মহব্বতের কিসসা

‘ইমুন শয়তান পোলাপান কি গাছে ধরে? যিমুন লাগে ষোলোবটি চমকায়।’ চালতাগাছে উল্টা হয়া ঝুইলা আছিল নারায়ণ। রহিমন খ্যাচ খ্যাচ করতাছে। সিদা হয়া ডালিতে বয়া নারায়ণ রহিমনরে জওব দিল।

: হ, গাছে ধরে, এইলে পিসি চালতা লে, ডাইলে খাইছ।

কয়া চালতা পাইড়া রহিমনগো বাড়িতে উড়ায়া উড়ায়া ফালাইতাছে। রহিমন চিল্লায়া উঠছে, ‘দেখ নারায়ণ, এই চালতা মাথায় পড়লে খুনখারাবি হয়া যাইব। নাইমা আয় বাবা, পইড়া গেলে হাত-পাও ভাইঙা যাইব।’

: পিসি, তুই কাইলকা তর উপবাস সামওক্তে ভাঙলি আমারে ডাকছনাই কেলা?

: মুরাদ আর মুরাদের বউ বাপের বাড়ি গেছিল ইফতারের দাওয়াতে, আমি একলা নিজের লেগা কিছু করি নাই। আজান পরনে মুখে পানি দিয়া ভাত খাইছি।

: আমারে কইতি, আমি কিছু কিনা আইনা দিতাম।

: ওই দিন তর মায় তরে মারছিল কেলা?

রহিমনের এই সওয়ালে নারায়ণ চেইতা কালিচরণরে গাইল পাড়ন শুরু কইরা দিল।

: হালা কালিচরণ, তাড়ি খায়া দিনরাইত পইড়া থাকে, মায়রে যায়া কয় আমার বলে জাত গেছে তগো ইফতার খায়া। আমার বলে গোবর খায়া পাইচ্চিত করণ লাগব। আমিবি মায়রে কয়া দিছি, আমি রোজ পিসির লগে ইফতার করুম আর রোজ গোবর খামু। পিসির হাতের যে কুনু খাওন আমার পরসাদ।

রহিমনের লগে নারায়ণের এই হইল রিস্তা।

আমলিগোলার পিছে হইল গিয়া লালবাগ চামারটুলি, চামাররা কয় ঋষিপট্টি। দুয়ারকি চামারের বাড়ি হইল গিয়া আমলিগোলার রহিমনগো বাড়ির পিছে। নারায়ণ হইল গিয়া দুয়ারকির একটাই পোলা। বাড়ির লগে বাড়ি, নিজের আপনা পিসি নাই। এই মুসলমান রহিমনরে আপনা পিসি মনে করে। ইশকুল ছুট্টির বাদে সারা দিন টো-টো কইরা বেড়ায়, রহিমনগো আর নিজেগো ফলের গাছে উইঠা এই গাছ থেইকা ওই গাছে ঝুইলা ঝুইলা বান্দর গো লগে পাল্লা দেওন—এই হইল গিয়া আট বচ্ছরের নারায়ণের কাম। ইমুন শয়তান আছিল যে আমলিগোলার বান্দরবি অর শয়তানির সামনে হার মানত। আর এই শয়তান ছ্যাড়া রহিমনের চোখের তারা আছিল, যার লেগা মুসলমান মহল্লায় অর দোস্ত-মহিমের কমতি আছিল না। ছোট্টোওক্তে দুপ্ফরে নারায়ণের মা যবে নারায়ণরে নালায়া-ধোলায়া ভাত খিলায়া হোলাইবার লিত, মায়রে সে কইত, ‘তর লগে হুমু না, আমি অখন পিসির লগে হুমু, তর লগে রাইতে হুমু।’

যেই দেখত দুপ্ফরে রহিমন খায়া-লয়া কাইত হইত, ওমনেই সুটসুটায়া রহিমনের কাছে যায়া কইত, ‘পিসি, কিসসা ক।’

রহিমন এক্কেরে সিনায় সাপটায়া লিত কালা কাজল টানা চোখের এই পোলাটারে। যত আবদার নারায়ণের আছিল রহিমনের কাছে। নারায়ণের মা দুয়ারকিরে কইত, ‘পোলা আমার মুসলমান বাড়িতে পইড়া থাকে, পাড়ার মাইনষে তোমার ডরে সামনে কিছু কয় না, এটা কি ভালা?’

