লেখক বঙ্গবন্ধু

>

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫), শিল্পী: রফিকুন নবী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫), শিল্পী: রফিকুন নবী

অসমাপ্ত আত্মজীবনীকারাগারের রোজনামচা বের হওয়ার পর সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক পরিচয়ের গোপন কুঠুরি। সেই কুঠুরির আরেকটি অংশ একটি ভ্রমণকাহিনি। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের ওপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা নয়াচীন নামে বইটি অচিরেই প্রকাশিত হবে বাংলা একাডেমি থেকে। জন্মদিন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর লেখকসত্তা খুঁজে দেখার প্রয়াস

পৃথিবীর সব ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রনায়কই মূলত লেখক, দার্শনিক বা চিন্তক; তা না হলে তিনি শুধুই রাজনীতিক মাত্র। ফলে সংস্কৃতিমনস্কতা তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই যেসব রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, রাষ্ট্রদর্শন ও মানবিকতার আদর্শগত তাত্ত্বিকতায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন, তাঁরা লেখক-বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়ক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, ইংল্যান্ডের উইনস্টন চার্চিল, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বা সেনেগালের লিওপল্ড সেদর সেংঘর বা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা—তাঁরা সবাই-ই খ্যাতকীর্তি রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতাসংগ্রামী বা মানবতাবাদী লেখক-দার্শনিক এবং সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ও ইতিহাস-ব্যাখ্যাতা। অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়, আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁদের ধারায় নিজেকে বিন্যস্ত করেছিলেন। তাঁরও তাঁদের মতো একটি স্বকীয় রাষ্ট্রদর্শন ছিল, উপনিবেশ-উত্তরকালে নতুন ধরনের আধিপত্যবাদ ও আধা ঔপনিবেশিক ধাঁচের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল সংগ্রামের রণনীতি ও কৌশল। আর সে বিষয়ে তাঁর নিরন্তর দেশব্যাপী জনসংযোগ, অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা, সুচিন্তিত অমোঘ কর্মসূচি ঘোষণা, দীর্ঘ কারাবরণ ও নির্যাতন সহ্য করে দেশকে স্বাধীন করার গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেই দীর্ঘ কারাবরণ-কালকে তিনি অপচয়ে যেতে দেননি। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও নয়াচীন শিরোনামের প্রকাশিতব্য ভ্রমণকাহিনি ছাড়াও আগরতলা মামলার বিবরণসমৃদ্ধ রচনা। এই লেখালেখির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহরু প্রমুখের মতো ভিন্নতর উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর মানস নির্মিতির ইতিহাসের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরে আসা তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। সেই সূত্রে কলকাতায় তাঁর ছাত্রজীবনে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে কাজ করার যে সুযোগ অঙ্গীকারদীপ্ত ও প্রতিভাবান শেখ মুজিবের ঘটে, তার বহুমুখী গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। এই সুবাদে তৎকালীন উপনিবেশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের শীর্ষ নেতা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যেমন তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়, তেমনি সংস্কৃতি ক্ষেত্রের শীর্ষ পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, অধ্যক্ষ ইব্‌রাহীম খাঁ প্রমুখের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে।

বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রথম পর্বের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেটি তাঁর রাজনৈতিক জীবন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে আমরা মনে করি। এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তী-জীবনে তাঁর মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফজলুল হকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর যে সহজাত প্রবণতা, বাংলার রাজনীতির সেই মূল ধারাটিকেই বঙ্গবন্ধু আরও বিকশিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের এক শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।

অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক তাঁকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারারও সমর্থকে পরিণত করে। কেবল এই দুই ধারা নয়, কলকাতায় আবুল হাশিম এবং ঢাকায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজনীতি করার সুবাদে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রতিও বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এই তিনটি ধারার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক-জীবনকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেন। অন্য পক্ষে সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনের সঙ্গে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সখ্যের সুবাদে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সমন্বয় ঘটে সংস্কৃতিরও। উদাহরণস্বরূপ তাঁর লেখা থেকে একটা অংশ উদ্ধৃত করা যায়:

একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্‌রাহীম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি-আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১৫, ১৬)

বঙ্গবন্ধুর লেখা দুটি বই: অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা
বঙ্গবন্ধুর লেখা দুটি বই: অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা

তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান যে সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বাস্তব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হয়েছিলেন তারও প্রমাণ আছে। তিনি যখন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল গ্রুপের সঙ্গে কাজ করছিলেন, তখন তাঁদের নতুন, গণমুখী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রচার ও প্রকাশের লক্ষ্যে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে তাঁর রচনায় পাওয়া যায়:

হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁরা কাগজ চালাতে শুরু করলেন। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল মিল্লাত।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৪০)

 উপর্যুক্ত দুটি ঘটনা থেকে বোঝা যায় তরুণ বয়সেই শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে একটি সংস্কৃতিসচেতন মন ও সাহিত্যিক সত্তা গড়ে ওঠে।

দুই

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে দুটি বই—অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) ও কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)।। এই বই দুটির লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই পুস্তক-ই বাংলাদেশের বই বিক্রির ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে এবং বেরোনোর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে কারাগারের রোজনামচাও বিক্রি হয়েছে ৭০ হাজার কপি।

বাংলাদেশে আর কোনো রচনা এমন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস তথা বইয়ের বাজারে এটা একটা বড় ঘটনা। বইগুলোতে আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা ও অনুষঙ্গ। লক্ষ করার বিষয় হলো, দুই বইয়েই তাঁর ভাষার গাঁথুনি বেশ আকর্ষণীয় ও প্রাঞ্জল। যেমন:

আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশে যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রী বৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোট সময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৩)।

একই বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ:

১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এক্সিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা এক সাথে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হলো। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। আগেই বলেছি আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর।...হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হলো। এক্সিবিশন উদ্বোধন করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল। হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাঁকে সংবর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?” বললাম, “কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।” তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী,পৃষ্ঠা-১১)

তিন

বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। এর মধ্যে এক যুগ কেটেছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। বিস্তর কারাবাস এবং পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিচিত্র অত্যাচারও এই আপসহীন নেতার মনোবল ভাঙতে পারেনি। জেলজীবনকেও তিনি অত্যন্ত সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রচনাসম্ভার মূলত জেলজীবনেরই সৃষ্টি। এ ছাড়া দ্বিতীয় বই কারাগারের রোজনামচায় জেলের নানা পরিভাষা, রীতি-কেতা, নিয়মকানুন যে অভিনিবেশ ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন, আর কোনো কারাসাহিত্যেই তার বিবরণ মেলা ভার। জেলের দুঃখকষ্টের কথা বলেছেন, তার মধ্যেই আবার বাগান করা, রান্নাবান্না, অন্য রাজবন্দীদের খোঁজখবর নেওয়া এবং বিভিন্ন মেয়াদের অন্য কয়েদিদের স্বভাব, আচরণের যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ তুলে এনেছেন, তা আমাদের বিস্মিত করে।

এখানে আমরা কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি। জেলের নিয়মকানুনের মধ্যে নানা রকম দফা আছে, সেসব দফার নাম আমরা অনেকে জীবনেও শুনিনি। যেমন: রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড় দফা, বন্দুক দফা, পাগল দফা, শয়তানের কল, ডালচাকি দফা, ছোকড়া দফা ইত্যাদি। এর কিছু কিছু দফার নাম শুনে বিষয় সম্পর্কে হয়তো অনুমান করে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বন্দুক দফা, শয়তানের কল, ডালচাকি—এসব দফার বিষয়ে অনুমান করাও কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বন্দুক দফা আলোচনায় আসতে পারে:

আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন বন্দুক দফা কেন বলা হয়? একটা গল্প আছে এর পেছনে। বাঁশ দিয়ে কাঁধে নিয়ে টিনে করে পায়খানার ময়লা দূরে নিয়ে লাল গাড়িতে ফেলতে হয়। তাই টিন ঘাড়ে করে টানতে টানতে দাগ হয়ে যায়। একজন কয়েদি মেথর দফায় কাজ করতে করতে তার কাঁধে দাগ হয়ে যায়। একবার তার ভাইরা তাকে দেখতে এসে কাঁধের দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করে দাগ কিসের, তার উত্তরে মেথর কয়েদিটা বলে, “আমি বন্দুক দফায় জেলখানায় কাজ করি, সিপাহি সাহেবদের বন্দুক আমার বহন করে বেড়াতে হয়। তাই দাগ পড়ে গেছে।” সেই হতে এই দফার নাম বন্দুক দফা।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-৩৩)

