দুলাভাই

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘গাছের পাতাগুলিরে দেখ, ছুরির মতন লাগে...’

মাথার ওপরে হাত-পা মেইল্যা দাঁড়ায়া থাকা গাছটার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকায়া থাইক্যা ইমন কইল আপন মনেই। তারপর ঘাড়টা নিচু কইরা এক দলা সাদা থুতু ফালাইল সে পায়ের কাছে। রায়েরবাজার গনি মিয়ার রিকশা গ্যারেজের উল্টা দিকে ডাস্টবিনের পাশে একটা ভাঙা দেয়ালের ওপরে বইসা ছিলাম আমরা, প্রতিদিনই সকালবেলা যেমন বইসা থাকি, পেটের কোনায় তখন একটা চিকন বিচ্ছিরি ক্ষুধা চিন চিন কইরা খোঁচাইতে থাকে। খিদাটারে একদম পাত্তা দিই না, খোঁচাইতে খোঁচাইতে একটা সময় খিদার ধার যায় কইম্যা, পুরাই ভোঁতা হইয়া পড়ে খিদাটা। ইমনের কথায় খিদার কথা ভুইল্যা মাথা উঁচু কইরা চকিতে একবার গাছের ঝুলন্ত পাতাগুলি দেইখ্যা নেই আমি। নিরীহ নরম সবুজ রঙের পাতাগুলিরে আমরা পাতার মতোই লাগে, ছুরির মতো শক্ত ধারালো কিছু মনে হয় না। আমার দেখাদেখি কায়সারও মাথা উঁচায়া গাছের পাতা দেখে, তারপর হে হে কইরা বোকার মতো হাসে কিছুক্ষণ।

‘ছুরি নারে, গাছে গাছে যদি পিস্তল ঝুলত, তাইলে কেমুন হইত? গাছ থেইক্যা পাতার মতো পিস্তল পাইড়া নিতাম। হেরপর ঠা-ঠা-ঠা...’

দুই হাতের তালু একসাথে লাগায়া আঙুলগুলি বাঁকায়া একটা পিস্তলের আকৃতি বানায় কাওসার।

ইমন আবার পায়ের কাছে থুতু ফালায়। হালার পেটে মনে হয় কৃমি হইছে। একটু পরে পরে ছেপ ফালায়। কায়সারের দিকে তাকায়া বুঝতে পারি হের মাথায় অহনো পিস্তল ঘুরতাছে। কালা, চকচকা, ছোট্ট একটা পিস্তল কোমরের কাছে জিনসের প্যান্টের ভেতরে গুইঞ্জা রাখব হে, দুলাভাই যেমন রাখে। কাওসার কইছে আমারে, দুলাভাই যহন দুই ঠোঁটে সিগারেট চাইপ্যা ধরে, দুই হাতে বাসের স্টিয়ারিং ঘুরায়, আহ্ বাসটা তখন নাকি মনে হয় তার হাতের খেলনা। বড় হইলে দুলাভাইয়ের মতো বাস চালাইব কাউসার, নয়তো ট্রাক। রুস্তমের মতো দুই-তিনটা পিচ্চি শাগরেদ থাকব তার, দুলাভাইয়ের যেমন আছে, ওস্তাদ ওস্তাদ বইলা সারাক্ষণ হাত কচলাইব ওরা। ফাই-ফরমাশ খাটব, চা আইনা দিব, সিগ্রেট আইনা দিব। ‘ওই গুলিস্তান, গুলিস্তান’ ‘ওস্তাদ, ডাইনে প্রাইভেট বামে চাপেন’—কইয়া অনবরত বাসের বডি চাপড়াইব। এইটা ঠিক যে কাওসারের দুলাভাই এখন আর ওর আপার লগে থাকে না অথবা আপাই থাকে না দুলাভাইয়ের লগে। কয়দিন আগে ব্যাপক মারপিট আর গালিগালাজের পর একজন আরেকজনরে ছাইড়া যায়গা তারা। দুলাভাইয়ের কিল-ঘুষি-লাত্থি খায়া আপার মাথা ফাইট্টা সেই দিন রক্ত বারাইতাছিল। আর আপাও ছাড়ে নাই, মাইর খাওয়া নেড়ি কুত্তির মতো কামড়ায়া দুলাভাইয়ের হাতের মাংস-টাংস এক্কেরে উঠায়া ফালাইছিল। বস্তির লোকজন না ফিরাইলে সেই দিন একটা খুনাখুনি হইয়াই যাইত। দুলাভাই ওই দিন সবার সামনে গলার রগ ফুলায়া চিক্কুর পাইড়া আপারে তালাক দিছে, আপাও একটা মাছ কাটনের বঁটি হাতে নিয়া দুলাভাইরে কোপ দিতে ধাওয়া করছে। কিন্তু তবু আমরা জানি, দুলাভাই-ই কাউসারের চোখে হিরো।

