আমেরিকা ইজ আমেরিকা

ইউনিভার্সিটি অব অরিগনে প্লাকার্ড হাতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
ইউনিভার্সিটি অব অরিগনে প্লাকার্ড হাতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ

খোন্দকার রেজাউল করিমের লেখা এই আমেরিকা সেই আমেরিকা বইটি পড়া শেষে পরিতৃপ্ত হয়ে ওঠে মন। রম্য রচনার ঢঙে লেখা এই বই লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। যদিও ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘এই বইয়ের ঘটনার সবই সত্যি বলে ধরে নিলে ভুল হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘“যাহা বলিব সত্য বলিব”—আদালতেই মানায়। যা ঘটেছে, যা ঘটেনি, যা ঘটতে পারত, সবই লেখা আছে এখানে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত আজও ঘটে চলেছে আমেরিকার নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।’

আমেরিকার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব অরিগনে ১৯৭৮ সালে ভর্তি হন লেখক। ১৯৮৩ সালে সেখান থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যে পাঁচ বছর দীর্ঘ শিক্ষাজীবন, সেই জীবনেরই নিত্যকার চালচিত্র উঠে এসেছে এ বইয়ের ৪৫টি অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে।

খোন্দকার রেজাউল করিমের সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর দৃষ্টির প্রখরতা। সাধারণ কোনো ঘটনাও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না এবং সেই ঘটনা যখন তিনি রসাল ভাষায় বর্ণনা করেন, সে সময় মনে হয় চোখের সামনে তা ভেসে উঠছে দিব্য ছবির মতো। আমেরিকার মতো একটি নতুন দেশে তাঁর যাওয়া, নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া, সৃষ্ট সমস্যার মোকাবিলা করা, শিক্ষায়তনে চলমান ঘটনার বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হওয়া, নতুন বন্ধু ও বান্ধবীদের সাহচর্যে দিনযাপন—সর্বোপরি পর্যবেক্ষণের বিবরণ যে ভাষাভঙ্গিতে তিনি তুলে ধরেছেন, তাতে মনেই হয় না, লেখক হিসেবে তিনি নতুন; বরং মনে এই আশা দৃঢ় হয় যে, আমাদের সাহিত্যজগতে এমন একজন লেখককে পেলাম, যাঁর রম্যরচনার সম্ভারে ও তার পাঠে আমরা নিত্য সমৃদ্ধ হব।

এবার তাঁর রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। ‘চুলের খোঁপায় কলম’ শিরোনামের অধ্যায় মারফত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের একেবারে শুরুর কথা জানাতে গিয়ে জানাচ্ছেন, ‘বিদেশি ছেলেমেয়েদের মার্কিন মুলুকের রীতিনীতি বোঝানোর জন্যই ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন। প্রথম আধঘণ্টা মেলামেশা, জানাজানির পালা। তারপর এক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা। শেষে আবার আধঘণ্টা মেলামেশা, জানাজানির পালা। তারপর এক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা। শেষে আবার আধঘণ্টা মেলামেশা এবং আড্ডার জন্য বরাদ্দ। বাঙালি চেহারা দেখলেই নেম-ট্যাগটা দ্রুত পড়ে নিচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে কেউ আসেনি এবার। তবে কলকাতার বসুর সঙ্গে পরিচয় হলো। আমাকে অনেকে পাকিস্তানি, ভারতীয়, মেক্সিকান, ইথিওপিয়ান, মিডল ইস্টার্ন, এমনকি কালো আফ্রিকান আমেরিকান বলেও ভুল করছিল। আমি যে এমন আন্তর্জাতিক চেহারার মালিক, আগে কখনো ভাবিনি।’ নিজেকে নিয়ে এই যে পরিহাসপ্রিয়তা, একেই বলে সেই দুর্লভ রম্যগুণ, যা আজ আমাদের সাহিত্যজগতে দুর্লভ হতে বসেছে।