দুয়ারকি কইত, ‘দেখো সতী মায়া, এইটা হইল গিয়া মায়া। ছোট পোলাপান হইল ভগবানের রূপ। অগো কাছে হিন্দু-মুসলমান বইলা কিছু নাই। আর রহিমন হইল গিয়া আমার ছোট বইনের মথন।’

সতী গজ গজ করত।

: এই তুমিই পোলার জিব বাড়ায়া দিবা।

দুয়ারকি হাসত।

দুয়ারকি চামার হইল গিয়া চামারটুলির চামারগো ভেতরে সবতের থেইকা পয়সাআলা মানুষ। চামড়ার জুতার বড় কারখানা। দ্যাশ-বিদ্যাশে অর কারখানার জুতার কদর আছিল। চলত বেশুমার। ট্যাকা ট্যাকারে টাইনা আনে। অর সুদের কারবারবি আছিল। আর যাইব কই? ভাইগ্যদেবী লক্ষ্মীদেবীর আঁচল ধইরা হিড় হিড় কইরা টাইনা আইনা দুয়ারকি চামারের সিন্দুকে ঘর বানায় দিছে। দুয়ারকি আছিল বাস্তববাদী মানুষ। অই সবতের থেইকা বেশি বাস্তবতা চিনত। দুয়ারকিরে চিননের লেগা একটা ঘটনাই কাফি। রোজ বিহানে পূজা সাইরা কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়া কাচারির গদ্দিতে আয়া বইত। সারা দিন ট্যাকা-পয়সার লেনদেন চলত। সুদের কারবার বইলা হিন্দু-মুসলমান সবতেই সুদে ট্যাকা লিয়া যাইত। ট্যাকার ওক্তে কুনু ছে ছে নাই। ট্যাকা তো জাত-পাতের ওপরে। এই ট্যাকা সবতেই ছোঁয়া-ছুঁয়ি করে। এই উষ্টুমে ছোটজাত-বড়জাত—সবতেই আইত। কেউ আয়া কয়, বাবু নমস্কার, কেউ আয়া কয়, বাবু আদাব। দুয়ারকি আদাব-নমস্কারের জওব আদাব-নমস্কারে দেয় না। কয়, ‘কয়া দিমুনে।’

মাইনষে নমস্কারের জওব নমস্কারে দেয়, আদাবের জওব আদাবে দেয়। মাগার এই ব্যাটার এইটা কিমুন জওব? একদিন অর গদ্দির সরকার হিম্মত কইরা জিগায়া বইল, ‘বাবু, আপনে সবতের আদাব-নমস্কারের জওব দ্যান কয়া দিমুনে, এটা কিমুন জওব?’

দুয়ারকি কুনু জওব দিল না। সাম ওক্তে যবে কাচারি বন্দ কইরা সবতে বাড়ি যায়, ওই ওক্তে দুয়ারকি সরকাররে কইল, ‘খাড়াও, তুমি বাদে যায়ো।’

কাচারির ভেতরে দিয়ে দুয়ারকির হোওনের ঘরে যাওন যায়। ওই ঘরে সরকাররে লিয়া যায়া টিমটিমা হারিকেনের রশ্মিতে লোহার সিন্দুক খুইলা কওন শুরু করল, ‘ওমুক বাবুর নমস্কার, তমুক বাবুর আদাব।’

ওই দিন যত মানুষ আদাব-নমস্কার দিছে সবতের নাম একে একে কয়া গেল। সরকার তো তাজ্জব হয়া গেল, এইটা আবার কী! বুঝবার পারতাছে না। দুয়ারকি কইল, ‘কি বুঝবার পারো নাই? আমি হইলাম গিয়া একটা চামার, ছোট জাত। আমি তো উঁচা জাতের মাইনষের আদাব-নমস্কার পাওনের লায়েক না। আমার ট্যাকা আছে বইলা আমারে মাইনষে পুছে। ট্যাকা না থাকলে কেউ আমারে বাল দিয়া পুছত না। আমি মনে করি ট্যাকা হইল গিয়া আদাব আর নমস্কার পাওনের লায়েক। যে লায়েক অরে আমি নমস্কার-আদাব পৌঁচায়া দিই। মাইনষে ভগবানরে ভুইলা চলবার পারব মাগার ট্যাকারে ভুললে চলব না। ট্যাকার ওপরে দুনিয়ায় কিছু নাই। লালবাগের চামারটুলিতে ওই বিটিশ আমলে দুয়ারকির আছিল হাবলি বাড়ি। আর কুনু চামারের এত বড় হাবলি বাড়ি আছিল না।

দুই.

