'আরেকবার মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে'র ত্রুটি

‘রাষ্ট্রভাষা না মাতৃভাষা’ ২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যার এই কথোপকথনের সূত্রে ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতায় ২ মার্চ মোহাম্মদ আজম মাতৃভাষার পরিচয় ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অঞ্চলবিশেষের উপভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৬ মার্চের প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য তা কৌশলে অস্বীকার করেছেন। মাঝখানে ৯ মার্চ প্রকাশিত আমার প্রতিক্রিয়ায় মাতৃভাষাবিষয়ক অস্পষ্টতা দূর করার প্রয়াস আমি নিইনি; বরং অপূর্ণাঙ্গতা ধরিয়ে দিতে চেয়েছি। অস্পষ্টতা দূর করার কাজ প্রথম ব্যাখ্যাদানকারীর এবং এ কাজটি করতে গিয়ে ভাষাবিজ্ঞানশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা ত্রুটিপূর্ণ। যেমন লিখেছেন, ‘কতটা ভাষিক পার্থক্যের জন্য আলাদা উপভাষা বা ভাষা বলা যাবে, তা নির্ণয়ের সূত্র আছে।’ অথচ আদতে স্বীকৃত, স্পষ্ট কোনো পন্থা নেই। ভাষাবিজ্ঞান দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব, আসামি ভাষা বাংলার একটি উপভাষা; কিংবা চট্টগ্রামি বাংলা আলাদা একটি ভাষা। যে কারণে চেক ও স্লোভাক ভাষা (লিখিত রূপের দিক দিয়ে) উপভাষাতুল্য, অথচ কথ্যরূপে তারা পরস্পর ভিন্ন ভাষা, আর দুই রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিশ্চিতরূপে উপভাষা। এ রকম অগুনতি উদাহরণ দিয়ে দেখানো যাবে, ভাষা আর উপভাষার পার্থক্য নিরূপণে ভাষাবিজ্ঞান কী বিস্ময়করভাবে অসহায়।

আর পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটির (১৯৪৯) সুপারিশ বিষয়ে আমার বক্তব্যের জবাবে আজম লিখেছেন, ‘যে শব্দগুলো মুখে আছে, সেগুলোকে লেখায় ব্যবহারের স্বীকৃতি চেয়েছিল মাত্র।’ এই যুক্তি ধোপে টিকবে না, যদি কমিটির প্রতিবেদনে কী লেখা ছিল পড়েন। তাঁরা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘ভাষায় সংস্কৃত প্রভাব এড়িয়ে যেতে হবে’, ‘মুসলিম লেখকদের প্রকাশভঙ্গি ও ভাবসমূহ ইসলামি আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত’ এবং এমন শব্দ ব্যবহার করা উচিত ‘পুঁথি ও বহুল প্রচলিত সাহিত্যে যেগুলো ব্যবহৃত হয়।’ মধ্যযুগের দোভাষী পুঁথিতে ব্যবহৃত শব্দ তাহলে মুখের ভাষায় প্রচলিত ছিল; একে আবার লিখিত রূপে নেওয়ার জন্য কার কাছে এবং কেন স্বীকৃতি চাইতে হচ্ছে? মুনীর চৌধুরী (১৯৭০) এর তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, ওরা ‘ভাষাতত্ত্বে অনভিজ্ঞ, ব্যাকরণের মর্মোদ্ধারে অনভ্যস্ত, অভিধানে অনাস্থাবাদী’। আর হুমায়ুন আজাদ (১৯৮৪) বলেছেন, এটা ছিল ‘বাঙালি জাতিসত্তাকে পর্যুদস্ত করার চক্রান্ত।’

বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষার শিশুরা বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রমিত বাংলা শেখে—এটিকে শেষ পর্যন্ত ‘প্রথম ভাষা’ই বলতে হবে; কোনো অর্থেই ‘দ্বিতীয় ভাষা’ নয়। নিজের ধারণাগত যুক্তিকে বড়জোর ‘এই বিবৃতিও চালু’ বলা যায়, ‘ভাষাবিজ্ঞানসম্মত’ বলা যায় না। তাহলে বলতে হবে, বিশ্বের প্রায় সব শিশুই মান ভাষায় পাঠ গ্রহণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় ভাষা শিখছে! সব শিশু যেন তার মাতৃভাষায় প্রথম শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়—এ দাবিটিও তখন হাস্যকর হয়ে যাবে।

তারিক মনজুর
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।