
শিরোনাম থেকেই উপলব্ধি করা যায়, আলোচনায় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে ‘রাষ্ট্রভাষা’ ও ‘মাতৃভাষা’র প্রসঙ্গটি। এ বিষয়ে মোহাম্মদ আজমের কয়েকটি পরস্পর-সংলগ্ন মন্তব্যকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। প্রথমত তিনি বলেছেন, ‘যেটা ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সেটাকে আমরা বানিয়েছি মাতৃভাষা আন্দোলন। আপনি চূড়া থেকে পাতালে চলে এসেছেন।’ আমার প্রশ্ন, ‘রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন’ থেকে ‘মাতৃভাষার আন্দোলন’কে শিখর থেকে অবনমন মনে হচ্ছে কেন তাঁর কাছে? এ ক্ষেত্রে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী (মার্চ ১৯৫৩)-তে প্রকাশিত একমাত্র প্রবন্ধের দিকে দৃষ্টি রাখতে বলব। ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আলী আশরাফ লিখেছেন, ‘যদি গণতন্ত্রকামীরাও শুধু বাংলা ও উর্দ্দুকে “রাষ্ট্রভাষা” করতে চান, তা’হলে সিন্ধীভাষী, পস্তুভাষী, পাঞ্জাবী ভাষী ও গুজরাটী ভাষী জনগণের উপর ঐ দুটি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হবে। এটাও হবে স্বৈরাচারী ও গণতন্ত্র বিরোধী।’ ভাষা-পরিকল্পনা থেকে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করা এবং ভাষানীতি থেকে সর্বক্ষেত্রে (উচ্চশিক্ষায়, আদালতে, দাপ্তরিক কাজে ইত্যাদি) এর ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। কিন্তু মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার (প্রথম পাঠগ্রহণে, উচ্চশিক্ষায়, দাপ্তরিক কাজে ইত্যাদি) জায়গাটি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ; পর্বতের শীর্ষদেশ থেকে পাতালে যাওয়া নয়।
আজম বলেছেন, ‘মাতৃভাষা নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো বিরোধ নেই।’ অথচ তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন ‘ভাষা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ’। ‘রাষ্ট্রভাষা’র তকমায় পৃথিবীর অসংখ্য ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীর কোটি কোটি মানুষ বঞ্চিত হয়েছে নিজের ভাষিক অধিকার থেকে। তাহলে ভাষা তো বরাবরই ক্ষমতাশালীদের উপযোগী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীর ‘সভ্যতা’র ইতিহাস বলে, ক্ষমতাবানেরা সব সময়ই সংখ্যায় লঘু হয়েও আর সবকিছুর মতো ভাষা দিয়েও শোষণ করেছে জনসাধারণের বৃহৎ অংশকে। ফলে ‘মাতৃভাষা নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো বিরোধ নেই’ বললে আমরা তাকে মনে করতে পারি কেবল রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণে বুঁদ হয়ে থাকা ক্ষমতাশীলদের বয়ান হিসেবে। ফলে আজমের মন্তব্য—‘এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করে রাষ্ট্রের যে অহমিকা প্রকাশ পাচ্ছে, এটা ভেগ (ঘোলাটে)’—এই উক্তিও সারবত্তা হারিয়ে ফেলে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্ম হলেও ইউনেসকো তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তাই স্বস্তি ও গৌরববোধ করেছে।
দানীউল হকের একটি বক্তব্যেও দ্বিমত পোষণ করি। তাঁর মতো অনেকেই প্রশ্ন করেন, ‘ভাষার আলাদা মাস থাকতে হবে কেন? ফেব্রুয়ারি এলে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ব, নানা রকম অনুষ্ঠান করে অঙ্গীকার করব, কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই শেষ! এটা হতে দেওয়া উচিত নয়।’
আমি মনে করি, একটি মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যম ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে অধিক আয়োজন করে—এটা দোষের নয়। এই মাসের ‘আবেগপ্রবণতা’কেও আমি শ্রদ্ধা করি, যদিও সেই আবেগকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি। আর ফেব্রুয়ারি চলে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে কেন? যাঁরা ভাষা নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের ভাষাবিষয়ক চিন্তা-গবেষণা, আলোচনা, ভাষার প্রায়োগিক কাজ (শিক্ষায় বা প্রযুক্তিতে) ইত্যাদি তো সারা বছরই চলতে থাকে।
তারিক মনজুর
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।