প্রিয় ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী

তিনদিন আগে মারা গেছেন ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭—৬ মার্চ ২০১৮),  ছবি: খালেদ সরকার
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭—৬ মার্চ ২০১৮), ছবি: খালেদ সরকার

না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রিয়শিল্পী, প্রিয়জন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। কী বিস্ময়! একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা চলে গেলেন ৭১ বছর বয়সেই। বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের ব্যতিক্রমী রূপদর্শী প্রাকৃতিক ভাস্কর তিনি। গত শতকের নব্বই দশকের গোড়ায় শিল্পবোদ্ধাদের চমকে দিয়েছিলেন নিজের সৃজন সমাহার দিয়ে। কেটে ফেলা গাছের শিকড়, শুকনো ডাল আর তুচ্ছ সাধারণ উপকরণ দিয়ে চেনা আদল তৈরি করে অপ্রচলিত এক শিল্পধারাকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন তিনি—প্রিয়ভাষিণী।

তাঁকে চিনেছি আজ থেকে অন্তত ৩০ বছর আগে, যশোরে। মনে পড়ে, চারুপীঠের উদ্গাতা সহপাঠী ভাস্কর মাহবুব জামাল শামিম ও শিল্পী হিরণ্ময় চন্দকে নিয়ে স্টেশন রোডের বাসায় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, ১৯৮৮ সালের মার্চের এক বিকেলে। তখনো তিনি তারুণ্যদীপ্ত, একে একে ছয় সন্তানের জননী হয়েও। বাড়ির বসার ঘরটিতে তাঁর শিল্পী মনের নজরকাড়া রুচির ছাপ। বাঁশের তৈরি সোফাসেট, টেবিলল্যাম্প, পেয়ারাগাছের ডাল দিয়ে তৈরি সেন্টার টেবিল, মরা ডালকে জড়িয়ে ধরা সবুজ লতানো গাছের শোভা দেখে কারও আর বুঝতে বাকি থাকে না এ বাড়ির গৃহিণী নেহাত সাধারণ কেউ নন—সৃজনশীল, শিল্পী। সেদিন আমি যে তাঁর দুর্দান্ত সব সৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেই মুগ্ধতা আজও বহন করে চলেছি।

১৯৯১ সালে চারুপীঠের আয়োজনে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় যশোর ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে। এ আয়োজনের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে চারুপীঠের। একপ্রকার লজ্জা থেকে ব্যক্তিগত শিল্পসৃজনকে জনসম্মুখে আনতে ইচ্ছুক ছিলেন না শিল্পী। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাঁকে রাজি করান মাহবুব জামাল শামিম ও হিরণ্ময় চন্দ। বরেণ্য চিত্রকর এস এম সুলতান উদ্বোধন করেছিলেন সেই প্রদর্শনীর। প্রিয়ভাষিণীর কাজের ধরন ও শিল্পবোধের ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলেন তিনি। ওই প্রদর্শনী দেখেননি, সে সময় যশোর শহরে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকরই ছিল।

বাংলাদেশের শিল্পসভায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর। আবির্ভাবেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের পর ২০০০-এ এসে যশোরে তাঁর আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল চারুপীঠ।

প্রথম প্রদর্শনীর পর দ্বিগুণ উৎসাহে নিজের শিল্পচর্চা এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। স্বামীর কর্মসূত্রে থেকেছেন সিলেটের চা-বাগানের বাংলোবাড়িতে। ফেলে দেওয়া চাগাছের শিকড় সংগ্রহ করে তা দিয়ে গড়েছেন আসবাব ও শোপিস। সংসারের শত ব্যস্ততায় একজন গৃহিণীর মনে বাস করা শিল্প চেতনাকে ফুটিয়ে তোলার এই প্রয়াস আর দশজন নারীর থেকে আলাদা করেছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে।

সে সময় যশোরে থাকতেন। কোনো একদিন স্বামীর সঙ্গে গাড়িতে করে যশোরের বাড়িতে ফিরছিলেন প্রিয়ভাষিণী। পথিমধ্যে দেখতে পেলেন আকস্মিক ঝড়ে পথের পাশে উপড়ে পড়েছে কিছু গাছ। গাড়ি থেকে নেমে স্বামীকে তিনি বললেন, তুমি বাড়ি যাও। আমি এগুলোর একটা বিহিত করে আসছি। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় গাছ কেটে ট্রাকে ভরে বাড়ি ফিরলেন তিনি। এই গাছগুলোই হয়ে উঠল তাঁর ভাস্কর্য গড়ার উপাদান।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আঁকা রবীন্দ্রনাথ। সংগ্রহ:  নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আঁকা রবীন্দ্রনাথ। সংগ্রহ: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর স্বামী কাজী আহসানউল্লাহ সাহেব ঢাকায় বদলি হলে সপরিবারে তাঁরা চলে এলেন এই মহানগরে। উঠলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে এক বাড়িতে। বাড়ির সামনে বাগান, খোলা জায়গা। এখানে তিনি কাজ করতেন, ব্যস্ত থাকতেন নিজের সৃজনকর্মে। আমি দু-তিনবার দেখতে গিয়েছি ঢাকায় তাঁর ওই সৃষ্টি সমাহার। নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতেন, কথা বলতে ভালোবাসতেন। আমরা যারা তাঁর পুরোনো চেনা মানুষ, তারা গেলে যেমন খুশি হতেন, নতুনেরা গেলেও আপ্লুত হতেন। বড় একটা স্টুডিওর স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেটি সর্বাংশে পূরণ হয়নি। তবে যখন যেখানে থেকেছেন, নিজ চেষ্টায় তার কিছুটা অংশ স্টুডিও করে নিয়েছেন।

