সর্বাত্মক তত্ত্বের খোঁজে

স্টিফেন হকিং (৮ জানুয়ারি ১৯৪১-১৪ মার্চ ২০১৮)
স্টিফেন হকিং (৮ জানুয়ারি ১৯৪১-১৪ মার্চ ২০১৮)

লড়াইটি যখন রাজায় রাজায়, তখন উলু খড়ের প্রাণ যাবেই। কিন্তু লড়াই যখন বিজ্ঞানরাজদের, আমজনতারই তখন বরং পোয়াবারো। ভুল যিনিই করুন, যাঁর তত্ত্ব বা থিওরিই শেষমেশ টিকে থাকুক, মানব সভ্যতা সেখান থেকে কিছু না কিছু পাবেই। হকিং আর কিপ থর্নের লড়াইও তেমনি। তবে এ লড়াই ঢাল-তলোয়ার উঁচিয়ে নয়, লড়াইটি মগজের সঙ্গে মগজের, তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষণের।

লড়াইটি বেঁধেছিল ১৯৭৫ সালে। মহাকাশে ‘সিগনাস এক্স ওয়ান’ নামে একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আছে। ওটি নাকি আস্ত একটা কৃষ্ণগহ্বর, যে গ্রাস করে নিচ্ছে আশপাশে ছড়িয়ে থাকা যাবতীয় পদার্থ, মেরে-কেটে রাহাজানি করে গোগ্রাসে গিলছে আলোও। কৃষ্ণগহ্বর গবেষক, মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের জন্য গেল বছর যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সেই কিপ থর্ন মত দিলেন কৃষ্ণগহ্বরের পক্ষে। কিন্তু হকিং সেটি মানতে নারাজ। তো, ধরা হোক বাজি। সত্যি সত্যি একটি চুক্তি সই করলেন হকিং আর থর্ন। বাজির পণ মেটাতে হবে ম্যাগাজিনে; ডলার-পাউন্ডে নয়। থর্ন যদি হারেন, তবে তিনি ব্রিটিশ কমেডি পত্রিকা প্রাইভেট আই-এর গ্রাহক করে দেবেন হকিংকে, চার বছরের জন্য। আর থর্ন জিতলে হকিং তাঁকে গ্রাহক করে দেবেন আমেরিকান পর্ন ম্যাগাজিন পেন্টহাউজ-এর।

আজব বাজি বটে। হকিং যতই ‘সিগনাস এক্স ওয়ান কৃষ্ণগহ্বর’ এই ধারণার বিপক্ষে থাকুন না কেন, মনে মনে তিনি চাইছিলেন বাজিতে হারতে। কারণ তাতে তাঁরই লাভ। তখনো পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বরের দৌড় তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের খাতা-কলমে, সমীকরণের আঁচড়ে। আর সেই সমীকরণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যেটি, তা হকিংয়েরই দেওয়া। তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকে যেমন কোনো কিছু এমনকি আলো পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পারে না, তেমনি ঠিক কৃষ্ণগহ্বরে শক্তিবলয়ের বাইরে একটা বিকিরণ বলয়ের জন্ম হবে, যে বিকিরণকে বিজ্ঞানীরা এখন ডাকেন ‘হকিং বিকিরণ’ নামে, সেই বিকিরণই পাইয়ে দেবে কৃষ্ণগহ্বরের খোঁজ।

১৯৭৫ সালের প্রযুক্তি আজকের মতো এত উন্নত ছিল না, তাই নিশ্চিত করে বলার উপায় ছিল না ওটা আসলেই কৃষ্ণগহ্বর কি না। কিন্তু থর্ন ছিলেন আশাবাদী, আর হকিংয়ের মনে ডাকছিল কু-ডাক। যদি ওটা কৃষ্ণগহ্বর না হয়! তাহলে বাজি জেতার সান্ত্বনাটুকু থাকবে। আর যদি সত্যিই কৃষ্ণগহ্বর হয়, তাহলে আখেরে হকিং বিকিরণতত্ত্বের বাজিমাত!

এই হলেন স্টিফেন হকিং। হার মানতে তিনি নারাজ, সে হোক জীবনের সঙ্গে, বাজিতে এমনকি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বেও।

২২ বছর বয়সে শরীর অচল হতে শুরু করে তাঁর। সক্রিয় মাথাকে সম্বল করে গবেষণা করে গেছেন টানা ৫৪ বছর। কল্পনার ফানুস উড়িয়ে, মস্তিষ্কের ভেতরে, কম্পিউটারের পর্দায় অঙ্ক কষে দিয়েছেন মহাকাশের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুর খোঁজ। তাঁর তত্ত্বের সূত্রেই মিলেছে কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান। আশির দশকের শেষে এসে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যখন প্রমাণ করলেন সিগন্যাস এক্স ওয়ান আসলেই একটি কৃষ্ণগহ্বর, তখন হার হলো বাজিকর হকিংয়ের, জয় হলো তাঁর বৈজ্ঞানিক সত্তার।

