আন্দোলন-পরবর্তী প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

>

নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ নিয়ে গোটা পৃথিবী এখন সোচ্চার। ‘#মিটু’ আন্দোলন হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের অভিন্ন মঞ্চ। নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ কীভাবে ধরা পড়েছে আমাদের সাহিত্য ও আত্মজীবনীতে? #মিটু আন্দোলনের পূর্বাপর প্রেক্ষাপটই-বা কী? গতকাল পেরিয়ে গেল বিশ্ব নারী দিবস। এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে আজকের আয়োজন।

ঢাকা লিট ফেস্টে বাংলা একাডেমির লনে ‘#মিটু’ শিরোনামের অধিবেশনে আলোচকরা, ১৭ নভেম্বর ২০১৭  ছবি: বাংলা ট্রিবিউনের সৌজনে্য
ঢাকা লিট ফেস্টে বাংলা একাডেমির লনে ‘#মিটু’ শিরোনামের অধিবেশনে আলোচকরা, ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ছবি: বাংলা ট্রিবিউনের সৌজনে্য

নারীর যৌন নিগ্রহ নিয়ে আন্দোলন যে হচ্ছে, কি লাভ এতে? কি হবে এই সব বলে? আজকের দুনিয়ায় এখনো যুদ্ধ মানে শত শত নারীকে ধর্ষণ, নারীর প্রতি অসদাচরণকারী পুরুষ নির্বিবাদে ভোটে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় এই পৃথিবীতে, এই ঝাঁ চকচকে সভ্য জনপদে এমনকি মেয়েশিশুরাও নিরাপদ নয় পুরুষের কাছে। #মিটু নামের এই ভার্চ্যুয়াল একাত্মতা, এই সহমর্মিতাবোধ, এ সম্মিলিত ক্রন্দন আদৌ কিছু বদলাতে পারবে কি? হয়তো পারবে না। তবে দুনিয়াজুড়ে কোথায় যেন একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তথাকথিত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী পুরুষদের অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে কখনো কিছু বলা যাবে না বা বলে লাভ নেই—এই ধারণা ক্রমাগত ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। যৌন নির্যাতনের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছেন উবারের সিইও ট্রাভিস ক্যালানিক, টুডে শোর বিখ্যাত উপস্থাপক ম্যাট ল্যুর বাধ্য হয়েছেন শো ছেড়ে দিতে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন যৌন নিপীড়নকারী জিমন্যাস্টিক চিকিৎসক ল্যারি নাসার, অভিযোগ উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সিনেটরের বিরুদ্ধে, অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনের মতো প্রতিষ্ঠানও আজ দাঁড়িয়েছে কাঠগড়ায়, অপরাধ স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন অক্সফামের পরিচালক ভ্যান হাওয়ারমায়ারেন, পেন্টাগনের ১৫ হাজার নারী সেনা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তুলেছেন ইতিমধ্যে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কায়রো পর্যন্ত ‘#মিটু’ প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নেমেছেন হাজার হাজার নারী। অস্কার, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, বাফটা অনুষ্ঠানে কালো পোশাক, ব্যাজ বা গোলাপ নিয়ে দলে দলে প্রতিবাদ করছেন অভিনেত্রী ও গায়িকারা। হলিউডের পেশাজীবী নারীরা গড়ে তুলেছেন ‘টাইমস আপ’ নামের যৌন নিপীড়নবিরোধী তহবিল। টাইম ম্যাগাজিন ২০১৭ সালের সর্বাধিক আলোচিত চরিত্র হিসেবে তুলে এনেছে হাশ টাগ মি টু-কে। #মিটু বিল নিয়ে কথা হচ্ছে ইউএস কংগ্রেসে, পরিবর্তন আসছে পশ্চিমা দেশগুলোর যৌননিগ্রহ-বিষয়ক আইনে। উইকিপিডিয়ায় গুরুত্ব সহকারে সংযোজিত হয়েছে #মিটু শব্দ দুটি। আর এই প্রথম দুনিয়া দেখতে পাচ্ছে অনগ্রসর ও রক্ষণশীল সমাজ থেকেও উঠে আসছে নারীর সোচ্চার কণ্ঠ। তাহলে কি সত্যি পাল্টাবে দিন?

