গোর্কিকে ফিরে দেখা

ম্যাক্সিম গোর্কি (২৮ মার্চ ১৮৬৮—১৮ জুন ১৯৩৬)
ম্যাক্সিম গোর্কি (২৮ মার্চ ১৮৬৮—১৮ জুন ১৯৩৬)

মাঝেমধ্যে অনেক আফসোস আমাদের গ্রাস করে; অনেক ‘যদি’র আবর্তে আমরা ঘুরপাক খাই। যেমন ম্যাক্সিম গোর্কি যদি দেড় শ বছর বেঁচে থাকতেন কিংবা তাঁর জীবদ্দশায় যদি দেড় শ বছরের কেকটি তিনি কাটতে পারতেন, কী চমৎকার ব্যাপারটিই না ঘটত! এত দিনে নিশ্চয়ই আরও মহান কিছু লিখে ফেলতেন। আরও কত কী! এতসব ‘যদি’ আপাতত বাদ দিই। এই মাসের ২৮ তারিখ এই রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। আগে আপাতত তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছ জানাই।

গোর্কি সম্পর্কে বয়ঃকনিষ্ঠ, বয়সে ৩২ বছরের ছোট ও স্নেহধন্য লেখিকা নিনা বের্বিয়েরভা সুতীক্ষ্ণ এক মন্তব্য করেছিলেন, ‘গোর্কির সঙ্গে তর্ক করা এক অসম্ভব ব্যাপার। আপনি তো কোনো রকমেই তাঁকে আপনার মতো টানতে পারবেন না। কারণ, না-পছন্দের জিনিস না শোনা এবং যে প্রশ্নের জবাব তাঁর জানা নেই, সেই প্রশ্ন একেবারেই কানে না তোলার এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর আছে।’ রুশ বলশেভিক বিপ্লব যখন ঘটছে, সেই ১৯১৭ সালে গোর্কির বয়স ছিল উনপঞ্চাশ। তখনো লেখা শুরু করেননি, সপ্তদশী এই মেয়েটির পর্যবেক্ষণে গোর্কির জেদি, একরোখা, লক্ষ্যে একাগ্রনিষ্ঠ, মনকে বিক্ষিপ্ত হতে না দেওয়ার মতো আত্মপ্রত্যয়ী চরিত্রকাঠামোর একটা ধারণা ধরা দেয়। তাঁর শৈশব ও বাল্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিশ্বখ্যাত লেখকে পরিণত হওয়া পর্যন্ত আলেক্সিয়েই নামে যে ব্যক্তিমানুষটির পথচলা, তাতে অমন সিদ্ধান্তই নিতে হয়। স্বভাবের মৌলিক কাঠামো ও রকম না হলে জলকর্দমের নিম্নভূমি থেকে পর্বতশিখরে আরোহণ কখনো সম্ভব হয়ে উঠত না। দারিদ্র্যের কারণে বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারেননি। কালে কালে, অন্তত শিল্পী ও সাহিত্যিকদের বিবেচনায় গণ্য করলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্যর্থকাম, অথচ যুগন্ধর প্রতিভার এমন মানুষ বিশ্বজুড়ে কম ছড়িয়ে নেই। অধিকন্তু বাঙালির ইতিহাসে ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে এই বাস্তবতা প্রখরভাবে উজ্জ্বল। যাঁদের সংসারে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থাকেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ‘অশিক্ষিত’ প্রতিভার খোঁজে গোর্কিকে পেয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হবেন না। কিন্তু সৃজনশীলতার প্রতিভা বিচারে নয়, সামাজিক সংসারী-সাধারণ আর দশজন মানুষের ব্যক্তিস্বভাবের নিরিখে এই রুশ মানুষটিকে বাঙালি দুজনের পাশে বসানো যাবে না।