‘দুলাভাইয়ের গালের তেরছা কাটা দাগটা দেখছস, ইশ্ আমার গালেও যদি ওইরম একটা দাগ থাকত...’

কাউসার নিজের গালে হাত বুলায়া মাঝে মাঝেই কইত। কিন্তু ওর কালা চকচকা গালে কোনো দাগ নাই। আর ইমন হালায় তো মনে করে ওর গায়ের রং খুব সুন্দর আছিল, খালি আমাগো লগে থাইক্যা ওর রংটা নাকি ময়লা হইয়া গেল। কাওসার আর ইমনের মাঝখানে আমি চুপচাপ বইসা থাকি। আমি আসলে ওগোর দুইজনের চামচা। কাওসারের পকেটে মাঝে মাঝে দুলাভাইয়ের দেওয়া খুচরা পয়সাকড়ি থাকে, মন ভালা থাকলে মাঝে মাঝে তার দুয়েকটা আমার দিকে ছুইড়া দিয়ে কয়, ‘ওই জনি, যা তো ডাইলপুরি নিয়া আয়।’

আমি তখন লৌড় দিয়া নিউ লাকি হোটেল থিক্যা ডাইলপুরি নিয়া আসি। তিনজন মিল্যা খাই। খাওন নিয়াও ইমনের খুঁতখুঁতানি। ‘পুরির ভেতরের ডাইলটা বাসি, গান্ধা...’

‘আরে ব্যাটা খা তো, এই যে আমরা খাইতাছি...’

ইমন খায় না। ডাইলপুরি ছিঁড়া ছিঁড়া রাস্তার কাক নাইলে কুত্তারে খাওয়ায়। ইমনের মা মাইনষের বাড়িতে কাম করলে কী হইব, ওর ভাব একটু বেশি। কাওসারের ওই সব ভাবটাব নাই। সব কথা ফড়ফড়ায়া আমগো কাছে কইয়া দেয়।

দুলাভাই একবার নাকি তার মোবাইল ফোনটা এক দিনের লাইগ্যা কাওসাররে দিছিল, কেডা জানে এমনো হইতে পারে, কাওসার আসলে ফোনটা চুরি কইরা আনছিল। পরে দুলাভাই গলা চিপ দিয়া ধরলে ও ফোনটা ফিরত দিছে। ওই ফোনে আমরা অনেক খারাপ কয়েকটা ভিডিও দেখছিলাম। কাওসার দেখাইছিল আমাগো,

‘এইগুলি দেখলে ঘিন্না লাগে’, ইমন চোখ ফিরায়া কইছিল।

‘দেহিস না গুনাহ হইব’, আমি আসলে দেখতে দেখতেই কইছিলাম। আমার মজা লাগতেছিল। বিয়া হইলে বউ-জামাই মনে অয় এইসবই করে। বড় হইয়া যখন আমি বিয়া করুম, তখন আমারও তো এইসব করা লাগব। তবে বিয়ার আগে এইসব করা গুনাহ।

