একুশের কবি

>

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর রচনাসমগ্র সম্পাদনা করার সময় এই গদ্যটি লিখেছিলেন বেলাল চৌধুরী। কিন্তু পরে তিনি এটি আর প্রকাশ করেননি। লেখাটি পাওয়া গেছে কবি পিয়াস মজিদের সৌজন্যে।

মহান একুশজাত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কর্মবহুল বর্ণোজ্জ্বল জীবনের অবসান দিনটি ছিল ১৯ তারিখ। সেই দিনটা ছিল আবার সোমবার। হিসাব অনুযায়ী বছরটা ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতেই গভীর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। সেই থেকে তাঁর জীবন সহচরী মণি বা মাহজাবীন খান ও অন্যান্য স্বজন-পরিজনের এক কঠোর অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়। তিনি বেঁচে আছেন ঠিকই, কিন্তু চেতনাবিলুপ্ত। মস্তিষ্কের জাগ্রত কোষে কোষে চলছে এক অদ্ভুত আলো-আঁধারির খেলা। যেন তিনি ঘুমিয়ে আছেন অকাতরে। অনন্ত ঘুমে। সেখানে মা, ভোরের শিশির, শেফালি, শালিক, মুনিয়া পরম আদরের প্রাণাধিক একমাত্র কন্যা কাকাতুয়া, কবিতা, কিংবদন্তি, বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষেরা, এত যে বিশ্বজোড়া বন্ধুবান্ধব, কে কতটা সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন বা আছেন বলা মুশকিল।

একজন বাঙালি আমলা হিসেবে বিশ্ব পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি কতটা উঁচু শিখরে আরোহণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই সম্যক ধারণা ছিল না। না হলে কিছু অর্বাচীন কী করে মহান ভাষা আন্দোলনের এই সাহসী কলমসৈনিকের সঙ্গে হঠকারী এবং চরম কাপুরুষোচিত আচরণে মাততে পারে, মাঝে মাঝে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা যায় হয়তো, কিন্তু সেটা কি কতিপয় অর্বাচীনের অবিমৃশ্যকারিতার মতন অতটা সহজ যে তাকে শরবিদ্ধ করে হত্যার শামিল?

যিনি ইহলীলা সংবরণ করার আগ পর্যন্ত জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা, বন্ধুবাৎসল্য ও পরোপকারী উদার মনোভাবের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। প্রকৃত কবি ছাড়া সচরাচর এ ধরনের হৃদয়বান মানুষ আমাদের এ ক্লিন্ন, ক্লিষ্ট সমাজে বিরল।

১৯ মার্চ তারিখটা নীরবেই চলে যেত। কিন্তু কিংবদন্তির কথক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সৃষ্টিকর্ম এতই সর্বগ্রাসী জীবন্ত যে এখনো কবির এত ঢের অনুরাগী, গুণগ্রাহী রয়েছেন, যাঁরা তাঁর স্মৃতিকে অত সহজে ভুলতে দেবেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ফেব্রুয়ারিজাত এবং আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সোনালি ফসল এই কবির বেদনাহত অভিমানী বিদায়ে হয়তো এই বিশ্বসংসারের কিছু আসবে-যাবে না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের কাব্যজগতে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী মানুষটির যথাযথ মূল্যায়ন যতই দিন যাবে অঙ্কুরিত হতে বাধ্য। এই দিনটিতে কবির কিছু নিকটজন একান্তে বসে তাঁর সুকৃতির কথা বলাবলি করেছেন। তাঁর পরলোকগত আত্মার প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এ-ই তো চাই। এর বেশি বাহ্যিক লোকদেখানো কবির নিজেরও অপছন্দের ছিল। তিনি পারিবারিক জীবন ও শিশুদের ভালোবাসতেন। আর বাংলা সাহিত্যে মা, মাটি, ভাষা, দেশ ও নিসর্গ লোকজ ফর্মে বারবার তাঁর লেখায় ফিরে এসেছে। আমাদের স্বল্পবিত্ত জীবনে এই সামান্য মনে রাখাটাই বা কে রাখছে।

একুশের কবি হিসেবে যদি কাউকে গণ্য করতে হয়, অতি অবশ্য তাঁর নাম আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। ‘কুমড়ো ফুল’ নামে তিনি যে ছড়াটি না কবিতাটি লিখেছিলেন, তার তুল্য অন্তত একুশকে উপলক্ষ করে এ রকম আর কোনো লেখা হয়েছে কি না সন্দেহ, ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে/ নুয়ে পড়েছে লতাটা,/ সজনে ডাঁটায়/ ভরে গেছে গাছটা,/ আর আমি/ ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।/ খোকা, তুই কবে আসবি?/ কবে ছুটি?/ চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।’

কী দুঃসহ জ্বালাময়ী প্রতিটি পঙ্‌ক্তি। চোখের কোণে বাষ্প জমে ওঠে গোটা কবিতাটি পড়তে পড়তে। মুখের বুলিকে এমন অব্যর্থ আর তীব্র তীক্ষ্ণ বাণ করে তুলতে আর কারও লেখায় কখনো দেখিনি। গোটা কবিতাটা উদ্ধৃত করে দেওয়ার লোভ সংবরণ করা খুবই কঠিন। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তত একবার কবিতাটি পড়ে হৃদয়কে প্রক্ষালন করে নেওয়াটাই যেকোনো বাঙালির জন্যই পরম পুণ্যের কাজ।