রেখার পদ্য

‘শিরোনামহীন’, শিল্পী: সোমা সুরভী জান্নাত
‘শিরোনামহীন’, শিল্পী: সোমা সুরভী জান্নাত

মনের একান্ত ভাবনায় কত কথা বলি আমরা। দেখি কত রূপ—কখনো তা মিলিয়ে যায় মুহূর্তে, কখনো থাকে স্মৃতিতে। সেই সব কল্পরূপ কবির পদ্যে, সাহিত্যিকের গদ্যে, শিল্পীর শিল্পকর্মে স্থায়ী আদল পায়। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে ‘ধূসর রেখাবৃত্তি’ শিরোনামের সোমা সুরভী জান্নাতের একক চিত্র প্রদর্শনী প্রসঙ্গে কথাগুলো বলা।

সুরভী বস্তুরূপের বাস্তব পরাবাস্তব আদল তাঁর কল্পিত ভাবনার রেখাজালে বাঁধেন পদ্য-ছন্দের গাঁথুনির মতো। বাস্তবানুগ ড্রয়িংশৈলীতে বোঝা যায় কাছাকাছি স্পেসে তিনি নানা ধরনের বস্তু, প্রাণী ও নিসর্গ উপাদানের খুঁটিনাটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, পীড়ন, উত্তেজনা—এগুলো দেখেন মনোযোগসহ।

মজার ব্যাপার হলো, বস্তুর বাস্তবানুগ আদলকে কল্পিত এক জমিনে জুড়ে দেন তিনি—যা শিল্পীর আন্তমনের ভাবনাপ্রসূত। সেখানে রূপ পায় পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা ও রসায়নের নানা উপকরণ। অনেকটা শ্রেণিপাঠের জন্য সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের ড্রয়িং মনে হতে পারে। ফলে খুঁজে পাওয়া যায় জগতের জৈব, অজৈব ও প্রাণীর মধ্যে এক আন্তসম্পর্কের গল্প।

শিল্পী বিচার-বুদ্ধির বাইরের বাস্তবতার সমীকরণে স্থানিক বস্তু ও প্রতিবেশের আন্তচাঞ্চল্যের প্রবাহকে ফ্রেমবন্দী করেছেন। তাই ড্রয়িংয়ে মানুষ, বস্তু, প্রকৃতির চেনাজানা উপাদানগুলো কল্পনার ছাঁচে ঢালা, কখনো প্রতীক সংকেতের জ্যামিতিক বিন্যাসে সজ্জিত। প্রশ্ন হলো, অতি জ্যামিতিক ও সাংকেতিক বিন্যাসে কোনো কোনো কাজে শিল্পরস ব্যাহত হয়েছে কি না?

সে বিচারের ভার দর্শকের হাতে। তবে নিশ্চিত করে বল যায়, ড্রয়িংগুলোতে একঘেয়েমির প্রবণতা আছে।

ড্রয়িংগুলোতে স্পেস বা শূন্য জমিন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রশংসনীয়। রেখার জড়তা নেই। যেসব জায়গায় মোটা রেখার চলন দাবি রাখে, সেখানে একাধিক চিকন রেখার পাশাপাশি চলন দিয়ে সে দাবি পূরণ করেছেন শিল্পী। কোথাও ডট দিয়ে তৈরি করেছেন ছায়া। কোনো কোনো কাজে বস্তুর বাস্তব আদলের ফর্ম ভেঙে দিয়েছেন পরাবস্তব অভিব্যক্তি।

গ্যালারির দেয়ালজুড়ে ড্রয়িংগুলো ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ও সময়ে আঁকা স্কেচ খাতার পাতাগুলো মেঝেতে একটি বেসমেন্টে সাজিয়েছেন সুরভী। স্কেচ খাতা দেখার যুক্তিনির্ভর দর্শন রয়েছে এ উপস্থাপনায়। দর্শককে এসব ড্রয়িং দেখতে হবে একান্ত নিবিষ্ট হয়ে, অবনত মস্তকে।

এ প্রদর্শনীতে বাদ পড়েনি ড্রয়িং করার সময় শিল্পীর পার্শ্ব পরিবেশের পাখি ও প্রাণীর মধুর কলরব। অর্থাৎ ৩০ মিনিটের একটি ‘সাউন্ড ইনস্টলেশন’ রয়েছে এখানে, যা ধারণ করা হয়েছে শিল্পীর ছবি আঁকার মুহূর্তে। সব মিলিয়ে ড্রয়িং-প্রধান এ রকম প্রদর্শনী নিশ্চয়ই শিল্পজগতে ভিন্ন স্বাদের পরিচায়ক।

২৩ মার্চ শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হবে আগামীকাল ৭ এপ্রিল।