মরিবার আগে, পড়িবার তরে

যে বইগুলো পাঠ না করে আপনার মারা যাওয়া উচিত নয়, সেগুলোর একটি তালিকা আপনাকে অবশ্যই তৈরি করে নিতে হবে
যে বইগুলো পাঠ না করে আপনার মারা যাওয়া উচিত নয়, সেগুলোর একটি তালিকা আপনাকে অবশ্যই তৈরি করে নিতে হবে

মার্কিন এক গবেষণা বলছে, মানুষের আয়ুর নাকি একটি চূড়ান্ত ঊর্ধ্বসীমা আছে—১২৬ বছর। এর চেয়ে বেশি কারও পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়, তা চিকিৎসাবিজ্ঞান যতই অগ্রগতি করুক না কেন। যমকে ফাঁকি দিয়ে মাঠে ১২৬ রান করেছেন কি কোনো কারণ ছাড়াই জীববিজ্ঞানের আম্পায়ার তর্জনী তুলবেন।

মার্কিন গবেষকদের এই গবেষণার ফলাফল পড়ে মন দেখি ততটা খারাপ হলো না। দুটি কারণে। প্রথমত, মার্কিন সব গবেষণার পেছনেই আমি সাম্রাজ্যবাদী মতলবের গন্ধ পাই। দ্বিতীয়ত, আমার যা বয়স, তাতে এখনই মৃত্যুচিন্তা বিলাসিতা বলে গণ্য হতে পারে।

তবে আমার তীব্র সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মন সত্ত্বেও এমিলি টেম্পল নামে এক মার্কিন সাংবাদিকের হাজির করা সাম্প্রতিক এক জরিপের হিসাব পড়ে মনটা সত্যি খারাপ হয়ে গেল। ‘লিটেরারি হাব’ নামে একটি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় টেম্পল দেখাচ্ছেন, সবচেয়ে দ্রুতগতির একজন দীর্ঘায়ু পাঠকের পক্ষেও সারা জীবনে ৪ হাজার ৪৮০টির বেশি বই পড়া সম্ভব নয় (বছরে ৮০টি বই এবং ৮০ বছরের আয়ু ধরে)। এটাই বইপাঠের চূড়ান্ত ঊর্ধ্বসীমা।

এক মানবজনমে ৫ হাজার বই, তা-ও অতি ভাগ্যবান হলে। এই প্রথম একটি জরিপ আমেরিকান হওয়া সত্ত্বেও আমি সেটা ফেলে দিতে পারলাম না। ভেবে দেখলাম, বই এবং পাঠের গতির ক্ষেত্রে ভগিনী এমিলি বাড়িয়ে নয়, বরং কিছু কমিয়েই বলেছেন। পাঠের গতি অনুযায়ী তিনি পাঠককে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। গড় পাঠক (বছরে ১২টি বই), গোগ্রাসী পাঠক (বছরে ৫০টি বই) এবং আগ্রাসী পাঠক (বছরে ৮০টি বই)।
হিসাব কষে দেখলাম, আমার মতো ধীরগতির পাঠকের জন্য সংখ্যাটা আরও কম, বছরে ২০টি করে বই ধরলে সেটা হয় ১ হাজার ১২০। এই হিসাব কষামাত্র আমার মধ্য থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, ঠিক যেমনটা পারস্যের সম্রাট জারেক্সেসের বুক থেকে বেরিয়ে এসেছিল আড়াই হাজার বছর আগে। নিজের কাতারে কাতার সৈন্যবাহিনীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘হায়, আজি হইতে শতবর্ষ পরে ইহারা কেহই আর থাকিবে না।’

২০১০ সালে গুগল জানিয়েছিল, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ১২ কোটি ৯৮ লাখ ৬৪ হাজার ৮৮০টি বই আছে। বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো পাঠক তাই জারেক্সেসের মতো শুধু দীর্ঘশ্বাস না ফেলে আরেকটা কাজ করবেন—নিজের অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকা তৈরি করা। মরে যাওয়ার আগে যেসব বই পড়ে যাওয়া উচিত বলে তাঁর মনে হবে, সেগুলোই তিনি কেবল সেই তালিকায় রাখতে চাইবেন। আমরা সেই বইগুলোকে বলি ‘ক্লাসিক’।
আমেরিকান বুদ্ধিজীবী ক্লিফটন ফ্যাডিম্যান ১৯৬০ সালে লাইফটাইম রিডিং প্ল্যান নামে একটা বই লিখেছিলেন। তাতে তিনি শ দেড়েক বইয়ের একটি তালিকা দিয়ে সেগুলো পড়ে ফেলার ব্যাপারে পাঠককে তাগিদ দিয়েছেন। বইগুলো কেন পড়া দরকার বা সেগুলোর মাহাত্ম্য কী, তা-ই তুলে ধরেছেন ফ্যাডিম্যান। তালিকায় গিলগামেশের কাব্য থেকে শুরু করে থিংস ফল অ্যাপার্ট পর্যন্ত আছে।