তিনি অন্য রকমের মানুষ। ভয়ানক রকম আলাদা। তিনি তিক্ত, কটুস্বাদ; তিনি ‘গোর্কি’। দুই শব্দবিশিষ্ট যে ম্যাক্সিম গোর্কিকে আমরা চিনি, তাঁর পরিবার-পরিজন কখনো ওই নামে তাঁকে ডাকেনি। এটি তাঁর ছদ্মনাম। পরিবার থেকে নাম রাখা হয়েছিল আলেক্সিয়েই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ। তাঁর পিতা ম্যাক্সিম সাভ্ভাতেভিচ পেশকভ নাকি ছিলেন ভারি ঠোঁটকাটা স্বভাবের, অপ্রিয় রূঢ় সত্য কথনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। চেনা মহলে তাই তাঁর ডাকনাম জুটেছিল গোর্কি। হতে পারে বাবার এই ডাকনাম লেখক ছেলে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার, এই ছেলের মনে কোনো পিতৃস্মৃতির দাগ ছিল না। আমার ছেলেবেলা শুরুই হয়েছে সদ্যমৃত পিতাকে সামনে রেখে। আমার ধারণা, আদৌ ভাবাবেগতাড়িত নয়; বরং গভীর চিন্তা ও বিবেচনাপ্রসূত এক ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদী সিদ্ধান্তের ফসল ‘গোর্কি’। এই নামরহস্যের ব্যাখ্যা আমরা নিজেদের মতো করে একভাবে আবিষ্কার করে ফেলি, যখন তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস শৈশব, জনারণ্যে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পড়তে থাকি, যেগুলোর প্রচলিত বঙ্গানুবাদ যথাক্রমে আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে আর পৃথিবীর পাঠশালায়। আলেক্সিয়েই নামের এই ছেলেটি অসম্ভব দুঃসহ এক ‘তিক্ত’ জীবনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ক্রমশ যে ম্যাক্সিম গোর্কি হয়ে উঠতে লাগল, সেই ইতিহাস ধরে রেখেছে এই ত্রিপিটক উপন্যাস। বাঙালি কোনো লেখকের সঙ্গে সে জীবনের সাদৃশ্য খুঁজতে যাওয়া পণ্ডশ্রম হবে। কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার লেওনিদ লেওনভকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি দেখতে ভালোবাসি মানুষের বেড়ে ওঠা।’ সেই মানুষটি তো তিনি নিজে। এই উপন্যাসসমূহে তাঁর নিজেরই বেড়ে ওঠা সময়কে অনেকখানি দূরত্বে বসে নিজেকে নিজেরই অবলোকন করা এবং একই সঙ্গে বিশ্বজনকে দেখানোও।

ম্যাক্সিম গোর্কি
ম্যাক্সিম গোর্কি

বাঙালি পাঠকসমাজে গোর্কির পরিচিতি সম্ভবত মা উপন্যাসের সূত্র ধরে। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় লেবার স্বরাজ পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে যখন লাঙল বেরোয়, তখন তার প্রথম সংখ্যা (২৫ ডিসেম্বর ১৯২৫) থেকেই নজরুলবান্ধব নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষান্তরে মা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে। শুধু মা কেন, গোর্কির অধিকাংশ প্রধান রচনা তত দিনে তাঁর স্বদেশে বেরিয়ে গেছে। আলোচ্য তিন উপন্যাসসহ। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিগত শতকের চল্লিশের দশক—যখন বঙ্গদেশে বামপন্থা রাজনীতি ও আন্দোলনের স্বর্ণযুগ, সে সময় রুশ ও স্ক্যান্ডিনেভীয় সাহিত্য প্রচুর অনূদিত হয়েছিল এবং সেসবের ভেতরে গোর্কির রচনা সন্দেহাতীতভাবে ছিল।

আত্মজৈবনিক এ রচনাত্রয়ের রুশি নাম আদিতে ছিল শৈশব, কৈশোরযৌবন

নিজের সাহিত্যজীবন নিয়ে গোর্কির হ্রস্ব-দীর্ঘ গুটিকয়েক রচনা আছে। সেসব প্রবন্ধে এই আত্মজৈবনিক ত্রিপিটকের বিষয়ে কোনো আলোচনা বা আলোকপাত নেই। ২য় ও ৩য় খণ্ডের শিরোনাম প্রথমে যা ভেবে রেখেছিলেন, তা থেকে কেন সরে গেলেন—তা আমরা জানতে পারি না। তবে আমাদের জ্ঞাত একটি তথ্য সম্ভব এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।

