হনুমানজি

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

পাখিডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে বাড়ির উঠোনে নেমেছে মিতালী। এলোমেলো চুল দুহাতে খোঁপায় বন্দী করতে করতে উঠোনটা পাড়ি দিয়ে দাঁড়াল এসে পুকুরপাড়ের বয়সী হিজলগাছটার তলায়। হিজল ফুল ঝরে গাছতলাটা যেন মখমলের গদি-বিছানা হয়ে গেছে—কী মিষ্টি ঘ্রাণ যে ছড়াচ্ছে চারপাশে! সে তাকাল গাছটার মাথার দিকে। অমনি তার শরীরে যেন ভয়ংকর ঝাঁকুনি জাগল, বুকের ভেতরটা যেন বরফ-জমাট হয়ে গেল মুহূর্তেই। একটা পেতনি সরাসরি তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে, পেতনিটার মুখ কালো, ইয়া লম্বা লেজটা ঝুলে আছে নিচের দিকে।

মুহূর্ত কয়েক মাত্র, বাড়িকাঁপানো চিত্কার দিয়ে সে ছুটল ঘরের দিকে। বাড়ির সবাই হুড়মুড় করে ঘর থেকে লাফিয়ে নামল উঠোনে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মিতালী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ঠাকুমার বুকে। বলল, ‘পেতনি পেতনি! হিজলগাছে বসে আছে। বড় বড় চোখ!’

মিতালীর বাবা-কাকারা দৌড়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখেন—ওটা একটা হনুমান। ব্যাপার বুঝে সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। মিতালীকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন বাবা। হনুমানটিকে দেখিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন সব। তখন সব বুঝে ডাকাবুকো হয়ে মিতালীও হাসি একখানা দিল বটে!

এদিকে ঠাকুমা হনুমানটিকে দেখেই ‘রাম রাম’ বলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘হনুমানজি! ও হনুমানজি! আপনি কৃপা করে যখন আমাদের বাড়িতে এসেছেন, তখন গাছে বসে না থেকে নিচে নেমে আসুন। আপনাকে আমরা ফলাহার করাব। সেবাযত্ন করব। পুজো দেব। রামের সহচর আপনি, সীতা দেবীর মুক্তির কান্ডারি। রাবণের লংকা পুরীকে আপনি পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিলেন। নামুন নামুন।’

অমনি কী যে বুঝল হনুমানটি, সুড়সুড় করে নেমে এসে গাছতলায় বসে গেল মানুষের মতো সোজা হয়ে। পাকা কলার ছড়া এল। কাঁসার বাটি ভরা দুধ এল। এক গ্লাস জলও এল। হনুমানজি নির্ভয়ে খেতে আরম্ভ করল। মিতালী ওকে দেখছে অবাক হয়ে। বাগেরহাট অঞ্চল তো বটেই—সুন্দরবনেও কোনকালে হনুমান ছিল না। তাই ওটা তো অচেনা সবার কাছে। ঠাকুমা নিয়মিত রামায়ণ-মহাভারত পড়েন শব্দ করে। মিতালী তাই সবকিছুই জানে। এখন বাবা-কাকাদের কথাবার্তা থেকে সে বুঝে ফেলেছে—মুখপোড়া এই হনুমানদের বসবাস এখন যশোরের কেশবপুরে। হাজারখানেক হনুমান আছে ওখানে। কিন্তু খাদ্যসংকট আর বাসস্থান-সংকটের কারণে মাঝেমধ্যেই দু-চারটা হনুমান কলা ব্যবসায়ীদের কলার ট্রাকে চড়ে দূরে দূরে চলে যায়। তারপরে নেমে পড়ে অচেনা জায়গায়। দুষ্টু ছেলেপুলেদের তাড়া খায়। ঢিল ও গুলতিতে অতিষ্ঠ হয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে পালিয়ে যায়। অনেকেই দয়া করে খাবার খেতে দেয়। মানুষের পাশে বসে, মানুষের হাত থেকে কলা-রুটি-বিস্কিট নিয়ে নির্ভয়ে খায়।

