আরেকবার 'মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা' প্রসঙ্গ

প্রথম আলোর ৯ মার্চ ২০১৮ তারিখের ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতায় তারিক মনজুর ‘রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা: পুনশ্চের অস্পষ্টতা’ শিরোনামের লেখায় বিষয়টির অস্পষ্টতা দূর করতে গিয়ে এমন কিছু প্রসঙ্গ তুলেছেন, যা বিষয়ের অস্পষ্টতা তো দূর করেইনি, বরং মূল ছেড়ে বহুদূর চলে গেছে। তিনি এমন সব কথা আমার বরাত দিয়ে লিখেছেন, যেগুলো আমার লেখায় ছিল না। যেমন ‘প্রধানত অঞ্চলবিশেষের উপভাষাকে তিনি মাতৃভাষা বলেছেন।’ না, এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। নিজের অপ্রাসঙ্গিক আলাপ দাঁড় করানোর জন্য তিনি কথাটা আমার নামে চালিয়ে দিয়েছেন মাত্র।

মাতৃভাষা বিষয়টির জটিলতা বোঝানোর জন্য মনজুর জার্মানিতে বসবাসকারী ফরাসি দম্পতির সন্তানের প্রসঙ্গ টেনেছেন। প্রসঙ্গটি আসলে ‘জটিল’ নয়, সরল এবং ভুল। সরল এ অর্থে যে ইউরোপে বাবা-মা দুজন দুই ভাষার, আর সন্তান বড় হয়েছে অন্য ভাষা-পরিস্থিতিতে এবং শিখেছে অন্য ভাষা—এ রকম উদাহরণ যথেষ্ট আছে। প্রবাসী বাঙালিদের ক্ষেত্রে প্রবাসী হওয়ার আগের সন্তানের ভাষা বাংলা আর প্রবাসে জন্ম নেওয়া সন্তানের ভাষা ইংরেজি, এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। আর ‘ভুল’ বলছি এ কারণে যে ‘মাতৃভাষা’ আক্ষরিক অর্থে মায়ের ভাষা বোঝায় না, রূপকার্থে বোঝায় মাত্র। এ কারণেই মায়ের অনুপস্থিতিতেও সন্তান ‘মায়ের ভাষা’ শিখতে পারে।

তারিক মনজুর একটু ঠাট্টার সুরে বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ’ আঞ্চলিক ভাষা আর উপভাষার ফারাক করতে জানে না। ‘সাধারণ মানুষ’ হতে আমি আপত্তি করব না, কিন্তু আমার লেখায় আঞ্চলিক ভাষার ধারণা দিয়ে উপভাষা ব্যাখ্যা করা হয়নি। তিনি যে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষই আলাদা আলাদা উপভাষা বহন করে’, সেটা বরং একটা অতিকথন। প্রত্যেক মানুষের ভাষা যে আলাদা, সে কথা ভাষাবিজ্ঞানশাস্ত্র মান্য করে। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য ওই শাস্ত্রে কতগুলো স্বীকৃত পন্থাও আছে। কিন্তু এগুলোকে উপভাষা বলা হয় না। কারণ কতটা ভাষিক পার্থক্যের জন্য আলাদা উপভাষা বা ভাষা বলা যাবে, তা নির্ণয়ের সূত্র আছে। তা না হলে ভাষাবিজ্ঞান বলে কোনো শাস্ত্র কাজই করতে পারত না।

‘প্রথম ভাষা’ এবং ‘দ্বিতীয় ভাষা’ প্রসঙ্গে মনজুরের বক্তব্য চালু অর্থে ঠিকই আছে। বাংলাদেশে যেমন ইংরেজি শেখার ব্যাপারটাকে ‘দ্বিতীয় ভাষা শেখা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু যে অর্থে আমি আঞ্চলিক উপভাষাকে প্রথম ভাষা এবং প্রমিত বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা বলেছি, তাতে আপত্তি করার তো কোনো কারণ নেই। কারণ এই বিবৃতিও চালু এবং ভাষাবিজ্ঞানসম্মত।

‘বিরোধটা মাতৃভাষা নিয়ে নয়’—আমার এ বক্তব্য পরিবর্তন করার দরকার দেখছি না। তাতে ‘ভাষার রাজনীতি’ নিয়ে মনজুর যদি আরেক দফা ভাবেন, ভালোই হয়। কারণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তিনি ‘শহজ বাংলা’র যে উদাহরণ পাকিস্তান আমল থেকে চয়ন করেছেন, তা একেবারেই অযথার্থ। ‘শহজ বাংলা’ মাতৃভাষার প্রসঙ্গ ছিল না, ছিল আনুষ্ঠানিক বাংলা-সংক্রান্ত একটা প্রস্তাব। এখানে মনজুর একটু অসততা করেছেন, যেটা ঢাকায় অনেকেই ভাষা-আলোচনার সময় করে থাকেন। তিনি ‘শহজ বাংলা’র আরবি-ফারসিকরণের প্রসঙ্গ ফেঁদেছেন। এখানে তিনি দ্বিতীয়বার ভুল করেছেন। ‘শহজ বাংলা’ওয়ালাদের আর যে দোষই থাকুক না কেন, তারা আমাদের মুখের ভাষায় আরবি-ফারসি বাড়িয়ে পাক-পবিত্র করার চেষ্টা করেনি; যে শব্দগুলো মুখে আছে, সেগুলোকে লেখায় ব্যবহারের স্বীকৃতি চেয়েছিল মাত্র।

মোহাম্মদ আজম

সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।