#মিটু আন্দোলন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যেও। সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও ফেসবুক বন্ধুদের অনেককেই দেখা যাচ্ছে এই বার্তায় শরিক হতে। এছাড়া ঢাকায় অনুষ্ঠিত লিট ফেস্টেও নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ তথা #মিটু নিয়ে ছিল বিশেষ অধিবেশন। তবে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেখানে #মিটু শুরুই হয়েছে মিডিয়া ও বিনোদন জগতের নারীদের হাত ধরে; গিনেথ প্যালেট্রো, জেনিফার লরেন্স, উমা থারমান, স্কারলেট জোহানসন–এর মতো বিখ্যাত তারকারা সোচ্চার হয়েছেন এই প্রসঙ্গে, নারী সাংবাদিক ও করপোরেট জগতের নারীরা ধারাবাহিকভাবে মুখ খুলে ভিত নড়িয়ে দিচ্ছেন প্রভাবশালী পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর; সেখানে আমাদের কর্মমুখর নারীরা প্রায় নিশ্চুপ। কেন?

আমাদের দেশে অফিস, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া বা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে না, কথাটি এখন কেউ-ই করবে না। কিন্তু সেই সোচ্চার কণ্ঠ শুনতে পেলাম কই? এ দেশের কোনো কোনো নারী ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন #মিটু পেজে, অনেকেই স্মরণ করেছেন শৈশবে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর অতীতের কথা, কিন্তু প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান কামুক পুরুষের দিকে আঙুল তোলার সাহস দেখা যায়নি এখনো। এর কারণটা খুবই সরল। ধরা যাক, অ্যাশলে জুডের মতো কোনো অভিনেত্রী হার্ভি ওয়াইনস্টিনের মতো প্রভাবশালী পুরুষের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তুললেন এই দেশে। আমাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে তখন? রুপালি জগতটা এমনই, নাচতে নেমে আবার ঘোমটা টানা কেন? হোটেল রুমে প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কী হয় তা বুঝি জানা নেই? ছোট জামা পরে নাচবে আর পুরুষদের লোল পড়বে না তাই কি হয়?

চলুন মনে করার চেষ্টা করি নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ-সংক্রান্ত বাংলাদেশের কয়েকটি ঘটনা। গেল বছর ঢাকা শহরে বনানীর এক হোটেলে ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের ছেলের বিরুদ্ধে সাধারণ দুই ছাত্রীর যৌন নির্যাতনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণভাবে কেমন ছিল আমাদের প্রতিক্রিয়া: এত রাতে জন্মদিন পালন করতে হোটেলে যাওয়ার সময় মনে ছিল না?

আবার এক অভিনেত্রীর প্রেমিক পুরুষ ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও ছেড়ে দিলে আবালবৃদ্ধবণিতা হুমড়ি খেয়ে নায়িকার অনাবৃত শরীর দেখে মনের সুখ মিটিয়েছেন এই দেশে, অথচ অপরাধী পুরুষটির বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি কেউই। এমনকি ওই অভিনেত্রীর অভিনয় জগতের বন্ধুবান্ধব ও শুভার্থীরাও ছোঁয়া বাঁচাতে সরে গিয়েছিলেন নিরাপদ দূরত্বে।

এরও আগে একজন নারী মডেলকে খুন করে ব্রিজের নিচে লাশ ফেলে দেওয়ার পরও অভিযুক্ত প্রভাবশালী পুরুষটির টিকি ছোঁয়া যায়নি। বরং ওই নারী মডেলের চরিত্র নিয়েই কথা উঠেছে, পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে কেচ্ছাকাহিনি।

এই চিত্র কেবল বিনোদন জগতের নয়, সর্বক্ষেত্রের। আমাদের সমাজ আঙুল তোলে নির্যাতিত মেয়েটির দিকেই। তুমিই খারাপ, তুমিই বেশ্যা। তুমিই প্রলুব্ধ করেছ পুরুষকে। পুরুষের চরিত্র জেনেও কেন তুমি পয়লা বৈশাখে ভিড়ের মধ্যে যাও? কেন রাত-বিরাতে একা বাসে চলাচল করো? কেন প্রেমিক পুরুষটিকে বিশ্বাস করে বেড়াতে গিয়েছিলে? কেন বাড়ি ছেড়ে বাইরে কাজ করতে এসেছ? অমন প্রলুব্ধকারী পোশাক পরেছ কেন?