এই আমেরিকা সেই আমেরিকা
খোন্দকার রেজাউল করিম
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩৬ পৃষ্ঠা, দাম: ২৭০ টাকা।

‘মার্কিন নাপিত’ অধ্যায়ে আমেরিকার এক সেলুনে নিজের চুল কাটাতে গিয়ে লেখক যে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন, তার চমৎকার বিবরণ তুলে ধরেছেন। এই অধ্যায়ের শুরুটা বেশ মজার, যেখানে তিনি বলছেন, ‘ছেলেবেলায় “আম্রো-ইটালিয়ান সেলুন”-এ চুল কাটাতে হতো। পাড়ার মুখলেস ভাই এই নামটি দিয়েছিলেন। আমগাছের নিচে, ইটের ওপরে বসে নাপিতের কাছে চুল ছাঁটতে হতো বলে এই নামকরণ। সবকিছু নিয়ে টিটকারি করা ছিল মুখলেস ভাইয়ের স্বভাব। এই সেলুনকে তিনি ফরাসি উচ্চারণের মতো করে “ইটো-দে পোঁদে” বলেও ডাকতেন।’ ছেলেবেলার এই অভিজ্ঞতাকে মনে বহন করে লেখক যখন আমেরিকার সেলুনে চুল কাটাতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন, তখন লেখকের বিরক্তিমাখা উচ্চারণ, ‘এত কিছু জানলে আমি নিজেই তো নাপিত হয়ে যেতাম! তোর কাছে আসার দরকারটা কী? আম্রো-ইটালিয়ান সেলুনের স্বর্ণযুগের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।’

এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের পাঠ কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্রছাত্রীদের জীবনের বিচিত্র ধারাকেই পাঠকের সামনে তুলে ধরবে না, সেই সঙ্গে দেশটির সামাজিক চলমান জীবনধারাকেও তুলে ধরবে নানা ঘটনার সূত্রে।

‘চুমু খাওয়ার আসর’ অধ্যায়ের পাঠও পাঠককে দেবে এক নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ। লেখকের ভাষায়, ‘রাস্তার উল্টো দিকে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বিল্ডিং। তার এক পাশে ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রদের লাউঞ্জ। সেখানেই বসেছে চুমু খাওয়ার আসর। চারটি মেয়ে চেয়ারে বসে আছে। সামনের টেবিলে একটি কাচের পাত্র। তাতে কিছু ডলার জমা হয়েছে দেখলাম। উৎসাহী দর্শকদের ভিড় অনেক। তবে চুমু খেতে আগ্রহী যুবক নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে কেউ এলে দর্শকেরা করতালি দিচ্ছে।

 ‘কিছুক্ষণ পর সহপাঠিনী ক্রিস্টির সঙ্গে দেখা হলো। ও সুইজারল্যান্ডের মেয়ে। নারীদের সমান অধিকার এবং জেন্ডার-ইকুয়ালিটি...অর্থাৎ নারী-পুরুষের সাম্য নিয়ে সারাক্ষণ আন্দোলন করে বেড়ায়। ক্রিস্টি দেখলাম বেজায় খেপে আছে, “তোমাদের পুরুষশাসিত সমাজে এ শুধুই নারীদের অপমান করার একটা ফন্দি। জেন্ডার-ইকুয়ালিটি কোথায়? আমি চাই চারটে মেয়ের সঙ্গে চারটে ছেলেও চেয়ারে বসে থাক। আর মেয়েরা চুমু খেয়ে ছেলেদের ডলার দিক।”’

এ বই যাঁরা পাঠ করবেন, তাঁরা সহজেই ভুলবেন না এর প্রধান পাত্র-পাত্রীদের কথা। যেমন—মুসাদ্দেক, লিলিয়ান, জন, হিশাশি, ইয়োশিরো, জুলেখা অং, মিশেল, বাকের, জামিল ও রাহুল।

বইটি সত্যিই দুর্লভ গোত্রের। লেখক খোন্দকার রেজাউল করিমকে আমাদের সাহিত্য জগতে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাচ্ছি।