কীভাবে এল '#মিটু'

>

নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ নিয়ে গোটা পৃথিবী এখন সোচ্চার। ‘#মিটু’ আন্দোলন হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের অভিন্ন মঞ্চ। নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ কীভাবে ধরা পড়েছে আমাদের সাহিত্য ও আত্মজীবনীতে? #মিটু আন্দোলনের পূর্বাপর প্রেক্ষাপটই-বা কী? গতকাল পেরিয়ে গেল বিশ্ব নারী দিবস। এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে আজকের আয়োজন।

নারীদের যৌন নিগ্রহের ব্যাপারে সরব অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। ছবি: ইনেস্টাগ্রাম থেকে
নারীদের যৌন নিগ্রহের ব্যাপারে সরব অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। ছবি: ইনেস্টাগ্রাম থেকে

১৯৯৭ সাল। হলিউড নায়িকা অ্যাশলে জুড পেশাগত কারণে দেখা করতে গিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রির ক্ষমতাধর ব্যক্তি মিরাম্যাক্স স্টুডিওর কর্ণধার হার্ভি ওয়াইনস্টিনের সঙ্গে। বেভারলি হিলসের সেই পাঁচতারা হোটেল রুমে হার্ভের যৌন নিগ্রহের শিকার হন তিনি। লজ্জা-অপমানে তখন মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু ঠিক করলেন, চুপ থাকবেন না। দুনিয়ার কাছে উন্মোচন করে দেবেন হার্ভি ওয়াইনস্টিন নামের এই বিকৃত রুচির পুরুষের মুখোশ।

ব্যাপারটা সহজ ছিল না। হার্ভি পুরুষ, ক্ষমতাবানও। সে সময় ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই হেসে জুডকে বলেছিলেন, হার্ভের এই চরিত্রের কথা সবারই জানা। কিচ্ছুটি করার নেই। সে সময় এক সাক্ষাৎকারে ক্ষোভ নিয়ে বলেছিলেন জুড, ‘পৃথিবীতে আমাদের কথা শোনার তাহলে কেউ নেই?’ তবে তলে তলে সত্যিই বদলে যাচ্ছিল চারপাশ।

অবশেষে গেল বছর অক্টোবরে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন হলিউডের ডজনখানেক পেশাজীবী নারী, যাঁদের মধ্যে ছিলেন রোজ ম্যাকগাওয়ান ও এশিয়া আর্জেন্টোর মতো অভিনেত্রীরাও। শুরুটা হয় ৫ অক্টোবর প্রকাশিত দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও ১০ অক্টোবর প্রকাশিত দ্য নিউইয়র্কার–এর দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে। এরপর ১৫ অক্টোবর ২০১৭। অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো হলিউডে পেশাজীবী নারীদের যৌন নিগ্রহের ব্যাপারে জেনে ক্ষুব্ধ-অপমানিত স্বরে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখলেন, ‘আপনিও যদি এমন যৌন নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন কখনো, তবে এই টুইটের উত্তরে স্রেফ লিখুন মি টু—আমিও!’ পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে মিলানো দেখেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর টুইটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দুই লাখ নারী লিখেছেন এই কথা—‘আমিও’! পরদিন সংখ্যাটা হয়ে দাঁড়াল পাঁচ লাখ। কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিলানো! এ এক অভাবনীয় ঘটনা!

হার্ভি ওয়াইনস্টিনের িবরুদ্ধে কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন নিগ্রহ নিয়ে গত ১০ অক্টোবর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন পত্রিকা দ্য নিউইয়র্কার। যুক্তরাস্ট্রের প্রভাবশালী এই প্রযোজোকের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন হলিউডের পেশাজীবী নারীরা
হার্ভি ওয়াইনস্টিনের িবরুদ্ধে কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন নিগ্রহ নিয়ে গত ১০ অক্টোবর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন পত্রিকা দ্য নিউইয়র্কার। যুক্তরাস্ট্রের প্রভাবশালী এই প্রযোজোকের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন হলিউডের পেশাজীবী নারীরা

‘হ্যাশ ট্যাগ মি টু’ নামের এই আন্দোলনের শুরু কিন্তু আরও আগে। সমাজকর্মী তারানা ব্রুক প্রথম ২০০৬ সালে শুরু করেছিলেন এই আন্দোলন। তুমি একা নও, আমিও আছি—এই ছিল তাঁর বার্তা। #মিটু নামে এক প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। ১৩ বছরের একটি কিশোরী প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার পর কিছুই করতে না পেরে তারানা নাকি কেবল তাকে অশ্রুসজল চোখে বলেছিলেন, #মিটু। সেই থেকে শুরু।

কিন্তু হলিউড তারকা মিলানোর টুইট এই শব্দ দুটিকে পরিণত করেছে সারা পৃথিবীর নারীদের মনের কথায়। এ পর্যন্ত পৃথিবীর ৮৫টি দেশ থেকে কোটি কোটি নারী অনলাইনে পৌঁছে দিয়েছেন এই বার্তা। হ্যাঁ, আমিও। আমারও জীবনে ঘটেছে এই ঘটনা। ঘটেছে বাড়িতে, অফিসে, হোটেলে, মেলায়, অনুষ্ঠানে, যানবাহনে, খেলায়, সেটে এমনকি পবিত্র ধর্মস্থানে, উপাসনালয়ে।

মুখ খুলেছেন অভিনয় ও বিনোদন জগতের নারীরা, মুখ খুলেছেন করপোরেট জগতের সফল নারীরা, সাংসদ ও রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, পাইলট, পেশাজীবী—সবাই। আর সাধারণ নারীরা তো বলছেনই।

এ যেন বহু দিনের বদ্ধ আগল খুলে যাওয়া। সেই খোলা জানালা দিয়ে গল গল করে বেরিয়ে এসেছে শত বছরে লাঞ্চনা, গ্লানি, ক্লেদ আর অন্ধকার।