কিছু মিছু আর বিড়াল

তখনো সূর্যি মামা ওঠেনি। বাইরে খেলার জায়গাগুলো ভেজা। অগত্যা ভেজা স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় বাড়িতে জবুথবু হয়ে বসে ছিলাম। সঙ্গে ছিল স্যালি। দুজনে ঘরে বসে ছিলাম। আমি আর স্যালি।
আমি বললাম, ‘এভাবে বসে না থেকে কিছু একটা করা দরকার!’
কিন্তু এমন বিশ্রী আবহাওয়া। বাইরে যাওয়াও যাবে না, বলও খেলা যাবে না। অগত্যা, এভাবেই কোনো কিছু না করে চুপচাপ বসে ছিলাম। আসলে করার কিছু ছিলও না। দুজনে একটা কাজই করছিলাম—শুধু বসে থাকা! বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই না!
কিন্তু এভাবে বসে থাকতে একটুও ভালো লাগছিল না।

হঠাৎ পাশেই দুম করে শব্দ হলো। আমরা ছিটকে লাফিয়ে উঠলাম! কে এমন শব্দ করল—চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। তাকে দেখতে পেলাম—একটা বিড়াল। মাথায় হ্যাট পরা একটা বিড়াল!
হ্যাটওয়ালা বিড়ালটা বলল, ‘তোমরা এভাবে বসে আছো কেন? এভাবে বসে না থেকে অনেক মজার মজার খেলা তো খেলা যায়! আমি মজার খেলা দেখাতে পারি। নতুন কিছু কৌশলও জানি। তোমরা চাইলে সেগুলো দেখাতে পারি। এ জন্য তোমাদের মা তোমাদের বকবে না।’

আমি আর স্যালি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কিন্তু কী বলব বুঝতে পারলাম না। মা সারা দিনের জন্য বাড়ির বাইরে।
আমাদের পোষা মাছটা বলল, ‘না! না! বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দাও! বলে দাও তোমরা এখন খেলতে চাও না। তোমাদের মা এখন বাড়ি নেই। ওকে থাকতে দেওয়া ঠিক হবে না।’
‘শোনো! শোনো! কোনো ভয় নেই।’, বলল বিড়ালটা। ‘খেলাগুলো মোটেও খারাপ নয়।’
একটু থেমে সে আবার বলল, ‘তোমরা চাইলে আমরা একসঙ্গে অনেক মজা করতে পারি। আমি একটা মাছ নিয়ে বলব আপ-আপ-আপ!’
‘আমাকে নিচে নামিয়ে দাও!’ আমাদের মাছটি বলল। ‘এই খেলায় কোনো মজা নেই! আমাকে এক্ষুনি নিচে নামিয়ে দাও! নিচে পড়ে যাব।’
বিড়ালটি বলল, ‘ভয় নেই! তোমাকে ফেলব না। এই বলের ওপর দাঁড়িয়ে তোমাকে এভাবে ওপরে ধরে রাখব। এই দেখো, আমার এক হাতে একটা বই থাকবে! আমার হ্যাটের ওপর একটা কাপ থাকবে! কিন্তু এগুলোই সব নয়! আমি আরও অনেক কিছু করতে পারি!’

একটু থেমে আবার বলল, ‘আমার দিকে তাকাও তো। এই দেখো, আমার টুপির ওপর একটা কাপ আর কেক নিতে পারি! দুইটা বইও নিতে পারব! একটা মাছও ধরে রাখতে পারব! আরও দেখো, একটা ছোট্ট খেলনা জাহাজ! আর এক বাটি দুধ...দেখো! আমি এভাবে বলের ওপর এক পায়ে লাফিয়ে উঠতেও পারি আবার নামতেও পারি! কিন্তু ভেবো বসো না, এটুকুই সব! আরে না! এটাই সব নয়...’
তারপর বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ সে ঝপ করে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পড়ে গেল! বলটার ওপর থেকে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল বিড়ালটা। তার হাত থেকে সবকিছু নিচে পড়ে যেতে দেখলাম আমি আর স্যালি! আমাদের পোষা মাছটাও নিচে একটা পাত্রে পড়ে গেল।

