আমার আঁকাআঁকির গল্প

>

কার্টুনিস্ট মেহেদী হককে তোমরা হয়তো চেনো দাদু-নাদুর আঁকিয়ে হিসেবে। আরও কত মজার কমিকস তিনি আঁকেন! মেহেদী হকও কিন্তু একদিন তোমার মতো ছোট ছিলেন। আঁকার খাতায় তিনিও আঁকতেন সেই চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য—একটা কুঁড়েঘর আর তার পেছনে কলাগাছ। কীভাবে আঁকাআঁকির ভূত তাঁর মাথায় চাপল, সেটাই তিনি লিখেছেন তোমাদের জন্য।

অাঁকা: মেহেদী হক
অাঁকা: মেহেদী হক

আমার আঁকাআঁকি শুরু করার গল্পটা খুব মজার। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এ রকমভাবে আঁকাআঁকি খুব বেশি আঁকিয়ে করেনি। আমি আঁকাআঁকি করতাম আমাদের বাসার মেঝেতে যে মোজাইক পাথরের আঁকিবুঁকি ছিল, সেগুলোর ওপরে! আসলে ঘটনাটার শুরু হয় এভাবে—আমি আমার বড় দুই বোনের ড্রয়িং ক্লাসের খাতা দেখে অতি উৎসাহিত হয়ে সব সময় সেটা কপি করার চেষ্টা করতাম। সেখানে একটা চেনা ছবি ছিল, ‘গ্রামের দৃশ্য’। শহরের ড্রয়িং ক্লাসে কোনো একটা অদ্ভুত কারণে গ্রামের দৃশ্য সবচেয়ে বেশি আঁকা হয়। আমি সেই দৃশ্য দেখে আমার বাবার অতি জরুরি একটি লেখার কাগজের উল্টো দিকে একটা কালো সাইনপেন দিয়ে বিরাট করে এঁকে দিয়েছিলাম একটা গ্রামের ঘর আর তার ওপরে কলাগাছ। নিচে বড় করে লেখারও চেষ্টা করেছি, ‘কলাগাছ’। ছবিটা অনেকটা এ রকম—

ফলাফল আমার শিল্প প্রতিভায় আমার বাবাকে প্রায় পুরো লেখাটাই আবার লিখতে হলো। তবে এর পরে যেটা হলো, আমার বাবা তাঁর খবরের কাগজে লেখার জন্য যেই নিউজপ্রিন্ট কাগজ ব্যবহার করতেন, সেটার একটা প্যাড আমাকে দিয়ে দিলেন। আমাকে আর পায় কে? তবে অচিরেই আমার শিল্পচর্চার জোরে সেই কাগজের প্যাড শেষ হয়ে গেল।

মোটামুটি কয়েক শ গ্রামের বাড়ি আর ওপরে কলাগাছ এঁকে আমি ভরিয়ে ফেললাম। অচিরেই আবার জরুরি কাগজপত্রে আঁকা শুরু করতে পারি ভেবে আমার মেজ বোন একটা দারুণ বুদ্ধি বের করলেন। তিনি আমাকে দেখালেন—কাগজ ছাড়াও যে আঁকা যায়। মেঝেতে মোজাইকের পাথর টুকরোগুলো একেকটা একেক রকম। একটা পেনসিল দিয়ে সেই পাথরের টুকরোগুলোর ওপর দাগ দিয়ে একেকটাকে একেকরকম করে আঁকা যেতে পারে। কোনোটা হাতি, কোনোটা যুদ্ধের ট্যাংক। আর চাইলে সেটা মুছেও ফেলা যায়। আমার সামনে বিরাট দুনিয়া খুলে গেল।