কাওসার তার অভ্যাসমতো মোবাইলের পর্দায় চোখ রাইখ্যা হুদাই যখন ফ্যাক ফ্যাক কইরা হাসতেছিল, ঠিক তখনই ইমন ওয়াক কইরা বমি শুরু করায় পুরা ভিডিওটা আর আমাগো দেখা হয় নাই। আমার পেটে খিদাটা আবার গুঁতাইতেছিল, কিন্তু কাওসারের পকেটে আজকা মনে হয় টাকাপয়সা নাই। কয়েক দিন ধইরা দুলাভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যাইতাছে না, তার মোবাইলও নাকি বন্ধ। কাওসারই কইছিল আমাদের। মনে অয় বড় কোনো খ্যাপ পাইছে, গেছে গিয়া চিটাগাং নাইলে দিনাজপুর। কিন্তুক অন্য সময় দুলাভাই বইলা-কইয়া যায়, ওই সময় মোবাইলে তারে ধরা যায়। এইবার কি হইল যে কাউরে কিছু না কইয়া দুলাভাই ভাগলো, হের কোনো খবরই পাওয়া যাইতাছে না। এমনকি হের শাগরেদরাও কেউ কিছু কইতে পারে না। কাওসার মনে কয় একটু চিন্তার মধ্যে পইড়া গেছে। দুলাভাই না থাকলে ওরে খুচরা টেকাটুকা আর কেডায় দিব? খিদাটারে পাত্তা না দেওয়ার জন্য একটা গল্প তুলি আমি।

‘ওই ইমন, দেশে যে রোহিঙ্গা আইছে হুনছস? সব বুলে খায়ালাইতাছে অরা...’

‘হুম।’

ইমন মাটির দিকে চায়া কয়। এমুন কইলে কথা জমে? কাউসারও নাই। হে গেছে ছোট রাস্তার ডেরেনের পাশে মুততে। ইমন আছে ভাবের মধ্যে। ওই সময়ই দেহি গ্যারেজের কর্মচারী বারেক হাতের মধ্যে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা নিয়া মুচমুচায়া খাইতে খাইতে যাইতাছে।

‘ওই হালার পো, এইদিকে আয়’, বইল্যা আমি ডাক দিলে ও আইসা কাউসারের জায়গাটায় বসে। আমি চান্সে ওর ঠোঙ্গা থেইক্যা এক মুঠ মুড়ি নিয়া মুখে দিয়া চাবাই।

‘ওই আর খাবি না’, বারেক চোখ বড় কইরা কয়। আর হেরপর ঠোঙ্গা উল্টায়া পুরাটা মুড়ি নিজের মুখের মধ্যে ঢাইলা দেয়। ‘শয়তান একটা, হারামি’, মনে মনে গাইল দেই ওরে। ইমন কয়, ‘রোহিঙ্গাডিরে মাইরা খেদায়া দিছে।’

ইমন ফাইভ পর্যন্ত পড়ালেখা করছে। ও পত্রিকা পড়তে পারে। টেলিভিশনের লেখা বুঝতে পারে, ওর কথারে হেই লাইগ্যা আমরা দাম দেই। কিন্তুক বারেকের কথার কি দাম আছে? ওরে কিছু জিগাই নাই, তবু বারেইক্যা মুখের শেষ মুড়িটা চাবায়া চোখ বড় বড় কইরা কয়, ‘হ, পরথমে হাত-পা বান্ধে, বাইন্ধা চিৎ কইরা ফালায়, একটা কেঁচি লয়, কেঁচি দিয়া ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ কইরা কাইট্টালায়, হেরপর একটা ছুরি লয়, ব-অ-ড় ছুরি, হাতের কবজাডি...’—নিজের হাতের কবজি ওপরে তুইল্যা দেহায় ও, ‘হাতের কবজাডি কাঠের ওপরে থুইয়া কবজায় বাড়ি দেয়, কবজাটা পইড়া যায়গা, হেরপর পায়ের কবজি বাড়ি দিয়া ফালায়া দেয়, কল্লা কাইট্টা লায়, সব কাইট্টা লায়, পুরা উলঙ্গ কইরা লায়, উলঙ্গ কইরা হেরপর ছিল্যা কুত্তারে খাইতে দেয়।’

বারেক এমুন কইরা কয়, যেন ও নিজের চউক্ষে সব দেখছে। আমরা কিছু কওনের আগেই ও আবার কয়, ‘হ, নেটে দেখছি, আমগো গ্যারেজের মালিক কইছে, দশ লাখ মানুষ আইছে ককসোবাজার, এই জায়গায় গর্ভবতী হইছে এক লাখ...’