মাছটা রেগেমেগে বলল, ‘এসব খেলা একটুও ভালো লাগেনি আমার। যত সব ফালতু খেলা! তাকিয়ে দেখো তো তুমি কী করেছ! বাড়িটার কী হাল করেছ! নোংরা করে দিলে সবকিছু!’
আমি বললাম, ‘তুমি আমাদের খেলনা জাহাজটা কেকের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছ। আমাদের বাড়িটা কেমন নোংরা করে দিয়েছ, দেখেছ! নতুন মইটা তুমি বাঁকিয়ে ফেলেছ। মা এখন বাড়ি নেই। তুমি এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে চলে যাও!’

‘কিন্তু বাড়িটা আমার বেশ ভালো লাগছে।’ বিড়ালটা বলল। ‘এখান থেকে যাব না। যেতে ইচ্ছে করছে না। সুতরাং...’ বিড়ালটা একটু থেমে বলল, ‘এ জন্য তোমাদের এখন নতুন আরেকটি খেলা দেখাব!’
বলেই, শিয়ালের মতো খুব দ্রুত দৌড়ে বিড়ালটা বাইরে গেল। একটু পরেই সে ফিরে এল। তার হাতে একটা বাক্স। একটা বড়সড় লাল কাঠের বাক্স। বাক্সটা ছোট্ট ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। ‘এবার এই খেলাটা দেখো।’, বিড়ালটা বলল। ‘একবার তাকিয়েই দেখো!’

সে একটু উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি খেলাটার নাম দিয়েছি—ফান ইন আ বক্স। এই বাক্সে দুটো জিনিস আছে। তোমাদের দেখাব। এগুলোকে আমি কিছু আর মিছু বলে ডাকি। ভয় পেয়ো না, জিনিস দুটো তোমাদের কামড়াবে না। তোমাদের মজা লাগবে।’
বাক্স খুলতেই কিছু আর মিছু বেরিয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে এল। তারা বলল, ‘কেমন আছো তোমরা? তোমরা কি কিছু আর মিছুর সঙ্গে একবার হাত মেলাবে?’
স্যালি আর আমি বুঝতে পারলাম কী করব। তাই কিছু না বুঝেই আমরা কিছু আর মিছুর সঙ্গে হাত মেলালাম।

কিন্তু আমাদের পোষা মাছ বলল, ‘না! না! এদের বাড়ির মধ্যে থাকতে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এখনই ওদের বের করে দাও! তোমাদের মা এখন বাড়ি নেই! এক্ষুনি বের করে দাও!’
‘ভয় নেই ছোট্ট মাছ সোনা’, বলল বিড়াল। ‘কিছু-মিছু খুবই ভালো।’ সে কিছু-মিছুর গায়ে হাত বুলিয়ে বলল। ‘এগুলো পোষা। একেবারে পোষ মানানো! ওরা খেলতে এসেছে। এ রকম ভেজা বিশ্রী দিনে কিছু-মিছু তোমাদের অনেক আনন্দ দেবে।’

বিড়ালটা আবার বলল, ‘এখন আমরা একটা খেলা খেলব। এই খেলাটা কিছু-মিছুরও খুব পছন্দ। ওরা ঘুড়ি ওড়াতে খুব পছন্দ করে।’
আমি বললাম, ‘না! এই বাড়িতে ওরা ঘুড়ি ওড়াতে পারবে না। ওহ্‌! সবকিছু ওলট-পালট করে ফেলবে ওরা। একটুও ভালো লাগছে না আমার। একটুও না!’
আমি আর স্যালি দেখলাম ওরা দৌড়ে হলঘরের দিকে গেল। কিছু আর মিছুকে দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেতে দেখলাম! বারবার ধাক্কা খেলো! দুম দুম ধুপ ধাপ শব্দ শুরু হলো হলঘরে! কিছু আর মিছু দৌড়ে ওপরে উঠল! দৌড়ে নিচে নামল! একটা ঘুড়ির সুতোর সঙ্গে আমাদের মায়ের নতুন গাউনটা দেখতে পেলাম! ওই যে গোলাপি আর লাল ফুটকি ফুটকি গাউনটা।
ঘুড়িটা মায়ের বিছানার সঙ্গে ধাক্কা খেল! এবার কিছু-মিছু দুম দুম ধুপ ধুপ শব্দে দৌড়াতে লাগল, লাফাতে লাগল। যত সব বাজে খেলা খেলতে লাগল।
আমি বললাম, ‘এসব খেলা একটুও ভালো লাগছে না! মা এসব দেখলে কী বলবে!’