আমরা সবাই জানি, লিয়েফ তলস্তয় অন্তঃকৈশোর থেকে আমৃত্যু দিনপঞ্জি লিখে গেছেন। কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর আত্মজৈবনিক কাহিনিও রয়েছে: শৈশব, কৈশোর, যৌবন। লক্ষণীয় যে গোর্কি হুবহু একই নাম ভেবেছিলেন, যদিও উভয়ের ভেতরে রচনাকালের ব্যবধান ছিল প্রায় ৬০ বছর। অক্লান্ত পরিশ্রমে ও ধৈর্যে নিজের লেখা বহুবার সংশোধন ও পরিমার্জন তলস্তয়ের স্বভাবের অন্তর্গত ছিল, গোর্কির তা ছিল না এবং তলস্তয়ের কোনো প্রভাবই তাঁর ওপর নেই—এ কথা বোঝানোই শুধু নয়, কেউ যেন এমন ভাবনাকেও প্রশ্রয় না দেন, সে কারণেই হয়তো দ্বিতীয় চিন্তায় শেষ বই দুটির শিরোনাম পাল্টে রাখতে হয়েছিল তাঁকে।

এরপরও অসম্পৃক্ত আপতিক দু-একটি বৈপরীত্য ও সমান্তরালের পানে আমাদের দৃষ্টি যায়। এ কি অবাক হওয়ার মতো নয় যে তলস্তয়ের লেখক হওয়া ব্যাপারটি যেন হেলাফেলায় ঘটানো, গোর্কির তুলনায় বুড়ো বয়সে এবং গোর্কির ইচ্ছাশক্তি ও মরণ-বাঁচন-আন্তরিকতার সঙ্গে তা ধোপে টেকে না? আবার দেশহিতব্রতে, মানবকল্যাণে, মনুষ্যত্বের ধারণায়, জনগণকে চেনার আকাঙ্ক্ষায় দুজনের ভেতর কতই না মিল! জীবনের একটি অংশ উভয়েরই কাজান শহরে কেটেছিল, ঘটনার এ-ও এক অদ্ভুত সাদৃশ্য। কিন্তু আমাদের বিস্ময় মানতে হয় অন্য রকমের এক ঘটনায়। গোর্কি হেঁটে রাশিয়া ঘুরে দেখতে চেয়েছিলেন, অনেকখানি ঘুরেও ছিলেন—সে কিসের তাগিদে? তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হন, তখন দ্বিতীয় আলেক্সান্দরের রাজত্বকাল (১৮৫৫—৮১)। কাজান শহর থেকে নিজনি নোভগরদে ফিরে আসা ছেলেটি, যদিও লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, তখনই লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। মনে হয় না কি বাঙালির মতোই স্বপ্নভক্ত? সে সময়ের এক ছবি ধরা আছে আমাদের কাছে। সদ্য ২০ পেরোনো এক তরুণ, চাষাড়ে চেহারা, দেখেই বলে দেওয়া যায় অনেক রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে পোড়খাওয়া, দেখা করতে এসেছে এক নামীদামি লোকের সঙ্গে; ভদ্রলোক এখানে থাকেন না, সম্প্রতি এসেছেন এই ভোলগাতীরের নিজনি নোভগরদ শহরে। ভ্লাদিমির গালাক্তিওনভিচ করলিয়েনক তখন ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক কর্মী-সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে, ছয় বছর আগেই বেরিয়ে গেছে তাঁর অন্ধ বাজনদার উপন্যাস। ছেলেটা অচেনা, তবু লাজুক নয়। সে একটি রচনা এগিয়ে দেয় ১৫ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিকের হাতে। একটি কবিতা, ‘বৃদ্ধ ওকের গান’। ‘ওক’ মানে ওকগাছ। নিশ্চয়ই ওকগাছকে নিয়েই ওই পদ্য, নইলে অমন নাম হবে কেন? ‘আলেক্সিয়েই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ’ ওই তরুণ, তার রচয়িতা। রচনাটি সে তলস্তয়কেও দেখাতে চেয়েছিল। কী দুঃসাহস! সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এত দিনে আরেকজনকে পাওয়া গেল, ইনিও বিখ্যাত কম নন। করলিয়েনক কী বলেছিলেন কে জানে, কিন্তু বাসায় ফিরে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছিল সেটি।

দুই.