বারেকের এইসব কথারে কে দাম দেয়, আমি ওর দিকে মনোযোগ না দিয়া গলা বাড়ায়া কাউসাররে খুঁজতাছিলাম। মুতনের উছিলা দিয়া অয় গেল কই? দুলাভাইয়ের মতো ভাগছে নাকি?

হঠাৎ শুনি পাড়ার কুত্তাগুলি ঘেউ-ঘেউ কইরা নিজেগো মধ্যে বিরাট ডাকাডাকি করতাছে। গত বচ্ছর মনে আছে, এক দিন কুত্তাগুলি এই রকম ঘেউ-ঘেউ করতেছিল। এই ভাঙা ওয়ালের পেছনে একটা ময়লা ফালানির জায়গা আছে। আমরা গিয়া দেখি আজব কারবার! একটা তেনার মধ্যে একটা মানুষের বাচ্চা, গেদা বাচ্চা, খালি জন্ম হইছে এমুন একটা ছোট্ট বাচ্চা একলা ময়লার মধ্যে পইড়া রইছে, তখনো বাচ্চাটার জান আছে, একটু একটু শ্বাস নেয়। কুঁ কুঁ কইরা কান্দে! আস্তে-ধীরে ছোট ছোট হাত-পাগুলি একটু একটু নাড়ায়! হাঁ কইরা লাল টুকটুকা জিহ্বা বাইর করে। কত কাণ্ড হইছিল সেই সময়। কত মানুষ জমা হইছিল। পরে তো পুলিশ আইলো, সাম্বাদিক আইলো। ফজলুর মা বাচ্চাডারে কোলে নিয়া বুকের মইধ্যে কইরা মেডিকেলে নিয়া গেছিল, কিন্তুক বাচ্চাটা শেষ পর্যন্ত বাঁচে নাই। এমুন একটা মাসুম বাচ্চারে মানুষ কেমনে ফালায়া দেয়? ওর কি মা-বাপ নাই? আমগো মনে প্রশ্ন জাগছিল।

‘বাচ্চাটা মনে হয় জারজ।’ ইমন অনেক চিন্তাভাবনা কইরা কইছিল সেই সময়, ‘ওর বাপ-মার মনে হয় বিয়া হয় নাই। অবৈধ সন্তান। পরিচয় দিতে পারব না বইল্যা ফালায়া গেছে।’

এইবারও কি ওই রকম কিছু হইল? দেখন লাগে। আমি লাফ দিয়া ওয়াল থেইক্যা নামি। হেই সময়ই দেখি, কাওসার দৌড়ায়া আসতাছে। ওর মুখ-চোখে কেমন ভয়ের ছাপ! আগে তো কোনো দিন ওর এমন চেহারা দেখি নাই।

‘ওই বেডা কী হইছেরে?’ আমি জিগাই।

কাওসার কুত্তার মতো জিহ্বা বাইর কইরা শ্বাস লয়। হেরপর একটু দম নিয়া কয়, ‘আমি মুততে গেছি, হেই সময় দেহি কী, ছোট রাস্তায় ডেরেনের ভেতরে একটা সুটকেস, কালা রঙের সুটকেস পইড়া রইছে।’

ইমন আর বারেকও ততক্ষণে ওয়াল থেইক্যা নাইম্যা দাঁড়াইছে।

‘কী কস?’

‘হ, কয়ডা কুত্তা দেহি সুটকেসের কাছে ঘুরে আর ঘেউ-ঘেউ করে, পরে ময়লার গাড়ি টানে যে সেলিম, ও আইস্যা সুটকেসটা ধইরা টান দিয়া ওপরে তুলছে, দেহে কি, সুটকেসটা কেমন ভারী ভারী লাগে। পরে একটা টান দিছে আর সুটকেস খুইল্যা গেছে...’

