ভুলে না যাই বই খোশবাই

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম
>
শেষ হলো বইমেলা। নটেগাছটি মুড়াল বটে, তবে বই নিয়ে কথাবার্তা কি ফুরাল?


বাংলা একাডেমিতে এখন মেয়ের বাড়ি থেকে বরযাত্রী বিদায় নেওয়ার পরের অবস্থা। অথচ ফেব্রুয়ারিজুড়ে সেখানে কতই না আয়োজন। জনে জনে সবাই ব্যস্ত। দম ফেলার ফুরসত নেই। আমন্ত্রণপত্র ছাপাও, প্যান্ডেল বানাও, লাইট বসাও, মাইক লাগাও—লাগাতার কর্মসূচি। এই কর্মের একমাত্র উপলক্ষ একুশে বইমেলা।

আদর করে আমরা এর নাম রেখেছি ‘প্রাণের মেলা’। এ মাসে লেখক-প্রকাশক—দুই দলই সরব। তাঁদের মূল লক্ষ্য ফেব্রুয়ারি। জানুয়ারি এলেই তাঁরা জাগ্রত হন। বাকি এগারো মাস ‘বল হরি, হরিবল’ অবস্থা! শত ডাকাডাকিতেও উভয়েই মৃতবৎ।

এতে মূল ক্ষতি সাহিত্যের। ফরাসি কবি পল ভ্যালেরি যেমন বলেছেন, ‘বইয়েরও আছে মানুষের মতো একই রকম শত্রু: আগুন, আর্দ্রতা, জন্তু, আবহাওয়া এবং তাদের নিজের বিষয়বস্তু।’ আরেকটি যে শত্রুর কথা তিনি বলেননি তা হলো, ছাপার ভুল। বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন এক মনীষী। তিনি বলেছেন, ‘কোনো এক সুন্দর দিনে তুমি মারা যাবে কোনো এক ভুল ছাপার কারণে।’

এখন প্রশ্ন হলো, বই সারা বছর প্রকাশ হচ্ছে না কেন? এখানেও সেই আরেকটি অচ্ছেদ্য চক্র। প্রকাশক বলছেন, লিখে দিচ্ছে কে? লেখক বলছেন, লিখে দিলেই ছাপছে কে? তার চেয়েও বড় কথা, ছাপা হলেই সে বই কিনছে কে? সে বই পাওয়া যাচ্ছেই বা কোথায়?

সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই পাঁড় পাঠকই বা কোথায়, যিনি বই কিনবেন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে। তারপর চুর হয়ে থাকবেন তার মধ্যে। শরৎচন্দ্র সেই কবে খেদের সঙ্গে বলে গেছেন, ‘অনেক বড়লোকের বাড়িতে আমি গেছি। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাঁদের আছে সবই। নেই কেবল গ্রন্থাগার। যাঁদের বা একান্তই আছে, তাঁরা কয়েকখানা চকচকে বই বাইরের ঘরে সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু বাংলা বই মোটেই কেনেন না।’

অথচ এর ঠিক উল্টো ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি আইরিশ ফ্যান্টাসি লেখক জোনাথন সুইফটের জীবনে। সুইফট হোটেলে এসেছেন খাবার খেতে। খাওয়া শেষ করে বয়কে বকশিশ দিয়ে বললেন, যা খুশি কিনে নিয়ো। কিন্তু একটা শর্ত আছে। বিদেশি জিনিস কিনতে পারবে না।

বয় খুশি হয়ে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরল একগাদা বই বগলদাবা করে। বইগুলো দেখে সুইফটের চোখ ছানাবড়া। এ যে তাঁরই লেখা বই!

তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একি! তুমি তো দেখছি সব বই কিনে নিয়ে এসেছ।

জি স্যার, বয়টি বলল, একেবারে খাঁটি আয়ারল্যান্ডের জিনিস কিনেছি। লেখক আমাদের দেশেরই। এমন ভালো লেখা কেউ কখনো লেখেনি।

এর ঠিক উল্টো মানসিকতা দেখি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঘটনায়। ঈশ্বরচন্দ্রের শখ ছিল বই পড়া এবং বই বাঁধাই করে রাখা। একদিন এক ভদ্রলোক বইগুলো দেখে বললেন, এত খরচ করে বইগুলো বাঁধিয়ে না রাখলেও হতো।

কেন? এতে দোষ কী?

ওই টাকায় অনেকের উপকার হতে পারত।

ঈশ্বরচন্দ্র তামাক খেতে খেতে ভদ্রলোকের শাল লক্ষ্য করে বললেন, আপনার শালটি চমৎকার। কোত্থেকে, কত দিয়ে কিনেছেন?

শালের প্রশংসা শুনে ভদ্রলোক উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, পঁচিশ টাকায় খরিদ করা। এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, সুযোগ পেয়ে বললেন, পাঁচ সিকের কম্বলেও তো শীত কাটে, তবে এত টাকার শালের প্রয়োজন কী? এ টাকায়ও তো অনেকের উপকার হতে পারত।

বইয়ের উপকারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সে কথা বইবিষয়ক অনেক বইয়ে পাওয়া যাবে।