আমার ছেলেবেলা
আমার ছেলেবেলা

সাহিত্যসৃজনে গোর্কির প্রধান উৎস সম্পর্কে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন। জবাবে গোর্কি বলেন, ‘আমার জীবনে সঞ্চিত মালমসলাকেই মুখ্যত কাজে লাগাই আমি।’ ইচ্ছাকৃত সরলীকরণটি টের পাওয়াই যায়। নিজের যাপিত জীবন ও অভিজ্ঞতা, অন্যের এবং সামাজিক অভিজ্ঞতা, পরিমণ্ডল থেকে পরোক্ষ জ্ঞানলাভ করেন না—এমন কোনো শিল্পী কি পৃথিবীতে আদৌ আছেন? এসবই তো সঞ্চয়। গোর্কি নিশ্চয়ই শুধু এটুকু বলতে চাননি। তিনি হয়তো এটুকুই বলতে চেয়েছেন যে তাঁর লেখায় বানানো কিংবা কল্পনাপ্রসূত কিছু নেই; যা আছে সব নিজের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকেই নেওয়া। এই বাস্তবতার সাক্ষী হিসেবে জোরালোভাবে তাঁর যে সাহিত্যকীর্তিকে দাঁড় করানো যায়, সেটিই ওই ত্রিপিটক। সেসবের ভেতরে যত মানুষ আমরা দেখি, তাঁরা সব উপস্থিত হয়েছেন স্বনামে। ঐতিহাসিক চরিত্র, নেতা, সংগঠক বা বিপ্লবী—সবাই-ই গোর্কির প্রত্যক্ষ বাস্তব। আমরা জানি, তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন। পৃথিবীর পথেপৃথিবীর পাঠশালায় থেকে আমরা তাঁর পঠনপাঠনের গভীরতা ও কৌতূহলের ব্যাপ্তি টের পাই এবং বুঝতে পারি, এ তথ্যটুকু কতটা ঊনকথন! জারের আমলেও সাধারণ সামাজিক আবহাওয়াটুকু যে মননচর্চার জন্য কতখানি অনুকূলে ছিল, কতদূর পর্যন্ত—বিশ্বসাহিত্যের সম্ভার রুশ অনুবাদে সেসব ছবি আমরা স্পষ্টভাবে সেখানে দেখতে পাই। আমাদের পক্ষে সহজেই বিশ্বাস জন্মায় যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এই মানুষটি শুধু ‘শিক্ষিত’ই নন, বিশ্বকৌষিক জ্ঞানের ভান্ডারি ছিলেন। আমাদের সম্মুখে ভাস্মর হয়ে ওঠে একরোখা, আত্মপ্রত্যয়ী, অদম্য একজন মানুষের বেড়ে ওঠার প্রতিমা।