‘তারপরে?’ কাওসার থাইম্যা গেলে আমরা জিগাই।

‘সুটকেসের ভেতরে একটা মানুষ...’ কাওসার হাঁপাইতে থাকে। দুরু, মানুষ কেমনে সুটকেসের ভেতরে? আমরা বুঝি না।

‘হ, একটা মানুষের লাশ।’

এইবার আমরা আর দেরি করি না, দৌড় দেই সোজা ছোট রাস্তার দিকে। ওইখানের ডেরেনের পাশে তখন মেলা মানুষের ভিড়। সবার চোখ ওই কালো সুটকেসের দিকে। মানুষজন ঠেইল্যা ঠুইল্যা কাছে গিয়া দেখি, সুটকেসের ডালাটা হাঁ কইরা খোলা। সেই খোলা ডালার ভেতরে চোখ পড়তেই জইম্যা যেন বরফ হইয়া গেলাম আমি। আল্লাহগো, জীবনেও এমন কিছু আগে দেখি নাই। কী ভয়ংকর! একটা মরা মানুষের দেহ কাগজের ঠোঙ্গার মতো দলামোচা হইয়া পইড়া রইছে, খালি গা, শইল্যের মধ্যে এইখানে-সেইখানে ছাপ্পা ছাপ্পা রক্ত শুকায়া কালা হইয়া গেছে, একটা রং জ্বলা জিনসের প্যান্ট কোমরের কাছ থেইক্যা নাইম্যা গেছে, ভিজা কাপড় মোচড়াইলে যেমন লাগে, তেমনই লাগতাছে শইলডা, নেতায়া প্যাঁচায়া থেঁতলায়া পইড়া রইছে। এইটা যে একটা মানুষের দেহ, সেইটা বোঝা যাইতেছে, কিন্তু মানুষটার ঘাড়ের উপরে কোনো মাথা নাই। কেডা জানি কোপ দিয়া তার মাথাটা গলা থেইক্যা নামায়া দিছে। কাটা গলাটার কাছে জমাট বান্ধা কালো রক্ত। কয়েকটা গুয়ের মাছি সেই রক্তের উপরে একবার বসতেছে, আরেকবার উড়তাছে। কেমন পচা-গলা একটা দুর্গন্ধ আশপাশের বাতাসে ভাসতাছে।

ইমন আর বারেক আমার লগেই আছিল। মানুষের গ্যাঞ্জামের মধ্যেই আমার পাশ থেইক্যা ইমনের ওয়াক কইরা উঠার শব্দ পাইলাম। একটু পরেই জটলা থেইক্যা বাইর হইয়া হড়হড় কইরা বমি করল ও। পেটে তো কিছু নাই, কতটা সবুজ তিতা পিছলা পানি ওর মুখ দিয়া বাইর হইয়া রাস্তার ধুলাগুলি ভিজায়া পইড়া রইল।

এর মধ্যেই পুলিশ আইসা মানুষ সরায়া লাশ নিয়া গেলে আমরা আবার আগের মতো ভাঙা ওয়ালের উপরে গাছটার নিচে আইসা বসি। আমার কেমন মাথা ঘোরায় আর পেট গুলাইতে থাকে।

‘দূরে কোনোখানে খুন কইরা চামে এইখানে লাশ ফালায়া গেছে। কমপক্ষে তিন দিন আগের লাশ। পরথমে হাত-পা দড়ি দিয়া বানছে, পরে ইচ্ছামতো পিটাইছে, শইল্যের সব হাড্ডিগুড্ডি পিটায়া ভাইঙ্গা লাইছে, গুঁড়া গুঁড়া কইরা ফালাইছে, হেরপর উপুড় কইরা ফালায়া কল্লাডা কোপ দিয়া কাইট্টা লাইছে। কাটা কল্লাটা ডেরেনে-ডুরেনে ফালায়া দিছে, হ্যাষে লাশটা ঠাইস্যা সুটকেসে ভইরা...’

বারেক এমুন কইরা কইতে থাকে, যেন খুনের সময় অয় সামনে খাড়ায়া আছিল। হঠাৎ বিরাট রাগ লাগে আমার। ‘ওই হোমন্দির পো, ফোট। বহুত কইছস, এইবার ফোট’, গালি দিয়া বারেইক্যারে ভাগায়া দেই আমি। কাওসার কেমুন যেন তব্দা খায়া গেছে। কিচ্ছু কয় না। ইমনও মনে কয় হাত-পা ছাইড়া দিছে। শইল্যে কোনো জোর-বল নাই। মুখের মধ্যে মনে হয় ফালানোর মতো ছেপও অবশিষ্ট নাই তার।

‘মরা মানুষডার পরিচয় কী? পুলিশ কি পরিচয় বাইর করতে পারব? তার দেশ-গেরাম কই, মা-বাপ কই, নাম কী তার? কারা এমন কসাইয়ের মতো জবো করল ওরে?’