: দেখ নারায়ণ, তরে এত না করি সাম ওক্তে বাঁশি বাজাইবি না, তর কানে বাতাস যায় না? তুই জানছ না মুরাদের বউ এক পোলার মা, সাম ওক্তে বাঁশির সুর কানে গেলে ভাত খাইব না?

: না আমার কানে বাতাস যায় না। আমি কি বউদির ভাত লিয়া বয়া রইছি?

রহিমন কইল, ‘তুই দিনে দিনে বড় হইতাছচ না ছোট? তুই বড় হইবি না?’

: না আমি বড় হমু না। বড় হইলে তরে জ্বালাইব কেঠা?

: নরায়ণরে একটা কথা কইলে হুনে না, আবার কিছু কইলে মুখে মুখে চোপা করে, হুনছ দাদা?

: তুই তো জিব বাড়ায়া ফালাইছচ। তর আশকারা পায়া কেউরে টেরে না। কিছু কইলেই তর কাছে যায়গা।

: সাম ওক্তে বাঁশির সুর কানে গেলে বউ তো ভাত খাইব না, ওই তো হইল গিয়া এক পোলার মা।

: তুইবি হিন্দুগো মতন এই কুসংস্কার মানোছ? কিচ্ছু হইব না। মুরাদের বউরে ভাত খাইবার ক।

দুয়ারকি হইল গিয়া পঞ্চাতের মাতবর, মন্দিরের সভাপতি। যত আচার-বিচার ওই সব করে। চামারটুলির সব ভালা-বুড়া, আপদ-বিপদ—সব ও-ই দেখশোন করে।

নারায়ণ পাঁচ কেলাস পইড়া পড়ালেখা ছাইড়া দিছে। এখন ওই কবুতর উড়ায়া বাঁশি বাজায়া দিন গুজরায়। অগো বাড়ির সামনের জাগায় কারখানার কাঁচা চামড়া হুকায়। নারায়ণ লাটসাবের চামড়ার বদবু ভালা লাগে না, ওই সইবার পারে না। এইটার লেগা কারখানায় কাম হিকে নাই। বাপের একটা পোলা। যা চায় তাই দেয়। অর কুনু অভাব আছিল না। ছ্যাড়া এখন জুয়ান হয়া উঠতাছে। উন্নিশ বচ্ছর ওম্মরের ছ্যাড়ার চোখে নয়া রং লাগছে। আর দেখতে কি কমু, কালা পিটা গতর চকচক করে। গাছে গাছে ঝুইলা বড় হইছে তো, দুই ড্যানার দিকে নজর পড়লে নজর আটকায়া যায়। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। বড় বড় চোখের দিকে তাকাইলে চোখ ইমুন টাইনা রাখত যে চোখ ফিরান যাইত না।

চামারটুলির চামারগো ভেতরে নারায়ণ আছিল কিসসার রাজকুমার। হাতে বাঁশি লিয়া ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকড়ায়া যবে পাড়ার ভেতরে দিয়া হাঁইটা যাইত, চামারটুলির চামন্নি ছেড়িরা নারায়ণরে পাওনের খোয়াব দেখত। ছেড়িরা যিমুন বেশরম আছিল, নারায়ণবি ছেড়িগো লালচাইত। ধরা দিত না। সামনে দিয়া হাঁইটা গেতোগা। নিশি রাইত, চাইরো দিকে সুনসান, কুনু আওয়াজ নাই। নারায়ণের পাগল করা বাঁশির সুরে মাইষের দিল উদাস হয়া যাইত। এই উদাইসা সুরে কেউ সুখে কেউ দুংখে তাইকা ভিজাইত।

তিন.