সত্তরের দশকের শুরু থেকেই হকিং একে একে লিখে গেছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বই। আশির মধ্যভাগে এসে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় ঢঙে ঢেলে লিখলেন বিজ্ঞান ইতিহাসের কালজয়ী গ্রন্থ আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম। টানা ২৩৭ সপ্তাহ ব্রিটিশ সানডে টাইমস-এ বেস্ট সেলার থেকে রেকর্ড গড়েছিল সেটি, সেই সাফল্য তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে আরও কিছু কালজয়ী বিজ্ঞান-সাহিত্য। এর মধ্যে পাঠকপ্রিয়তার বিচারে ওপারের দিকেই আছে দ্য থিওরি অব এভরিথিং

দ্য থিওরি অব এভরিথিং: মহাবিশ্বের জন্ম এবং শেষ পরিণতি  স্টিফেন হকিং  অনুবাদ: আবুল বাসার  প্রচ্ছদ: মাহবুব রহমান, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৫২, দাম: ৩০০ টাকা।
দ্য থিওরি অব এভরিথিং: মহাবিশ্বের জন্ম এবং শেষ পরিণতি স্টিফেন হকিং অনুবাদ: আবুল বাসার প্রচ্ছদ: মাহবুব রহমান, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৫২, দাম: ৩০০ টাকা।

মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন জীবনের শেষ ত্রিশ বছর কাটিয়েছিলেন একটি সর্বাত্মক তত্ত্বের খোঁজে। কারণ কণিকাদের ক্ষুদ্র জগৎ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে কেবল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কিন্তু মহাজগৎকে ব্যাখ্যা করতে দরকার হয় আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার। অথচ পদার্থবিদ্যার কাজই হলো একটা সরল সার্বিক তত্ত্ব অনুসন্ধান করা। কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে তা আরও জরুরি। কেননা, কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষীয় টান ব্যাখ্যা করতে যেমন সাধারণ অপেক্ষিতার দরকার হয়, আবার হকিং বিকিরণের ব্যাখ্যায় প্রয়োজন কোয়ান্টাম তত্ত্বের। তবে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের জগতের ব্যাখ্যা করতে হলে, যা এখনো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান করে উঠতে পারেনি, তার জন্য চাই এ দুই তত্ত্বের একটা একীভূত তত্ত্ব। একেই বলা হচ্ছে ‘থিওরি অব এভরিথিং’। আইনস্টাইন ব্যর্থ হয়েছিলেন, হকিংয়ের সমকালীন বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন নানা উপায়ে সেই কাঙ্ক্ষিত তত্ত্বের নাগাল পেতে। হকিং নিজেও যোগ দিয়েছিলেন সেই মহারণে। কিন্তু আইনস্টাইনের মতো তাঁকেও ব্যর্থতা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো।

হকিংয়ের থিওরি অব এভরিথিং বইটির বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছে সম্প্রতি। বইটি শুরু হয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের কী ধারণা, এর জন্ম কীভাবে হলো, কীভাবে তা বেড়ে উঠল—এসব দিয়ে। এরপর স্বাদু গল্পের ঢঙে হকিং আমাদের নিয়ে গেছেনে কৃষ্ণগহ্বরের রহস্যময় জগতে। ব্যাখ্যা করেছেন এর চরিত্র, উঠে এসেছে এর খোঁজে বিজ্ঞানীদের কালঘাম ছুটে যাওয়ার কাহিনিও। সবশেষে সাধারণ পাঠকদের তিনি জানিয়েছেন, কেন একটা সর্বাত্মক তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া জরুরি। এই তত্ত্বের কাঠামো তৈরি করতে বিভিন্ন বিজ্ঞানী যেসব আলাদা আলাদা তত্ত্ব দিয়েছেন, হকিং সেসবেরও সুলুক-সন্ধান করেছেন। বলেছেন স্ট্রিং থিওরির সাফল্য-ব্যর্থতার গল্প। আর বইটি তিনি শেষ করেছেন আশাবাদ রেখেই, ‘আমরা যদি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই, সেটিই হবে মানবজাতির চূড়ান্ত অর্জন।’

হকিং যেমন সহজ-সাবলীল গদ্যে বইটি লিখেছেন সাধারণ পাঠকের জন্য, বাংলা অনুবাদে সাধারণীকরণ করার কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। অনুবাদক আবুল বাসার নিজে একাধারে বিজ্ঞানের ছাত্র এবং সুসাহিত্যিক বলেই দুরূহ কাজটা করতে পেরেছেন স্বচ্ছন্দে। বিজ্ঞানবিষয়ক বই হলেও এটি তেমন কঠিন নয়, তরতর করেই পড়া যাবে।