জেলে এ ধরনের আজব সব দফা ছাড়াও মজার কিছু পরিভাষা আছে, কেসটাকোল এর মধ্যে অন্যতম। তাঁর বইয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন:

‘শাহাবুদ্দিনকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেসটাকোল কি রে ভাই? ওতো হেসেই অস্থির। আমাকে বলল, দেখেন তো ইংরেজি ডিকশনারিতে আছে নাকি। আমি বললাম, জীবনে তো শুনি নাই, থাকতেও পারে। ইংরেজি তো খুব ভালো জানি না। পুরোনো ডিভিশন কয়েদিরা সকলেই হাসে। আমি তো আহাম্মক বনে গেলাম, ব্যাপার কী! পরে হাসতে হাসতে বলল, কেস ফাইল, কেস টেবিল, কেসটাকোল। কয়েদিরা একে এই নাম বলে ডাকে।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-৩১)।

এ রকম আরও অনেক মজার বিষয় আছে তাঁর লেখায়, বিশেষত কারাগারের রোজনামচায়। কারাবাসের সময় প্রচুর পড়াশোনা করতেন বঙ্গবন্ধু। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে পড়তেন খবরের কাগজ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুপদি লেখা ও বইপত্রও তিনি জেলে অবস্থানকালে পড়েছেন। নিজের লেখায় তিনি বলছেন:

ঘরেএসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলার তেরেসা রেকুইনে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে। এই বইয়ের ভিতর কাটিয়ে দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১০১)

আমাদের দেশের লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখের লেখাও ছিল তাঁর খুব প্রিয়। প্রতিদিন অত্যন্ত যত্ন আর নিষ্ঠার সঙ্গে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরীসহ বিখ্যাত সাংবাদিকদের রাজনৈতিক কলাম পড়তেন। পাশাপাশি পড়তেন ইতিহাসের বই ও বিপ্লবী সাহিত্য। তাঁর লেখায় পাই:

১৭৮৯ সালের ১২ই জুলাই ফরাসি দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারি নগরীর জনসাধারণ সাম্য, মৈত্রী, ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে। ১৪ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙে রাজবন্দীদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বছর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সাথে উদ্‌যাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১৬১)

১৫ জুলাই ১৯৬৬ সালের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু তাঁর জেলজীবনের নিষ্ঠুর একটি চিত্র তুলে ধরেছেন:

কি ব্যাপার, আমি যে ঘরে থাকি তা মাপামাপি করছে কেন? চল্লিশ ফুট লম্বা, চার ফুট চওড়া, কয়টা জানালা, কয়টা দরজা সবকিছু লিখে নিতেছে জমাদার সাহেব। বললাম, ব্যাপার কি? সরকার জানতে চেয়েছে? আরও একটু লিখে নেন না কেন, দক্ষিণ দিকে ছয়টা জানলা, কিন্তু তার এক হাত দূরে চৌদ্দ ফুট উঁচু দেয়াল, বাতাস শত চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না আমার ঘরে। জানলা নিচে, দেয়াল খুব উঁচু। উত্তর হলো, ও সব লেখা চলবে না। লেখুন না আর একটুÑদেয়ালের অন্য দিকে গরুর ঘর, পূর্বদিকে পনেরো ফিট দেয়াল ও নূতন বিশ। ভয়ানক প্রকৃতির লোকÑযারা জেল ভেঙে দুই একবার পালাইয়াছে তাদের রেখেছিল এখানে। আর উত্তর দিকে ৪০ সেল, সেখানে ৪০ পাগলকে রেখেছে। আর পশ্চিম দিকে একটু দূরেই ৬ সেল ও ৭ সেল, যেখানে সরকার একরারী আসামি রেখেছেন। আর এরই মধ্যে “শেখ সাহেব”। তিনি বললেন, “ও বাত হামলোক নেহী লেখ্নে ছাকতা হায়, নকরি নেহি রহে গা।’’’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১৬৩)

বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হলেও তাঁর মতো করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তি আন্দোলনেরও একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। যুক্ত ছিলেন পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান শান্তি পরিষদের সঙ্গে। এই পরিষদের সভাপতি ছিলেন আতাউর রহমান খান। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলছেন:

আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই এই আমাদের স্লোগান।’ এরপর লিখেছেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসের ১৬/১৭ তারিখ খবর এল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিরা শান্তি সম্মেলনে যোগদান করবে। আমাদেরও যেতে হবে পিকিংয়ে, দাওয়াত এসেছে। সমস্ত পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন আমন্ত্রিত। পূর্ব বাংলার ভাগে পড়েছে মাত্র পাঁচজন। আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইবনে হাসান ও আমি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২২১)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রথম বই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শান্তি সম্মেলনে চীন সফরের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পরবর্তীকালে এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের পাণ্ডুলিপি রচনা করে গেছেন তিনি। নয়াচীন নামে বইটি অচিরেই প্রকাশিত হবে বাংলা একাডেমি থেকে। সেই বইয়ের কিছু অংশ:

‘শান্তি সম্মেলন শুরু হলো। প্রথমেই অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ম্যাডাম সান ইয়াৎ-সেন তাঁর বক্তৃতা পড়ে শোনালেন। নয়াচীনের পিতা সান ইয়াৎ-সেনের নাম আপনারা জানেন, যিনি দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেন। বিদেশিদের দেশ থেকে তাড়াইয়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু গড়ে যেতে পারেন নাই। তার পূর্বে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ম্যাডাম সান-ইয়েৎ সেন তাঁরই স্ত্রী।

‘চিয়াং কাইশেকের নাম আপনারা সকলে জানেন—যিনি সান ইয়াৎ-সেনের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। এবং দুই নেতা দুই বোনকে বিয়ে করেছিলেন। ম্যাডাম সান ইয়াৎ-সেন, চিয়াং কাইশেকের স্ত্রীর বড় বোন। দুঃখের বিষয় দেশের সাথে স্বামী-স্ত্রী বেইমানি করেছিল বলে আর দেশে যেতে পারে না। জনগণ তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই ফরমোজা দ্বীপে আমেরিকান সাহায্য নিয়ে কোনো মতে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে হুংকার ছাড়ে, কিন্তু কেহ গ্রাহ্য করে না। কারণ সকলেই জানে দেশের থেকে বিতাড়িত আমেরিকার দালাল।’

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে তাঁদের দেশের শান্তি আন্দোলন, সামাজিক অগ্রগতি এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে চমৎকার বক্তৃতা দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...আমিও বক্তৃতা করলাম বাংলা ভাষায়। ভারতবর্ষ থেকে বক্তৃতা করলেন মনোজ বসু বাংলা ভাষায়। বাংলা আমার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে...এই সম্মেলন এগারো দিন চলে। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিনিধি আমার সঙ্গে আলাপ করতে করতে বললেন, “তোমার দেশের রাষ্ট্রদূতেরা মনে করে দুনিয়ার মানুষ আহাম্মক!” আমি বললাম, “কেন এ কথা বলছেন? ” তিনি উত্তর করলেন যে, “রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীরা যেভাবে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে থাকতে পারে না। অন্যান্য যে সকল দেশের জনগণের অবস্থা খুব ভালো, খাইও অনেক বেশি আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতেরা যে অবস্থায় থাকে, তার চেয়েও অনেক ভালো অবস্থায় থাকে এবং যা তা-ভাবে অর্থ ব্যয় করে। আমাদের বোঝাতে চায় যে, তোমরা কত ভালো আছ। আমরা রাজনীতি করি, দেশ-বিদেশের খবর রাখি। তোমাদের দেশের মাথা প্রতি আয় কত? দেশের লোক না খেয়ে মরে, কাপড় পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না। এ সব খবর আজ দুনিয়ার শিক্ষিত সমাজ ভালো করেই জানে। দেশের মানুষ না খেয়ে মরে আর সেই দেশের কর্মচারী অথবা রাষ্ট্রনায়কেরা যেভাবে বাজে খরচ করে তাহা ভাবলে আমাদেরও লজ্জা করে।’

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। কিন্তু লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বড় কীতিত্ব সম্ভবত এখানে যে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন সহজ ভাষায়, অতিরঞ্জনের অশ্রয় না নিয়ে। বোধ করি এটা বড় লেখকেরই গুণ।