ঢাকায় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বেশ কয়েটি একক প্রদর্শনী হয়েছে। বেঙ্গল তাঁর অন্তত তিনটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে, শিল্পাঙ্গনেও অনুরূপ তিনটি প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রদর্শনী করেছে ব্র্যাক ব্যাংকসহ অন্যরা।

তাঁর কাজ নিয়ে নানা কাগজে লিখেছি আমি। দেখা হলে সবিনয়ে বলতেন, ‘ভাই, তোমার লেখাটা পড়ে ভারি আনন্দ পেয়েছি। আমি যা করতে পারিনি, তুমি লেখায় তাই বলে দিয়েছ।’ নিশ্চয় এটি তাঁর বড় মনের বিনয়।

তাঁর আরেকটি উজ্জ্বল পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। নিজের আবেগ-অনুভূতি, শারীরিক যাতনার বাস্তবতা, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা স্পর্শ করে তৈরি হয়েছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শিল্পবোধ। নন্দন-চেতনায় প্রকাশ পেয়েছে সৃষ্টি প্রাচুর্যের অনুপম ও চমকপ্রদ আলেখ্য। ২০১০ সালে অর্জন করেছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’।

প্রাতিষ্ঠানিক ভাস্কর্য শিল্পশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তিনি পাননি। ছিলেন স্বশিক্ষিত শিল্পী। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে দৃশ্যমানতার আবেদন বুঝেশুনে প্রাকৃতিক রীতির অনুসরণে নিজেকে গড়ে তুলেছেন বলেই তিনি ব্যতিক্রমধর্মী এক ভাস্কর ও শিল্পী।

একাত্তর-পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের বাস্তবতা, বিষণ্নতা ও দুঃখবোধ তাঁকে অত্যাচারিত ও অবহেলিত করে তুলেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির অত্যাচার, সামাজিক অবহেলার সেই তীব্র কষ্ট থেকে উঠে আসা অসামান্য শিল্পবোধ ও শিল্পসত্তা বারবার প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কাজে। ফেলে দেওয়া বাতিল ও পুরোনো গাছের ডাল, গুঁড়ি, শিকড়, লতাপাতা, পোড়া কাঠ, শেওলাযুক্ত বাঁশের অংশ, বটের ঝুরি, পরিত্যক্ত হাঁড়ি-কলসি, ধাতব টুকরো যেন তাঁর গভীর যাতনাময় জীবনের অংশ। এসব নিয়েই তো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর অভিনব শিল্পযাত্রা।

আমরা সাধারণ চোখে টের পাই না বটে, তবে শিল্পীর চোখ যেকোনো অকেজো বস্তুর মধ্যে মানুষ কিংবা জীবজন্তুর অবয়ব ও গঠনাকারের কিছুটা ছায়া, সাদৃশ্য বা মিল খুঁজে পান। সেটিকে পরম যত্নে কুড়িয়ে নিয়ে তার ভেতর থেকে শিল্পগুণ আবিষ্কার করাটাই প্রিয়ভাষিণীর আরাধ্য। এভাবেই মূল্যহীনকে অমূল্য করে সবার সামনে তিনি তুলে ধরেছেন স্থাপনা ও ভাস্কর্যে। ঘরের দেয়াল, বসার ঘর, আহারকক্ষ, বারান্দা কিংবা বাগানের সামনে নিসর্গ রচনা, ঝরনা বা ফোয়ারার বিন্যাস—এসব শিল্পবস্তু তাঁর নতুন শিল্পগুণের পরিচায়ক হয়ে দেখা দেয়। তাঁর সৃষ্টি উন্মুক্ত ও আবৃত পরিসরে স্থানান্তরিত বা স্থাপিত হয়ে উজ্জ্বল অস্তিত্বে প্রকাশিত হয় যেমন, একইভাবে তা দর্শক-দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁদের সুখানুভূতিও সৃষ্টি করে। এখানেই বুঝি এই ভাস্করের শিল্পজীবনের সৃষ্টিশীলতার সফলতা ও সার্থকতা। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায়। আর চলে গেলেন ৬ মার্চ। এই সংগ্রামী শিল্পীর প্রয়াণে বাংলাদেশের সমকালীন ভাস্কর্যের ব্যতিক্রমী ধারাটিতে হয়তো সাময়িক ছেদ পড়ল।