পল্লিকবির সামগ্রিক অবয়ব

মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার জসীমউদ্‌দীন শিরোনামেরবইয়ে পল্লিকবির জীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা উঠে আসেনি। এ বইয়ের প্রকাশনা নানা দিক থেকেই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জসীমউদ্‌দীন—যাঁকে ছাড়া বাংলা কবিতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সাহিত্য-গবেষক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও লেখায় তাঁর জীবন ও কর্ম সেভাবে উঠে আসেনি বললেই চলে। সেই বাস্তবতায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও কুদরত-ই-হুদার লেখা এই জীবনীগ্রন্থ সত্যিই একটা বড় ঘটনা।

জীবনী মারফত নিখুঁতভাবে লেখক তুলে ধরেছেন কবির শৈশব-কৈশোর, তাঁর দুরন্তপনা, প্রকৃতি অবলোকন এবং বিচিত্র কায়দায় তাঁর সাঁতার কাটার কথা। এখানে আছে তাঁর স্কুলজীবন, প্রাথমিক স্কুলভীতির বিবরণও। পল্লিজীবনের এসব কিছুই পরবর্তীকালে জসীমউদ্‌দীনকে কবি করে তুলেছে।

জসীমউদ্‌দীনের পারিবারিক জীবনের অভাব-অনটনের বিবরণ তুলে ধরে লেখক আমাদের জানান, ‘অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালে কী হবে, পড়াশোনায় কিন্তু জসীমউদ্‌দীন ভালো ছিলেন। বাল্যকালে তাঁর স্মরণশক্তি এত ভালো ছিল যে ক্লাসে বসেই স্কুলের পড়া শেষ করে ফেলতেন। বাড়িতে তেমন পড়তে হতো না। তাতেই ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতেন।’

১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত জসীমউদ্‌দীন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, নিজের গ্রামে বেড়াতে গেলেই কবিগান করতেন। এমনকি কবিগানের বায়নাও আসত তাঁর কাছে। এভাবে তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে পল্লিগীতি সংগ্রহের উদ্দীপনা। এর আগেই তাঁর কবিতা লেখার শুরু। ১৯২০ সালের শুরুতে কলকাতা নিবাসী হন তিনি। তাঁর তখনকার জীবনও ছিল সংগ্রামবহুল। পত্রিকার ফেরিওয়ালা পর্যন্ত হতে হয়েছে। পাশাপাশি ঢুঁ মারতেন বিখ্যাত সব পত্রিকা অফিসে। কবির এ পর্বের জীবনের যে টানাপোড়েন, হুদা তার বিবরণ তুলে ধরেছেন বিশদভাবে।

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় জসীমউদ্‌দীনের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এরপর তাঁর পরিচয় ঘটে দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে। এই পরিচয়ই অন্য এক জগতে নিয়ে যায় কবিকে। দীনেশচন্দ্র তাঁকে রোজগারের পথ দেখান, লোকসংগীত সংগ্রাহকের চাকরি পাইয়ে দেন।

এসবের মধ্যেও চলতে থাকে কাব্যচর্চা। কিছু কিছু লেখা ছাপাও হতে থাকে। ১৯২৫ সালে আইএ পাস করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। দীনেশচন্দ্র সেনই তাঁকে খবর দিলেন যে তাঁর ‘কবর’ কবিতাটি ‘ম্যাট্রিক ক্লাসে’ পাঠ্য হয়েছে।

জসীমউদ্‌দীনকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর কবিতা ছাপার হিড়িক পড়ে যায়। প্রকাশিত হতে থাকে বই।

একপর্যায়ে তাঁর সখ্য হলো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। এই ঘটনাগুলো যেভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন, তাতে সেই সময়ের ছবি যেন ভেসে ওঠে।

জসীমউদ্‌দীনের আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন হুদা—তাঁর সমাজ ও রাজনীতিসচেতনতার বিষয়। পাকিস্তান আমলে যখন সরকার বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেয়, এর প্রতিবাদ করেছিলেন জসীমউদ্‌দীন।

বইটিতে তুলে আনা হয়েছে আরও এক প্রায় অজানা তথ্য—বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জসীমউদ্‌দীনকে ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদায় আসীন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যথা যুক্তি পেশ করে সে প্রস্তাব সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কবি। তথ্যটির সপক্ষে এখানে দালিলিক বিবরণও আছে।

সব মিলিয়ে বইটিতে কবি জসীমউদ্‌দীনের যে সামগ্রিক অবয়ব তুলে ধরা হয়েছে, তা কবিকে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে।

জসীমউদ্‌দীন

কুদরত-ই-হুদা

প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার

জসীমউদ্‌দীনের প্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৮

পৃষ্ঠা: ৬৪

দাম: ১৫০ টাকা।