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের মাছটা বলল, ‘শোনো! শোনো! তোমাদের মা বাড়ির দিকে আসছে! কথা শুনতে পাচ্ছো?’
‘ওহ্‌! মা এসব দেখলে কী বলবে? এসব দেখে সে একটুও খুশি হবে না।’

‘তাড়াতাড়ি কিছু করো!’, মাছটা বলল। ‘তোমাদের মাকে দেখতে পাচ্ছি। বাড়ির কাছে চলে এসেছেন! এক্ষুনি কিছু আর মিছুকে তাড়িয়ে দাও!’
আমি আমার জালটা আনতে গেলাম। বললাম, ‘এই জাল দিয়েই আমি কিছু-মিছুকে ধরে ফেলব।’
হাতে জালটা নিয়ে নিচে ছড়িয়ে দিলাম। জালটা টুপ করে নিচে পড়ল। আর জালের মধ্যে আটকা পড়ল কিছু-মিছু। অবশেষে তাদের লাফালাফি, দাপাদাপি থামাল।
বিড়ালের কাছে কিছু-মিছুকে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘এবার যা বলব সেটা তোমাকে শুনতে হবে। তোমার জিনিস দুটো বাক্সে ভরে এখান থেকে নিয়ে যাও!’
‘ওহ্‌ খোকা!’ বিড়ালটা বলল। ‘আমাদের খেলা পছন্দ হয়নি তোমার...কী লজ্জার কথা!’
তারপর সে কিছু-মিছুকে বাক্সে ভরে আটকে দিল। মন খারাপ করে চলে যেতে লাগল।

‘এবার ভালো হয়েছে।’ মাছটা বলল। ‘বিড়ালটা চলে গেছে। কিন্তু তোমাদের মা ফিরে এসে সবকিছু এমন তালগোল পাকানো দেখলে ঠিকই বুঝতে পারবে সব!’
আসলেই চারদিকে এমন অগোছালো হয়ে ছিল যে বলার নয়। এগুলো ঠিকঠাকমতো গোছগাছ করা আমাদের কম্ম নয়। কিন্তু কোনো উপায়ও দেখছি না!
আমরা যখন এসব দুশ্চিন্তা করছি তখন বিড়ালটা এসে হাজির। ‘এসব জঞ্জাল নিয়ে কোনো ভয় নেই।’ বিড়ালটা বলল। ‘আমি সব সময় খেলার জিনিসপত্র নিজেই তুলে ফেলি। এবার আরেকটা মজার খেলা দেখাব!’
আমরা দেখলাম ঘরে চারপাশে পড়ে থাকা জিনিসগুলো সে তুলে ফেলতে শুরু করল। কেক, মই, গাউন, দুধ, সুতো, বইগুলো, বাটি, পাখা, কাপ, খেলনা জাহাজ, মাছ সব তুলে ফেলল সে। তারপর জিনিসগুলো বাইরে রেখে দিল। বিড়ালটা বলল, ‘এবার হয়েছে।’ এ কথা বলেই সে চলে গেল।

বিড়ালটা চলে যাওয়ার পরপরই মা ঢুকল। আমাদের দুজনকে দেখে মা বলল, ‘এতক্ষণ তোমরা কী কী মজা করলে? বলো আমাকে। কী করলে তোমরা?’
স্যালি আর আমি বুঝতে পারলাম না, কী বলব। আজ সারা দিন যে ঘটনাগুলো ঘটে গেল সেগুলো কি মাকে বলব? কথাগুলো বলা কি ঠিক হবে? এখন কী করব বুঝতে পারছি না। আচ্ছা তোমার মা কখনো যদি তোমাকে এমন প্রশ্ন করে তাহলে তুমি কী করবে?
মূল গল্প: ড. সুস