নদী নিঃশেষিত হলে

শহীদ আনোয়ার পাশা (১৫ এপ্রিল ১৯২৮—ডিসেম্বর ১৯৭১), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শহীদ আনোয়ার পাশা (১৫ এপ্রিল ১৯২৮—ডিসেম্বর ১৯৭১), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
>
আনোয়ার পাশার সহপাঠী ছিলেন কলকাতার খ্যাতিমান লেখক শঙ্খ ঘোষ। ১৯৭১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ১‍৯৭২–এ বন্ধুর স্মৃতিচারণা করে তিনি লিখেছিলেন মর্মস্পর্শী এই লেখা। ছাপা হলো সেই লেখার নির্বাচিত অংশ


‘নদী নিঃশেষিত হলে’—এই নামে একটা কবিতার বই লিখেছিল আনোয়ার। আমাদের বন্ধু, আনোয়ার পাশা।

নীলিমা ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আনোয়ারের খবর কিছু জানেন? কাগজে যা লিখেছে তা কি ঠিক?

আশা করেছিলাম, হয়তো তিনি বলবেন: না, ঠিক নয়। আনোয়ার সময়মতো সরে যেতে পেরেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, ভালো আছে ওরা। শিগগিরই আসবে কলকাতায়।

কিন্তু তিনি না তা বললেন না। বললেন: ওটা ঠিক। আনোয়ার পাশাকে চোখ বেঁধে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল চৌদ্দই ডিসেম্বর, গুলি করে মেরে ফেলেছিল আরও অনেকের সঙ্গে। উনি একেবারেই সাবধানী হননি। বরং বিশ্বাস করে বসেছিলেন যে ওঁর কিছু হবে না। পঁচিশে মার্চের হামলায় ওঁদের ঘরেও গুলি ঢুকেছিল, তবু গায়ে লাগেনি। আনোয়ার বলতেন, তাহলে আমি আর মরব না। অথচ সেই মরতে হলো শেষ পর্যন্ত।

শনাক্ত করা গিয়েছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু মুখ দেখে নয়। দশ দিন পরে পাওয়া লাশ ফুলে উঠেছিল অনেকখানি, চিনবার কথা নয়। তবু চেনা গেল গায়ের চাদরখানি দেখে। আনোয়ারের ব্যবহার করা পুরোনো পরিচিত চাদর!

‘তবু ভালো লাগে হাসতেই, বাঁচতেই’ লিখেছিল আনোয়ার। আমাদের বন্ধু আনোয়ার পাশা। এ যে কোনো বানিয়ে তোলা কবিতার লাইন, এমন নয়। আমরা যারা ওর বন্ধু ছিলাম, আমরা মনে করতে পারি কেবল ওর হাসিভরা চোখ, আমরা মনে করতে পারি যে কখনোই ওকে ভেঙে পড়তে দেখিনি, ঝুঁকে পড়তে দেখিনি, আমাদের কাছে ধরা আছে কেবল ওর টলটলে স্বভাবের স্মৃতি।

আনোয়ারের বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ। অর্থাৎ আনোয়ার এ দেশের ছেলে। আমরা রইলাম এখানে আর আনোয়ার চলে গেল আমাদের দেশে। কেন ওকে যেতে হলো সে কথা অনেক ভেবেছি। কেন যেতে হলো? পাশ করবার পর বহরমপুরের কাছে ভাবতা-র ছোট্ট স্কুলটিতে যখন ও পড়াতে ঢুকেছিল, তখনো আনোয়ার ভাবেনি যে ওদেশে চলে যাবে কখনো। সেই স্কুল-হোস্টেলের একটা ঘরটিতে বসে অথবা সামনের মাঠে ঘুরতে ঘুরতে আনোয়ার বলেছিল ভবিষ্যৎ-জীবনের কথা।

কবিতা? কবিতা লিখছ না?

আমি কি আর লিখতে পারি? তবু, যা লিখেছি তাই নিয়েই একটা বই করার ইচ্ছে হয়। ভেবে রেখেছি।

সেই ছড়াটা থাকবে তো এতে? ‘এল লাল ধূমকেতু?’

ওটা তোমাদের খুব পছন্দ, না? শেষ দুটো লাইন কিন্তু দেব না। ওটা থাকবে এ রকম:

এল লাল ধূমকেতু আকাশে

অনেক আগুন দিল ছড়িয়ে

আমাদের দীপগুলো আম্মা গো

নেবে নাকি সে আগুনে ধরিয়ে?

...