অনুমান করি, ত্রিখণ্ডাশ্রিত এ কাহিনির শিল্পচারিত্র্য নিয়ে বাঙালি পাঠক অনুচ্চারিত এক প্রশ্নে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। জিজ্ঞাসাটি একাডেমিক, তত্ত্বীয়। এই গ্রন্থত্রয়কে কোন সাহিত্যধারার বা জনরার অধীনে ফেলব? আত্মজীবনী, নাকি উপন্যাস? নাকি আত্মজৈবনিক উপন্যাস, যেমনটি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তকে বলা হয়? সরলভাবে এর উত্তর দেওয়া কঠিন। বিশ্লেষণের আগে একটি সত্য স্মরণে আনলে প্রশ্নের জবাব কিছুটা সহজ হতে পারে। সেটি হলো কোন সংজ্ঞায় একটি রচনাকে ফেলা যাবে—সেটি মাথায় নিয়ে কেউ লিখতে বসেন না। লেখকের কাজ শিল্পমণ্ডিত ও রসোত্তীর্ণ একটি লেখা দাঁড় করানো। সেটিকে জনরায় ফেলার দায়িত্ব সাহিত্যবেত্তা ও তাত্ত্বিকদের। মোটাদাগের সীমানা টানার শিল্পবুদ্ধি সবার রয়েছে: নিজের বিষয়ে সত্যকথন ও জ্ঞাত তথ্যের সত্যবর্ণন নিয়ে গড়ে ওঠে আত্মজীবনী, আর কল্পনার আশ্রয় ছাড়া উপন্যাস রচনা অসম্ভব। আত্মজীবনীকারের সৃষ্টিশীল লেখক হওয়ার কোনো দায় নেই। তবে সে উপন্যাসকেই আমরা আত্মজৈবনিক বলে থাকি, যেখানে লেখকের আত্মদাবি না থাকলেও কিংবা নিজেকে তিনি লুকাতে চাইলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ও জীবনযাত্রার প্রক্ষেপণ যদি আমরা সেখানে আবিষ্কার করতে পারি।

পৃথিবীর পথে
পৃথিবীর পথে

কিন্তু তলস্তয় কিংবা গোর্কির ত্রিপিটক দুটির ধাঁচ ভিন্ন। অবশ্য কট্টর বিচারে বলতে গেলে, এ দুটির মধ্যে গোর্কির চেয়ে তলস্তয় বেশি পড়বেন আত্মজীবনীর চৌহদ্দিতে। আত্মজীবনী ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসের মধ্যে যতটুকু না পার্থক্য আছে, সেটুকু ঘোলাটে হয়ে ওঠে, যদি সে রচনা গোর্কির এই তিনটি বইয়ের মতো হয়। আত্মজীবনীতে উত্তম পুরুষে না বলে গত্যন্তর থাকে না, কিন্তু এমন উপন্যাসও তো অগণিত রয়েছে, যেখানে কাহিনির বয়ান উত্তম পুরুষে, নায়ক-নায়িকার জবান ও দৃষ্টিকোণ থেকে। এই সাধারণ লক্ষণে এদের চরিত্র শনাক্ত করা যাবে না। আমার বিচারশক্তি যেটা বলে, প্রধান পার্থক্য ঘটনা উপস্থাপনে ও বর্ণনার ভঙ্গিতে দেখা যায়। আত্মজীবনীর এক সাধারণ লক্ষণ সম্ভবত সমতলতা (flatness), মন্থর প্রবহমানতা ও কাহিনির একরৈখিকতা।

লক্ষণীয় যে ত্রিপিটকের তিনটি অংশই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর সমকাল এগুলোকে স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনীধারার বই হিসেবে গণ্য করেনি। সমবয়সী ছোটগল্পকার মিখাইল প্রিশভিনকে আমার ছেলেবেলা পাঠানোর পর উত্তর পেয়েছিলেন, ‘অসম্ভব ভালো বই...। আমি বলি কি, সামনে যখন এর কোনো ভালো সংস্করণ বেরোবে, তখন আপনি প্রতিটি অধ্যায়ের একটি করে শিরোনাম দিয়ে দেবেন।’ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন কর্নেই চুকোভস্কি, ‘গোর্কি ইতিপূর্বে কখনো এমন খোলামেলা, তাজা ও মনোমুগ্ধকর কাহিনি লেখেননি। এযাবৎ তিনি যা কিছু করেছেন, তার ভেতরে এটিই শ্রেষ্ঠ।’ আর আর্মেনীয় সাহিত্যিক শির্ভানজাদেহ লিখেছিলেন, ‘আমার বিবেচনায় পুরো বইটি রুশ জনগণের জীবন, তাদের নির্যাতনের প্রতীক। সত্যি কথা বলতে প্রতীক সব জাতিরই।’