আজকাল অনেকে বলেন, আমাদের পাঠাভ্যাস কমছে। তাই বলে বাঙালি পড়া ছেড়ে দিয়েছে, এমন নয়। আমরা অবশ্যই পড়ি। তবে রাশিফল আর ব্যাংকের চেক বই যতটা মনোযোগ দিয়ে পড়ি, অন্য কিছু ততটা নয়, পাঠ্যবই তো নয়ই। আমরা শেয়ারমার্কেটে গিয়ে ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়তে পারি, পকেটের পয়সা খরচ করে একই সময় একাধিক প্রেমে পড়তে পারি, বেখেয়ালে চলতে গিয়ে শাঁই করে খোলা ম্যানহোলে পড়তে পারি, এমনকি চায়ের টেবিলে অবলীলায় জাতির ভবিষ্যৎও পড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু বই পড়াটা আমাদের সঙ্গে ঠিক যায় না! ছাত্রজীবনে পড়তে হয়, তাই পড়া। মেনে নিতে হয়, তাই বাধ্য হয়ে মেনে নেওয়া। মনে নেওয়ার মানুষ হাতে গোনা।

তবে আশার কথা, লেখক বাড়ছে। বলা যায়, সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যাঁরা, তাঁরা প্রায় সবাই লেখক। তাঁদেরও ভাব আসে। কে কী ভাবল, তার পরোয়া নেই। লেখক পরোয়া করবেনই বা কেন? তাঁরা ঘাড় গুঁজে দিনরাত লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখা হরদম প্রকাশ হচ্ছে। আপনি-আমি সেই লেখা পড়ছি, পছন্দও করছি। চলছে এ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পুস্তকালোচনা। এমনকি তাঁদের লেখা কালের সিন্দুকে গচ্ছিতও থাকছে। অলক্ষ্যে বসে যিনি এ কাজ করছেন, তিনি মার্ক জাকারবার্গ। তিনি একাই এই মহান পৃথিবীর প্রকাশক সেজে বসে আছেন। এমনই এক জাল পেতেছেন সংসারে।

বইমেলায় প্রতিবছর যে লোকসমাগম হয়, তার মধ্যে মাত্র অল্পসংখ্যক মানুষ বই কেনেন। বাকি সবাই আসেন বেড়াতে, বই দেখতে। মাছবাজারে গিয়ে মাছ টিপে দেখার মতো তাঁরা বই দেখেন। বিজ্ঞের ভাব নিয়ে সযত্নে পাতা ওলটান। তারপর একসময় ‘নাহ্! প্রচ্ছদ ভালো হয়নি’ বলে অন্য বই হাতে তুলে নেন। ভাবটা এমন, বই তোমার নাম কী? প্রচ্ছদে পরিচয়।

কথাটা সেদিন এক বন্ধুকে বলতেই সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিকই তো। যে তরকারি দেখতে ভালো না, সে তরকারি খেতেও ভালো লাগে না।

বন্ধুর কথা শুনে মনে হলো এর চেয়ে বধির হওয়াই ভালো ছিল। মনে পড়ে গেল কবি জসীমউদ্‌দীনের কথা। বইকে রথের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন, বইয়ের রথে চেপে আপনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ অনায়াসে যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন।

আমি বহুবার সে চেষ্টা করে দেখেছি, কাজ হয়নি। কারণ, ছেলেবেলা থেকেই বই পড়তে শুরু করলে আমার ঘুম পায়। আমার জীবনে এরপরই ঘটে বইয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার। মাথার নিচে বই রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। এ ক্ষেত্রে সিডনি স্মিথের কথা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, বই হচ্ছে ঘরের সবচেয়ে সুন্দর আসবাব। সমঝদার বাঙালি বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। সম্ভ্রান্তদের ড্রয়িংরুমে অন্তত কিছু বই থাকে।

তবে যে যা-ই বলুন, মনীষী তলস্তয় বই সম্পর্কে যা বলেছেন, তার ওপর আর কথা হয় না। তিনি বলেছেন, জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। জিনিস তিনটি হলো, বই, বই এবং বই।

কথাটি কার্ল মার্ক্স যতটা বুঝেছিলেন, তাঁর স্ত্রী ততটা বুঝতে পারেননি বলেই মনে হয়। ঘটনা খুলেই বলি। কার্ল মার্ক্সের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে এলেন এক সাংবাদিক। এ প্রশ্ন, সে প্রশ্নের পর মার্ক্সের দাম্পত্য জীবন নিয়েও প্রশ্ন করল সে। এমনই এক প্রশ্নের জবাবে স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা যথেষ্ট সুখী ছিলাম।

উত্তর দেওয়ার ধরন দেখেই চতুর সাংবাদিক চটপট জানতে চাইলেন, আপনারা সত্যিই কি সুখী ছিলেন?

এবার ভদ্রমহিলা আরও বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা সত্যিই সুখী ছিলাম, কিন্তু কার্ল যদি ক্যাপিটাল লেখায় সময় না দিয়ে ক্যাপিটাল সংগ্রহেও কিছু সময় দিত, তাহলে আরও ভালো হতো।

বইয়ের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক আছে বলেই হয়তো লক্ষ্মীর সঙ্গে তার এত দূরত্ব। খুব কম বই-ই পারে এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে। এই একটি দিক দিয়ে বইয়ের সঙ্গে মানুষের বেজায় মিল। মানুষের বেলায় যেমন, বইয়ের বেলাও তেমনি অল্পসংখ্যকই মহান ভূমিকা পালন করে। বাকি সব হারিয়ে যায় আগমনের মধ্যে। তা হারাক। তবু বইমেলায় শত শত বই প্রকাশিত হোক। আলস্য ঝেড়ে লেখক লিখুক বারো মাস। বছরজুড়ে প্রকাশিত হোক বই। সমুদ্র গুপ্তের কবিতা ধার করি শেষে, ‘...মানুষটা তো কাগজ কেটে কেটে কামান বন্দুক মারণাস্ত্র বানাতেও পারত।’

তা তো আর হচ্ছে না। এক বইমেলায় না হয় চার হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকাশযজ্ঞ মন্দ নয়।