মন্দিরের পুরান পূজারি বিমার পইড়া যাওনে পূজারির ছোট ভাই সুশান্ত রাধা-মাধবের মন্দিরে নয়া পূজারি হয়া আইছে। ওম্মর ষাইট বা পঁয়ষট্টি বচ্ছর হইব। বাইটা, মোটা, প্যাট উবলায়া রইছে। চামড়ার নিচে চর্বি থল থল করে, দুধ-ঘি আর মাখখনের মহব্বতে। নাভির নিচে ধুতি বান্দে, টকটকা গতরের রং, এর ওপরে ধবধবা সাদা পৈতা। দুই ড্যানার চামড়া ঝুইলা রইছে। দেখতে লাগে আশি বচ্ছরের বুইড়া। এই সুশান্তর বউ মধু, আহা রূপ তার, মা দুগ্গা অর সামনে কী! ষোলো বচ্ছরের পুতলা, হালকা-পাতলা, পলকা। বিলাই চোখ, টকটকা আগুনের মতন গতরের রঙে মানায়া গেছে। সিঁথিতে সিন্দুর আর কপালে লাল সিন্দুরের ফোঁটা, বিহানে যবে লাল সুরুজের ফোঁটায় দুনিয়া সাইজা উঠত, ইমুন দেখতে লাগত মধুরে। আর চুল-মাথা থেকা ম্যাঘের মথন নাইমা আলতা দেওয়া পায়ের পাতার ওপরে পায়ের গোচ্ছায় চুমা দিত। সবতে আফসোস করত, আহারে কুন গরিব ঘরের মাইয়া জানি বুইড়ার লগে বিয়া দিয়া বুইড়া মরণে ঠেইলা দিছে। এর ভেতরে বুইড়া হইল গিয়া ছোচড়া—খ্যাটখ্যাটা মিজাজের। সুলুক তো অর ভেতরে আছিল না। সুশান্ত বিয়ার রায়ে মধুর গতর ডাকাইতি করবার পারছে। মাগার মধুর দিল কেমতে লুটব। মধু কুনু ভুল চুক করলে বুইড়া যবে এক কথা লিয়া বারেবারে খ্যাটখ্যাট করবার লাগত, মধু দিলে দিলে কইত, ‘যিমুন লাগে এইটা আমার খসম না, ঠাকুরদা।’

হিন্দু পোলারা খালি তাকায়া দেখে আর আফসোস করে, ‘বুইড়া কামটা ভালা করে নাই।’ মুসলমান পোলারা চোখের ভুক মিটাইবার লেগা মন্দিরের চত্বরে পইড়া থাকে। ঠাকুরের দিলেবি সুকুন নাই। জোয়ান ছ্যাড়াগো দেখলে বউরে খালি ছাপায়া রাখবার চায়। মাগার একদিন নারায়ণের চোখে পইড়া গেল মধু। আগেবি বহুত দেখছে, মাগার ওই দিনের দেখনে দুজনের ফায়দা হইছে না লোকসান হইছে, আপনেরা বিচার করবেন। নারায়ণ মন্দিরের সামনে দিয়া বড় রাস্তায় যায়। একদিন দুপ্ফরে চাইরো দিকে সব সুনসান। চাইরো দিকে কুনু কাউয়া চিলবি নাই। নারায়ণ দেখে পূজারির বউ মধু বালতিতে রশি বাইন্দা কুয়াত থেকা পানি উঠাইতাছে। বালতি টাননের কুনু ফাঁকে বুঝি ঘুমটা মাথাত থেকা খসকায়া গেছে। বিড়ার মথন জুরাটা গর্দনে ঢিলা হয়া আধা খুইলা রইছে। নারায়ণ দেখছে, দুই চোখ ভইরা দেখছে। যবে মধু দুই হাত দিয়া রশি ধইরা ভরা বালতি টাইনা উঠাইতাছে, বালতি টাননের ওক্তে হাত বদলানের তালে তালে মধুর কম্মর আর চুতর ইমুন সোন্দর লচকাইতাছে যে নারায়ণ চোখ ফিরাইবার পারতাছে না। আতখা মধু পিছে ফিরনে আসমান-জমিন হিলায়া নারায়ণের হুশ ফিরা আইছে। আর মধুও নারায়ণের নয়া রূপ দেখল। অর মনে হইল, এটা কেঠা? জুয়ান কৃষ্ণের যমজ ভাই নিহি? ওই দুনিয়ার কৃষ্ণের দিকে তাকায়া যিমুন চোখ ফিরাইবার পারতাছে না। হুশ হওনের বাদে মধু হরবরায়া ঘরের ভেতরে গেছেগা। এর বাদে কী হইল চামারের পোলা আর পূজারির বউ কেউ কেউরে ভুলবার পারতাছে না। মধুর কাছে লাগে নারায়ণ অর চাইরো দিকে ঘোরে। রাইতে যবে নারায়ণ বাঁশিতে টান মারে মধু বেচইন হয়া যায়। পাগল দিল এই সংসারে আর বইবার চায় না। আর নারায়ণ অগো ছদে উইঠা সারা রাইত বাঁশি বাজায়, বাঁশির সুরে ওই যিমুন অর দিলের কথা মধুরে কইবার চায়।

চার.