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়ছি যখন, এই কবিতা তখন লিখেছিল আনোয়ার ছাত্রসংসদের পত্রিকা একতার জন্য, সম্পাদনার কারণে যে লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল এর পাণ্ডুলিপি-রূপ থেকেই, তখন এর শেষে ছিল আরও দুটো লাইন। ওর খাতা দেখে, তখন থেকেই জল্পনা চলছে সম্ভাব্য কোনো বইয়ের।

কিন্তু সে বই তখন বেরোল না। সে স্বপ্নও অল্পে অল্পে মিলিয়ে গেল যখন, তখন একদিন এসে জানিয়ে দিল আনোয়ার: চললাম পুব বাংলায়, তোমাদের দেশে। এডওয়ার্ড কলেজে কাজ পেয়েছি একটা।

পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ। আনোয়ার সেখানে কাজ করতে যাবে? ভালোই। তবু মনে পড়ে, পুরো খুশি হতে পারিনি সেদিন। এত দূর চলে যাবে?

কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যত দূর, পাবনাও প্রায় ততটাই। তবু মনে হলো, আনোয়ার আমাদের কাছ থেকে সরে গেল অনেক দূর।

কিন্তু আনোয়ার বলেছিল, ফিরে আসব আবার। চিরদিন থাকব না।

তারপর কখন একদিন ঢাকায় পৌঁছাল আনোয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। মধ্যে কখনো কলকাতায় এসেছে ওর নতুন কোনো বই হাতে নিয়ে, কখনো রবীন্দ্রছোটগল্প সমীক্ষার মতো আলোচনার বই, কখনো ‘নদী নিঃশেষিত হলে’র মতো কবিতা। সবই ঢাকা থেকে ছাপা।

যাওয়া-আসা বন্ধ হলো যখন, খবর জানতাম শুধু চিঠিপত্রে। টের পেতাম যে আরও অনেক লেখা নিয়ে, নতুন লেখার ভাবনা নিয়ে মেতে আছে আনোয়ার। ও দেশের পাঠকের মনে ওর রচনার প্রতিপত্তি কত দূর পৌঁছেছিল তা আমার জানা নেই, ওর স্নিগ্ধ আচরণ কত দূর কাছে টেনেছিল ওখানকার মানুষকে, তা-ও আমি জানি না। কেবল পঁচিশে মার্চের পর অনেকেই যখন আসছেন বাংলাদেশ থেকে কলকাতায়, জনে জনে জিজ্ঞেস করেছি আনোয়ারের কথা, জানতে চেয়েছি কেন সে আসছে না—অনেকেই ঠিকমতো বলতে পারেনি ওর খবর। বলতে পারলেন জহির রায়হান। এপ্রিলের শেষ দিকে জহির বললেন: আনোয়ার সাহেব ভালো আছেন। পঁচিশের পর আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

কিন্তু আজ জহির নেই। আজ আনোয়ার নেই।

বইয়ের ভিড় থেকে বের করে এনেছি ‘নদী নিঃশেষিত হলে’। কদিন বসে সেটাই পড়ছি।

আজ যেন এই কবিতাগুলিতে অন্য রকম রং এসে লাগছে। মৃত্যু এই রকম। মৃত্যুর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে কারও জীবনটাকে যখন দেখা যায়, তার কাজকর্ম, তার উচ্চারণ—সে সবই তখন আরেক তাৎপর্যে ফুটে উঠতে থাকে। চোখবাঁধা এই অপঘাত-মৃত্যুর পরিণাম যার, সে একদিন লিখেছিল, ‘আমারও একটি ব্রত: সহজ জীবন।’ কেমন অসম্ভব পরিহাসের মতো শোনায় না? আনোয়ার হয়তো মস্ত কোনো খ্যাতিমান কবি ছিল না, কিন্তু ওর কবিতাই এখন আমি ভাবছি, কেননা কবিতার মধ্য দিয়েই আমরা ছুঁতে পারি কারও ব্যক্তিগত নিশ্বাস। সেই রকম এক বুকভরা শ্বাস নিয়ে ও বলেছিল, ‘এই মাটিতে এখনো আছে বেঁচে থাকার মানে।’

আজ শুধু চোখে পড়ে বইটিজুড়ে এই বেঁচে থাকবার ইচ্ছে: ‘আজকে আকাশে-বাতাসে কবিতা নেই/তবু ভালো লাগে হাসতেই, বাঁচতেই।’

...

ধান নষ্ট হয়ে যায়, নদী নিঃশেষিত হয়, কিন্তু তবু খানিকটা সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকি আমরা। কেননা ওই একই কবিতায় লিখতে পেরেছিল আনোয়ার: ‘এখনো সজল আশা আছে তবে কোমল মাটিতে ও তৃণমূলে।’

আর এই সেদিন, রাজভবনে বলছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান: আমাদের কিছু নাই। সব নষ্ট করে দিয়া গেছে ওরা। তবু ভয় পাই না। কেননা এখনো বাংলাদেশে মানুষ আছে, আর আছে মাটি।

এখনো সজল আশা আছে তবে কোমল মাটি ও তৃণমূলে। এই মাটিও তৃণের মধ্যে বেঁচে থাকবে আনোয়ার, আর তারই মতো আরও হাজার হাজার শহীদ।

[সময়ের জলছবি থেকে]