হাজার হাজার পাথর মেঝেতে, বাকি জীবন এগুলো এঁকেই কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি পেনসিল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এখন বুঝি, যেকোনো আঁকিবুঁকি থেকে যা ইচ্ছা তাই আঁকার চর্চাটা ভীষণ কাজে দেয়। আমি একটা নতুন খেলা পেয়ে গেলাম, আর বাসার সবাইও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তবে আঁকাআঁকি করতে গিয়ে সে সময় সম্ভবত আমিই একমাত্র শিল্পী যার আঁকতে আঁকতে প্যান্টের হাঁটু ক্ষয়ে যেত। এবারে আবার নতুন সমস্যা, দুই-তিন মাস না যেতেই—প্যান্ট কিনে দাও।
যা-ই হোক, এটা আসলে একেবারেই ছোটবেলার কথা। মানে বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। এর ঠিক পরপর আমি যখন ক্লাস টু-তে ভর্তি হই, তখন ঘটে আমার শিল্পীজীবনের এক বিরাট পরিবর্তন। মেঝে ছেড়ে আমি তখন বাবার নিউজপ্রিন্ট প্যাডে আঁকি, আর পেনসিলের বদলে তখন হাতে থাকে বলপেন। এই সময়ে এসে আমি পরিচিত হই আমার জীবনের হিরোর সঙ্গে, যার নাম—টারজান। রাসেল জর্জ ম্যানিং নামের এক অসাধারণ আঁকিয়ে টারজানের কমিক স্ট্রিপ আঁকতেন, যেটার একটা করে স্ট্রিপ ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রতিদিন ছাপা হতো। আমার দিনের প্রথম কাজ ছিল সেটা পড়া এবং তার পরেই গম্ভীর মুখে টারজানকে আঁকা; বিশেষ করে তার বাইসেপ আর ডেলটয়েড, মানে কাঁধের পরের পেশিটুকু খুবই যত্ন নিয়ে আঁকতাম।
প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টার মতো আমি শুধু টারজানই আঁকতাম। তখন আমি মনে মনে স্থির করি যে বড় হয়ে আমি টারজানই হব। আফ্রিকা না হলেও সুন্দরবনে গিয়ে এভাবে গাছের ওপরে বাড়ি বানিয়ে থাকতেই হবে আমার। কমিকস আঁকার জন্য আসলে সেই সময় থেকেই আমার দারুণ আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। সেটা এখন বুঝি।
এবারে আঁকাআঁকি নিয়ে কিছু কথা বলি শেষে। আমি জানি তোমরা অনেকেই অনেক সুন্দর আঁকো। কেউ যদি আসলেই ভাবো যে আরও ভালো করে আঁকবে, আর অনেক অনেক আঁকবে, তাহলে আমার নিজের এই অদ্ভুত আঁকাআঁকির শৈশব থেকে বলতে পারি—শুধু ড্রয়িং ক্লাসের জন্য না আঁকাই ভালো। আশপাশে যা দেখো বা যা পড়ো—কমিকস, কার্টুন, ইলাস্ট্রেশন; সেখান থেকে আঁকো। কোনো প্রতিযোগিতায় বাবা-মা বা ড্রয়িং টিচার যেভাবে বলে দেবেন, সেই গৎ বাঁধা একটা কিছু আঁকার চেয়ে নিজের যেটা মনে হয়, সেটা আঁকাই ভালো।

দাদু–নাদু
দাদু–নাদু

যেমন আমার একটা ঘটনা বলি। ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ার সময় আমি একবার একটা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। সত্যি বলতে, আমার কোনো ধারণাই ছিল না কী আঁকা যায়। প্রতিযোগিতা শুরুর পরে অনেক ভেবেটেবে আমি আঁকলাম—একদল মুক্তিযোদ্ধা একটা পোড়ো বাড়িতে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছে, ওদিকে এক কোনায় একজন আবার ভাত রান্না করছে। অন্য সবাই আঁকল অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধা, গোলাগুলি, পতাকা। রেজাল্ট যখন দিল, তখন দেখা গেল...না, ভাবার কোনো কারণ নেই যে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম। আসলে আমি কোনো পুরস্কারই পাইনি। কিন্তু আমি সেই আঁকাটা নিজের মতো করে নিজের ভাবনায় যা বুঝি তা-ই এঁকেছিলাম। আর সেটা করে খুব আনন্দও পেয়েছিলাম। কারণ সেটা আমার আঁকা।
আঁকাআঁকি বা অন্য কোনো শিল্পের মূল কথা কিন্তু এটাই, আনন্দ পাওয়া। সেটা না পেলে যদি আর্ট টিচার যা বললেন তাই আঁকি, হয়তো পুরস্কার পাব কিন্তু আনন্দটা থাকবে না। তাই যারা আঁকতে চাও, এখনই বসে যাও, যা ইচ্ছা হয় তা-ই আঁকো। আর ভালো হয় বাসায় মোজাইক করা মেঝে থাকলে। একটা পেনসিল নিয়ে বসে যাও সেখানে। তারপর কী করতে হবে, তা তো জানোই।