এখন নারায়ণ সব পূজায় মন্দিরে হাজির অয় পরতিমা মধুর লেগা। চোখে চোখে কথা কয় দুইজনে। ওই বিলাই চোখে নারায়ণ দুনিয়ার তামাম সুকুন বিছরায়া পাইত। মধু ছোটকাল থেকা যে সাথির খোয়াব দেখত ওই নারায়ণের ভেতরে সে সব দেখে। আর নারায়ণ মন্দিরে যাওনের ছুতা পাইলেই হইল, দে ছুট। অষ্টমীর দিন আরতি নাচে নারায়ণের সামনে কেউ খাড়াইবার পারত না। দুয়ারকির দিলে বহুত সুকুন আইছে, অর পাগলা পোলার ধর্মেকর্মে মন বইছে দেইখা।

সুশান্ত যবে রাইতে মধুরে ধরে, মধুর গতর সহজে জাগে না। বহুত কোশিসের বাদে ষোলো বচ্ছরের গতর বুইড়ার কলায় যদিবি জাগে, মাগার মধুর ভালা লাগে না, বুইড়ার ও ঝুলা থলথলা চামড়া দেইখা অর উলটি অহে। এইটা তো মধুর কুনু দোষ না। বোতল আরমান মোক্খা। বুড়া বুড়ারে বিছরায়, পোলাপান পোলাপানরে বিছরায়। ওম্মরে ওম্মরে মিললে দিলের মিল অহে। জাতের মিল হয়া কুনু ফায়দা নাই।

এখন তো মধু-নারায়ণ—দুইজনের কথা, হাসি-ঠাট্টা চলে। দুইজনের দিলের কথা দুইজনের কাছেই চাপ্পা নাই। মধু কইত, ‘তুমি যবে রাইতে বাঁশি বাজাও, বাঁশির সুর হাওয়ায় ভাইসা আমার দুই কানে যাওনের লগে লগে আমার দিল ভইরা যায়। আমার কাছে লাগে তুমি আমার লগে হুইয়া রইছ।’

নারায়ণ কয়, ‘চলো মধু আমরা ভাইগা যাই।’

মধু কয়, ‘কই যামু?’

নারায়ণ জওব দেয়, ‘জঙ্গলে। দুই দিল এক হইলে জঙ্গলই ঘর।’

দুইজনের জোয়ানি দুইজনের লেগা মাথা কুইটা মরে। অগো ঢলাঢলি পাড়ার মাইনষের চোখে পড়লেবি কেউ কিছু কওনের হিম্মত পাইত না দুয়ারকির ডরে।

দিনে দিনে ঠাকুরের ওম্মর বাড়তাছে। অর গতর থেইকা আহে। রাইতে দুইজনে দুই দিকে ঘুইরা হুইয়া থাকে। দুইজনই বাইচা যায়। একদিন যা হওনের আছিল হয়া গেল। ঠাকুর রোজ সুরুজ উঠনের আগে, আন্ধার থাকতে বালুঘাট দিয়া নাহাইবার যাইত বুড়িগঙ্গায়। মধুরে একলা ঘরে থুইয়া। পাক্কা দুই ঘণ্টা কাটায়া আইত গাঙে। নারায়ণ মধুর মুখে যবে হুনছে যে ঠাকুর বিহানের আগে আন্ধার থাকতে গাঙে যায়, এর বাদে এই মওকা কেউ ছাড়ে নাই। একদিন ফাগুন মাসের বিহানে ঠান্ডা হাওয়ার লগে যবে দখিনা হাওয়ার মিলনের ওক্তে মধু দেখল-বুঝল, মরদ কারে কয়। জোয়ারের ঢল যবে আয়া একটা ঢেউ আর একটা ঢেউয়ের ওপরে আছড়ায়া পড়ে, ওই রকম কুদরতের টানে অরা একজন আরেকজনের দিকে আছড়ায়া পড়ল। কুদরতের খেইলের কাছে হার মাইনা। জাত-পাত—সব ফ্যানার মথন ভাইসা গেল মানুষের জনম দেওয়া নিয়মের দেয়াল ভাইঙা। মধুর দুনিয়া বদলায়া গেল। মধুর গতরের সাহারা আর দিলের সুকুন ওই দিশা নারায়ণ অরে বাতলায়া দিল।