আমি জানি, বাতাসের কাছে এত কথা জিগাই। কারও কাছে কোনো উত্তর পাই না। ইমন হঠাৎ এক্কেরে কী জানি মনে পড়ছে, এমন কইরা সোজা হইয়া বসে।

‘আইচ্ছা, ওই, ওইডা আবার আমাগো কাউসারের দুলাভাই না তো?’

কাউসার কেমন চমকায়া ওঠে। ওর ঠোঁট-মুখ কেমন সাদা দেখায়, যেন শইল্যে কোনো রক্ত নাই।

‘হ রে, শইল্যের রং আর বডি কাটিংয়ে কিন্তুক দুলাভাইয়ের সাথে মিল আছে...’ আমি একটু চিন্তা কইরা কই। ‘দুলাভাইয়ের ওই রকম একটা জিনসের প্যান্টও তো আছিল! ঠিক না?’

‘আরে না’, কাউসারের গলায় জানি শক্তি নাই এমুন আস্তে প্রতিবাদ করে ও। ‘জিনসের প্যান্ট তো আরও কত মানুষের আছে! ওইডা কেমনে দুলাভাই হইব? দুলাভাইয়ের গালে তেরছা একটা কাটা দাগ আছে। তোরা জানস না?’

ইমন এইবার হে হে কইরা হাসে, ‘হালার মাথাই নাই, তুই মাথা ছাড়া গালের কাটা দাগ কই পাইবি?’

‘লাশের মাথাটা খোঁজা দরকার, নাইলে লাশটা চিনা যাবে না। মাথাডা কই ফালাইল?’

কাউসার কেমন জানি আউলা-মাউলা ভাবে কয়।

ইমন ওর কথায় সাড়া না দিয়া ঘাড় উঁচায়া আবার গাছটার দিকে চায়। আমিও আবার ওপরের দিকে চাইলাম ওর সাথে সাথে। এইবার দেখলাম, পাতাগুলির চেহারায় বদল ঘটছে, গাছের পাতাগুলি একটার লগে আরেকটা বাড়ি খাইতাছে, একটা ছুরির লগে ঘষা খাইতাছে আরেকটা ছুরি, কান পাতলে বাতাসে ছুরির ঝনঝন শব্দও শুনতে পাইলাম। গাছের পাতাগুলি নাকি ছুরিগুলি যখন ওপর থেইক্যা মানুষের মাথায় ঝইরা পড়ব, তখন কি মস্তক ফুটা কইরা দিব? প্রত্যেকটা মানুষের মাথায় বিন্ধা থাকব একটা ছুরি।

আমি দেখলাম, বাতাস বইতাছে, গাছ থেইক্যা একের পর এক ঝইরা পড়তাছে ছুরি, একটা ছুরি আমার মাথায় পড়ল কিন্তু হালকা একটা চাপ ছাড়া আর কিছুই অনুভব করলাম না আমি। ব্যথাও লাগল না আমার, কী আশ্চর্য! রক্তও বাইর হইল না একটুও। আমি দেখলাম, গাছ থেইক্যা ঝইরা পড়া আর একটা ছুরি সোজা ঢুইক্যা গেল ইমনের মাথায়। পরের ছুরিটা ঢুকল কাউসারের মাথায়।

‘ওই বেডা, তোর মাথার মধ্যে ছুরি বিন্ধা গেছে...’

আমি কইলাম, কাউসার হে হে কইরা হাসল একটু বোকার মতো, মাথায় একবার হাত বুলাইল যেন কিছুই হয় নাই। তারপরে কইল, ‘ছুরিতে দেহি ধার নাই। তাজ্জব ব্যাপার, একটুও দুক্কু পাইলাম না।’

দুক্কু আমরা কেউ-ই পাই নাই। কিন্তু আমরা জানি, একটা ছুরি আমাগো মাথায় ঢুকছে। এই ছুরি বিন্ধা মাথা নিয়া আমরা অহন শহর জুইড়া ঘুরতাছি, সুটকেসের মধ্যে রাখা লাশটার কাটা মাথাটা খুঁজার জন্য।