পৃথিবীর পাঠশালায়
পৃথিবীর পাঠশালায়

গোর্কি যখন দিয়েৎস্তভ (শৈশব), ফ্ লিইদিয়াখ (জনারণ্যে), মই-ই উনিভের্সিতিয়েতি (আমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো) নাম দিয়ে তাঁর আত্মজৈবনিক ত্রিপিটকগুলো প্রকাশ করেন, তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। তত দিনে তিনি তলস্তয়, চেখভ, লেনিন, এইচ জি ওয়েলস, প্লেখানভ প্রমুখের ভীষণ অন্তরঙ্গ। এই তিনটি বই ওই অর্থে উপন্যাস নয়, যে বিচারে মা কিংবা ক্লিম সামগিন বা আর্তামোনভদের ক্রিয়াকলাপ উপন্যাস। তবু ১০-১২ বছর ধরে লেখা এই ত্রিপিটকের প্রতিটি খণ্ড বিশ্বব্যাপী গোর্কির অভাবনীয় ও বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

কী আছে এই তিন বইয়ে, যা উপন্যাস, আবার উপন্যাস নয়ও? ঘটনাগুলো একদম সত্য। কিন্তু যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো এসব সত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই। আবার এমনও নয় যে অন্য কোনো দেশে, অন্য কারও সঙ্গে এই ঘটনা ঘটতে পারে না। আমরা বুঝতে পারি যে জীবন এমনও হয়। এমন কদর্য, নির্মম ও নিঃসঙ্গ।

প্রকৃতপক্ষে এই ত্রিপিটক গোর্কির আত্মার ছাল ছাড়ানো দলিল। গোর্কি তাঁর পথচলার কাহিনিই লিখে গেছেন। আমার ছেলেবেলাতেই গোর্কি লিখেছিলেন, ‘...আশ্বাস জাগে যে একদিন না একদিন আমাদের দেশের মানুষ এক পূর্ণ প্রস্ফুটিত জীবনের সৌন্দর্যে ও উজ্জ্বল মানবিকতায় অধিষ্ঠিত হবে।’

মানুষ ও শিল্পী ম্যাক্সিম গোর্কি আমৃত্যু সেই সৌন্দর্য ও মানবিকতার সাধনা করে গেছেন। তাঁকে সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর অফুরান শুভেচ্ছা।

>

গোর্কি-কাহিনি

 ‘তেতো’ ম্যাক্সিম

ম্যাক্সিম গোর্কি নামটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর লেখক-নাম। নিজেরই উদ্ভাবিত, স্বনির্মিত। তাঁর পরিবার-প্রদত্ত নাম ছিল আলেক্সিয়েই। পুরো নাম আলেক্সিয়েই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ। বাবার নাম ম্যাক্সিম ছিল বলে জুড়েছিল ‘ম্যাক্সিমভিচ’ বা ‘ম্যাক্সিমের পুত্র’ শব্দটি আর পিতৃবংশের পদবি হিসেবে পেশকভ। রুশ ভাষায় ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ তিক্ত, তেতো বা কটু স্বাদ। গোর্কির পিতা ছিলেন ঠোঁটকাটা ধরনের। তাই তাঁকে অনেকে ডাকতেন ‘গোর্কি’ বলে। ছেলে কি বাবার এই নামটিই নিলেন লেখক-নাম হিসেবে? নাকি নিজের জীবনের ও জগতের তিক্ততাকে লেখায় তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলবেন—এমন আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই নাম ধারণ করেছিলেন তিনি? ১৮৯২-এর ১২ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার ৎবিলিসি শহর থেকে প্রকাশিত কাফ্কাজ্ পত্রিকায় তাঁর ‘মাকার চুদ্রা’ গল্পটি বেরোয় এই ম্যাক্সিম গোর্কি নামেই। সেই থেকে দুনিয়াজুড়ে ম্যাক্সিম গোর্কি নামের চিরস্থায়ী হওয়ার শুরু।