২০০৬ সালে সমাজকর্মী তারানা ব্রুক (বঁায়ে) শুরু করেছিলেন ‘#মিটু’ নামের আন্দোলন। পরে তাতে যোগ দেন অভিনেত্রী রোজ ম্যাকগাওয়ান
২০০৬ সালে সমাজকর্মী তারানা ব্রুক (বঁায়ে) শুরু করেছিলেন ‘#মিটু’ নামের আন্দোলন। পরে তাতে যোগ দেন অভিনেত্রী রোজ ম্যাকগাওয়ান

পরিস্থতি যখন এমন তখন আমাদের শিক্ষিত অধিষ্ঠিত নারীরাও মুখে কুলুপ আঁটবেন এটাই স্বাভাবিক। আর গৃহকর্মী, গার্মেন্টসকর্মী বা বিপণনকর্মী মেয়েরা—এই শ্রেণির কথা তো বলাই বাহুল্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের পাশের দেশের অবস্থাও প্রায় তথৈবচ। উদহারণের স্বার্থে বলিউডেই ফিরতে হচ্ছে আবার। কঙ্গনা রনৌত, আলিয়া ভাট, সোনম কাপুর বা রিচা চাধ্ধার মতো অভিনেত্রীরা নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করলেও সমাজসচেতন নারীবাদী অভিনেত্রী কালকি কোয়েচিন সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছেন খোলামেলা সত্যটা, ‘আমাদের বলিউডে কখনোই #মিটুর মতো একটা আন্দোলন গড়ে উঠবে না!’ কারণও অস্পষ্ট রাখেননি তিনি, ‘কেউ যদি সাহস করে এ নিয়ে কিছু বলেও, তবে তাঁকেই নানা মন্তব্য আর বিচারের সম্মুখীন হতে হবে!’

ব্যাপারটা আদতেই তাই।

আত্মীয় বা গুরুজন কোনো পুরুষের আক্রমণের মুখে কেঁচোর মতো বালিকা, বন্ধু বা প্রেমিকের হাতে নিগৃহীত অপমানিত তরুণী, ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির লোলুপ দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে থাকা কর্মজীবী নারী—সবাই প্রথমে যে কথা ভাবে তা হলো, কী হবে মুখ ফুটে বললে? কি হতে পারে? চারপাশের দুনিয়া কি বলবে? বলা মানে নিজের অসম্মানই ডেকে আনা নয় কি? #মিটু নামের এই ফেসবুক–আন্দোলন কি নারীদের এই আশঙ্কা, এই লজ্জাকে উড়িয়ে দিতে পারবে? পারবে কি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিতে? তা না পারুক, কিন্তু বিশ্বজুড়ে #মিটু যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে নির্যাতিত, অপমানিত, ক্ষুব্ধ নারীদের প্ল্যাটফর্ম। টাইম ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, #মিটু শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দুনিয়ার কোথাও না কোথাও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী পুরুষের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নারীরা আঙুল তুলছেন। যৌন নিপীড়নকারী পুরুষ ও প্রতিষ্ঠানের মুখোশ খসে পড়ছে একে একে। প্রায় প্রতিদিনই পদচ্যুতি, শাস্তি বা ক্ষমা প্রার্থনার খবর আসছে নানা দিক থেকে। গবেষকদের মতে, #মিটু দুনিয়াজুড়ে নারীদের মানসজগতের মধ্যে যে পরিবর্তনের সূচনা করতে চলেছে, তার প্রভাব পড়বে বিনোদন ও শিল্প-জগৎ, মিডিয়া, সাহিত্য, রাজনীতিসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে। #মিটুর প্রবক্তাদের কথা এমন: কিছু হোক আর না হোক, আমাকে বলতে দাও। দুনিয়াকে শুনতে দাও। ফর দ্য মোমেন্ট, দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ লিসেনিং। বিশ্ব কিন্তু শুনছে।