হনুমানটি যে খুবই ক্ষুধার্ত তা ওর ভঙ্গি ও চাহনি দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে মিতালী। ঠাকুমা একেবারে মাটিতে আসন পিঁড়ি হয়ে বসে ওর খাওয়া দেখছেন। ক্লাস সেভেনপড়ুয়া ডাকাবুকো মেয়ে মিতালীও এবার নির্ভয়ে বসল ঠাকুমার পাশে। ডান হাতখানা বাড়িয়ে আলতোভাবে রাখল হনুমানটির মাথায়। লম্বা লেজটি তুলে আদর করল। কী রকম করুণ, কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে যে হনুমানটি তাকাল মিতালীর চোখের দিকে! মিতালীর চোখে জল এসে গেল। চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়িয়ে সে বাবার দিকে ফিরে বলল, ‘বাবা! এটাকে ফেরত পাঠানো যায় না কেশবপুরে?’

বাবা মেয়ের মাথায় ডান হাতখানা রেখে বললেন, ‘মা রে! ফেরত পাঠাতে গেলে নানান রকম হ্যাপা আছে। ওই তো—গেল বছর কাঁঠালতলা গ্রামের রশীদ মোড়ল এ রকম একটি হনুমান নিয়ে রিকশাভ্যানে রওনা হয়েছিল কেশবপুরের দিকে। খুলনা শহরের পুলিশ তাকে পাকড়াও করেছিল প্রাণী চোরাকারবারি বলে। হাজতেও ছিল দিন তিনেক।’

তাহলে!

ঠাকুমা এবার বললেন, ‘হনুমানজি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন, খাবেন। আমি ওনার সেবাযত্ন করব। থাকবেন আমার পুজোঘরে।’

মিতালীর বাবা তখন মাকে কিছু বলতে চাইছিলেন। চাইছিলেন বলবেন, তাতে আবার প্রাণী আটকের মামলা করতে পারে বন বিভাগ। কিন্তু তার আগেই পাশের মোল্লাবাড়ির বাঘা বাঘা কুকুর তিনটি হাঁকডাক করতে করতে ছুটে আসে। হনুমানজি এক লাফে চড়ে বসলেন গাছের ডালে। কুকুর তিনটির তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে অচেনা, অদ্ভুত প্রাণীটিকে দেখে। সে কী হাঁকডাক! পারলে গাছে চড়ে বসে আর কী! মিতালীরা সবাই কুকুর তিনটিকে সরানোর চেষ্টা করছে। লাঠিসোঁটা আনছে। কিন্তু কিসের কী! খেপে গেছে কুকুর তিনটি। হনুমানটি কিন্তু নির্বিকার। নট নড়ন-চড়ন। আড়চোখে মাঝেমধ্যে দেখছে কুকুর তিনটিকে।

সবাইকে হতবাক করে দিয়ে হঠাৎ হনুমানটি ভয়ংকর ‘হুপ হুপ’ ডাক ছেড়ে লাফিয়ে পড়ল একটি কুকুরের পিঠে। কুকুরটি তো ভয়ে মাটিতে পড়ল মুখ থুবড়ে—সর্বনাশ! ভয়ংকর শত্রু পিঠে চেপেছে! পিঠে চড়েই হনুমানটি গেল কিছু দূর। তারপরে চোখের পলকে পিঠ থেকে নেমে টেনে ধরল কুকুরটির লোমশ লেজ। এবার তো কুকুরের মাথায় গোলমাল দেখা দিল! পেছন ফিরতেই হনুমানটি লেজ ছেড়ে দিয়ে মুহূর্তে বাঘা পণ্ডিত স্যারের মতো দুহাতে মুচড়ে ধরল কুকুরের দুই কান। পরমুহূর্তেই কান ছেড়ে দুহাতে কুকুরটির দুই গালে খামচি মেরে দৌড়ে এসে চড়ে বসল আবার হিজলগাছে। কুকুরটি লেজ নামিয়ে যা এক দৌড় দিল না! তাতে সবার মনে হলো—ওটা মোংলা বন্দরের আগে আর থামবে না। অন্য দুটি তো আগেই ভেগে গিয়েছে।

ঠাকুমা এবার হিজলতলায় গিয়ে জোড়হাতে বললেন, ‘হনুমানজি! নেমে আসুন, কলা খান। আপনার তো পেট ভরেনি।’

হনুমানটি নেমে এসে কলা খেতে শুরু করল আবার।