ফ্যাডিম্যান বলেছেন, এই বইগুলো পড়তে পাঠকের ৫০ বছরের মতো সময় লাগতে পারে, লাগুক। সবারই একটা করে ইহজনমের পাঠ-পরিকল্পনা থাকা উচিত।
এ রকম একটা অবশ্যপাঠ্যের তালিকা আমি নিজেও একদা তৈরি করতে শুরু করেছিলাম। কিছুদূর এগোনের পর দেখি, কাজটার মধ্যে স্ববিরোধিতা উঁকি দিচ্ছে। প্রথম কথা হলো, বই পাঠের ক্ষেত্রে পরের মুখে ঝাল খাওয়ার চেয়ে অভুক্ত থাকাও ভালো। কোনো বই পড়ে না ফেলা পর্যন্ত আপনার পক্ষে কী করে জানা সম্ভব, ওই বই পাঠ আপনার জীবনের সত্যিকার এপিফ্যানির মুহূর্ত হয়ে উঠবে না? ক্লাসিক বা ধ্রুপদি বইয়ের তালিকার ভেতরে নিজের প্রিয় বই খোঁজা আর চেনা লোকেদের বান্ধবীর তালিকা ঘেঁটে নিজের প্রেমিকা খোঁজার মধ্যে তফাত কোথায়?

কিন্তু তবু একটা পাঠ-পরিকল্পনা যেকোনো সচেতন পাঠকেরই থাকে, থাকা ভালো। আর সেটা যদি ক্রমপরিবর্তনশীল হয়, তাহলে আরও ভালো। ফলে আমাদের আসলে ঠিক করে নিতে হবে আমরা ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়ব নাকি কনসিডার ফ্লেবাস পড়ব, ব্লিক হাউস পড়ব নাকি আন্দ্রে কামিলারি পড়ব, মাদাম বভারি পড়ব নাকি দ্য ব্লাইন্ড অ্যাসাসিন পড়ব, খোয়াবনামা পড়ব নাকি কালো হরফের অশ্বারোহী পড়ব।

তালিকা যা-ই হোক, আমাদের পাঠনীতির মূলমন্ত্র হতে হবে, বাজে বই পড়ে সময় নষ্ট করা এড়িয়ে চলা। আর তা করতে হলে গন্ধ শুঁকে বাজে বই শনাক্ত করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে আপনাকে। জা পল সার্ত্রের সাড়ে চার শ পৃষ্ঠার এজ অব রিজন পড়া শেষ করে যদি আপনাকে জানতে হয়, ওটা একটা ফালতু বই, তাহলে এই ভুলের গচ্চা হয়তো আপনার পাঠ আয়ু থেকে তুর্গেনেভের ঝরে পড়া।

দার্শনিক শোপেনহাওয়ার এ রকম একটা অবশ্যপাঠ্যের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে শুরুতেই বলে নিয়েছেন, বই না পড়ে থাকতে পারলেই সবচেয়ে ভালো। কারণ তাঁর মতে, বই পড়া মানেই নিজের মস্তিষ্ককে অপরের চিন্তার ক্ষেত্রে পরিণত করা। তাতে মস্তিষ্ক অলস, চিন্তাশক্তিহীন হয়ে পড়ে। তিনি অবশ্য বই পড়তে একেবারেই বারণ করেননি। কম কম করে পড়তে বলেছেন।

আমার এক কবি বন্ধু মনে করেন, বই এবং বইপাঠের মধ্যে আমরা যে মাহাত্ম্য আরোপ করি, সেটা একটা অভিজাততান্ত্রিক সংস্কৃতি। ফলে বই পুড়িয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে আপনি সমাজ পরিবর্তনের প্রথম বিপ্লবটি শুরু করতে পারেন। তাঁর কথার মধ্যে যুক্তি আছে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি, সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ডাকগুলো এসেছে বইয়ের ভেতর দিয়ে। সেটা মধ্যযুগের বৈপ্লবিক ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে যেমন সত্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় বিপ্লববাদীদের ক্ষেত্রেও ততটাই সত্য।

মানুষের স্বল্পায়ু জীবনতরি আর বইয়ের অসীম সমুদ্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায় বের করেছেন আমাদের এক সাবেক সাংবাদিক বন্ধু, যিনি পেশায় এখন টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। শুনেছি, তিনি নাকি নতুন বই পড়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়ে আগে পড়ে ভালো লাগা বইগুলো আবার পড়তে শুরু করেছেন। তাঁর যুক্তি: নতুন বিশটা বই পড়লে হয়তো একটা বই ভালো লেগে যেতে পারে। কিন্তু পুরোনো একটা বই মানেই শিওর শট।

এই নীতি অনুসরণ না করেও আপনি প্রকাশ্যে সেটা অনুসরণের ঘোষণা দিয়ে দেখতে পারেন। তাতে অন্তত একটা ক্ষেত্রে কিছু নগদ ফায়দা পেতেও পারেন: বন্ধু, সহকর্মী ও পরিচিতদের বইমেলায় বের হওয়া বইপত্র পাঠের বাধ্যবাধকতা থেকে আপনি নিষ্কৃতি পাবেন।