ভিন্নমতের পক্ষে

রুশ বিপ্লবের প্রতি আন্তরিক সমর্থন থাকলেও বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের সব কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় মেনে নেননি গোর্কি। পত্রিকার কলামে বলশেভিকদের নানান বিষয়ে দ্বিমত জানিয়ে লিখেছেন কলাম। তাঁর সেই সব আক্রমণাত্মক নিবন্ধ পড়ে জোসেফ স্তালিনের মন্তব্য ছিল, যদি গোর্কি বিপ্লবের পথ পরিহার করেন, তবে তিনি নিক্ষিপ্ত হবেন বিস্মৃতির গর্ভে। কিন্তু ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বরাবরই অটুট ছিল তাঁর। লেনিনের কাছে একাধিক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে গোর্কি একের পর এক চিঠিও লিখেছিলেন তখন। কখনো কোনো তরুণী কবি, রসায়ন বিজ্ঞানী বা লেখক বন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর জানতে পেরে তাঁদের দ্রুত মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছেন। কখনো বা বই প্রকাশনায় আমলাতান্ত্রিক বাধানিষেধের প্রাবল্য দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তা দূর করতে আহ্বান জানিয়েছেন লেনিনকে। লেনিন যে তাঁর পত্রাঘাতকে উপেক্ষা করতেন, তা নয়। যতখানি সম্ভব ব্যবস্থা নিতেন। তবে লেনিনের মৃত্যুর পর, স্তালিন যখন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বেসর্বা, সে সময় গোর্কি আর এমন ভূমিকায় সরব ও সক্রিয় থাকতে পারেননি।

রহস্যময় মৃত্যু

গোর্কি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৯২১ সালেই। লেনিন তাঁকে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠিয়েছিলেন। সাত বছর নানা জায়গায় কাটিয়ে স্বদেশে ফেরেন ১৯২৮ সালে। কিন্তু নিরাময় পূর্ণরূপে হয়নি। যক্ষ্মার চিকিৎসা চলার সময়ই ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। তৎকালীন সরকার গোর্কির চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ আনে। কয়েকজনকে শাস্তিও দেওয়া হয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতাকেও সন্দেহের তালিকায় এনে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সংশয়ীদের ধারণা, এটি আদতে স্তালিনেরই কীর্তি; পার্টির কুকর্মের একজন দৃঢ়চেতা সমালোচককে সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অপছন্দের ব্যক্তিদেরও দল থেকে উৎখাত করার জন্য তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।

বাংলায় গোর্কির রচনা

অনুবাদক-অধ্যাপক হায়াৎ মামুদের দেওয়া তথ্যানুসারে, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (২৫ ডিসেম্বর ১৯২৫) প্রথমবারের মতো বাংলায় অনূদিত কোনো গোর্কি-রচনা প্রকাশ পেয়েছিল। সেটি ছিল মা উপন্যাসের নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কৃত অনুবাদ। পরের সংখ্যাগুলোতেও এই অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। তবে পুরোটা অনুবাদ তিনি করেননি, উপন্যাসের প্রথম পর্বটুকুই শুধু পরে গ্রন্থাকারে তাঁর অনুবাদে প্রকাশ পায়। এরপর বিমল সেন মা-এর আরেকটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেন। কাকতালীয়ভাবে ১৯৫৪ সালেই অশোক গুহ ও পুষ্পময়ী বসুর করা উপন্যাসটির দুটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির ক্যাটালগে অশোক গুহর অনুবাদকে বাংলায় ‘প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ’ বলা হলেও পরবর্তীকালে বাঙালি পাঠকের কাছে বেশি জনপ্রিয় হয় পুষ্পময়ী বসুর অনুবাদটিই; মূলত মস্কো প্রগতি প্রকাশনের ছাপা নতুন সংস্করণের বদৌলতে। এ ছাড়া চল্লিশের দশকেই কলকাতা থেকে অনূদিত হয়ে বেরিয়েছিল গোর্কির তিন খণ্ডে বিস্তৃত আত্মজৈবনিক উপন্যাসমালা: আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথেপৃথিবীর পাঠশালায়