মাথামুণ্ডু নেই

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম
>তোমাকে আমি তখন থেকেই বলছি, রসগল্প লেখা সহজ কম্মো নয়। বরং তুমি এবার এসো, রাত দশটা বেজে গেছে। আর এতই যদি রস দরকার হয়, শহরের দু-একটা মিষ্টির দোকান বারোটা অবধি খোলা থাকে, সেখানে এখন বাসি রস কিছু পেলেও পেতে পার।


: ফোনে যেমনটা বলছিলাম স্যার, আমাদের এই সংখ্যাটা হবে রসগল্প নিয়ে। তবে ছোটদের নয়, বড়দের রসগল্প। তো, আপনার গল্প দিয়ে শুরু না করতে পারলে তো মুশকিলের ব্যাপার...
: রসগল্প বল আর হাসির গল্প বল, Ñচাইলেই কি আর লেখা যায় নাকি! রসগল্প লেখা এত সহজ? তাও কিনা আবার বড়দের জন্য! আর এই ভ্যাপসা গরমে মাথা থেকে শুধু লোনা ঘামই ঝরবে, রস মিলবে না।
: কিন্তু...
: আহা, আমি জীবনে কখনো বড়দের জন্য রসগল্প লিখিওনি। দু-একটা যা লিখেছি, সবই ছোটদের জন্য। তুমিও নিশ্চয় সবই পড়েছ। তবে সমালোচকেরা বলে, ওসবে হাসির থেকে কান্নার পরিমাণই বেশি।
: আপনি নিজে এত রসিক মানুষ, বক্তৃতা দিতে গিয়ে মানুষকে হাসাতে হাসাতে কাবু করে ফেলেন, আর আপনি রসগল্প লিখতে পারবেন না! এ কথা কি লোকে সহজে বিশ্বাস করবে?
: তোমার কথা শুনে সুকুমার রায়ের নাটকের সেই লোকটার মতো বলতে ইচ্ছে করছে, জল আর জলপাই কি এক হলো! আমি কথায় রসিক বলে লেখাতেও রসিক হব এমন কি কথা আছে? বিভূতিভূষণ শুনেছি আমুদে মানুষ ছিলেন, তাঁর একটা হাসির গল্প আমাকে খুঁজে দেখাও দেখি! মানিক কি তারাশঙ্করের? কিংবা আমাদের ইলিয়াসের? সে তো আড্ডায় মহারসিক কিন্তু লেখায় নির্দয়-নিষ্ঠুর!
: না স্যার, আপনি যে বড়দের হাসির গল্প লিখতে পারেন এ নিয়ে আমার অন্তত সংশয় নেই।
: তুমি দেখছি নাছোড়বান্দা, খালি বড়দের বড়দের করছ কেন হে? তাহলে কয়েকখানা অ্যাডাল্ট জোক ছাপিয়ে দিলেই তো পার।
: না না না, প্লিজ ভুল বুঝবেন না। আপনি তাহলে না হয় আপনার মাথায় যা আসে তা-ই লিখুন। দরকার পড়লে গোপাল ভাঁড়ের দু-চারটা গল্প নিজের মতো সাজিয়ে রিটোল্ডই করুন না!
: আগে বললে বড়দের হাসির গল্প লিখতে, এখন বলছ গোপাল ভাঁড়ের কাহিনি বলতে? তুমি সাহিত্য সম্পাদক না পিংপং বল? একবার ওদিকে লাফাচ্ছ, আরেকবার এদিকে! এ কি সাত-সকালে মামাবাড়ির আবদার পেয়েছ?
: ইউরেকা! এই তো বড়শিতে মাছ গেঁথেছে! মামাবাড়ির কথা যখন বললেন, তখন আপনার ছেলেবেলার মামাবাড়ির কোনো মজার ঘটনা নিয়ে আমাদের কিছু লিখে দিন। ওতেই জমবে।
: সিদ্ধান্ত পাকা তো?
: জি স্যার, একদম।
: বেশ, তাহলে আগে প্লটটা শোনো। তোমার পছন্দ হলে গুছিয়ে লিখে দেব। ছেলেবেলায় মামাবাড়ির প্রতি আমাদের যে টান ছিল, তা তোমরা শহুরে তরুণেরা জীবনেও বুঝতে পারবে কি না সন্দেহ। বর্ধমানে আমার এক দূরসম্পর্কের মামা ছিলেন, তাঁর নিজের বাড়িতে বিশেষ কোনো অবস্থান ছিল না। নেহাত আশ্রিত হিসেবে থাকতেন। স্বভাবে সরল ছিলেন দেখে এতে প্রথমে কারও কোনো আপত্তি ছিল না। তবে তাঁর ছিল বাইরে বাইরে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ানোর শখ, কিন্তু এই করতে গিয়েই এক ফকিরের পাল্লায় পড়ে তিনি পাক্কা গাঁজাখোর হয়ে যান।
: কিন্তু এখানে হাসির কিছু এখনো তো পাচ্ছি না...
: আরে রোসো! ধৈর্য না ধরলে কি কেষ্ট পাওয়া যায়? তো, মামা গাঁজার নেশায় পড়ে বেড়ানোর শখ মিটিয়ে শেষমেশ বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু আদপেই শোধরালেন না। বরং বাড়িতে খানিক থিতু হয়ে গ্রামের আরও কিছু গাঁজাখোরকে জুটিয়ে একটা দল বানালেন। যাদের কাজ ছিল রোজ সন্ধ্যায় বাড়ির গোয়ালঘরের দখল নিয়ে গোল হয়ে বসে গাঁজা টানা আর হইহল্লা করা।
: স্যার, এখানে রস কই! রস! গল্প পড়ে যদি পাঠকের মুখে হাসিই না আসে, তাহলে তো আমি মুশকিলে পড়ব। তার ওপর দেশে এখন সর্বাত্মক মাদকবিরোধী অভিযান চলছে, গাঁজার কথা লিখলে যদি আবার...
: আজকালকার ছেলেপেলেদের এই এক সমস্যা, অস্থির! আরে বাবা, রস কি সহজে আসার জিনিস? খেজুরগাছের রস কী করে হাতে আসে কখনো দেখনি? প্রথমে মুখ কাটো, পরে কলসি বাঁধো, সময়মতো অপেক্ষা করো, তারপরেই না রস গেলাসের মারফত পেটস্থ হবে!
: আচ্ছা আচ্ছা, আমি শুনছি।
: সেই মামা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা একদিন সবাই মিলে আরামসে গাঁজা টানতে বসেছেন। অমাবস্যার রাত। গাঁজাখোরদের একটা নিয়ম আছে, কেউ কলকেতে একসঙ্গে দু-টান দিতে পারবে না, এক টান দেওয়ারই নিয়ম। কারণ, দু-টান দিলেই কেল্লা ফতে। হয় দমের চোটে মাথা ফাটবে, নয়তো মগজ প্রায় অচল হয়ে যাবে। মামা ওই দিন মনে হয় কলকেতে দু-টান দিয়েই ফেলেছিলেন। গোয়ালঘরের মাঝখানে গোবর জড়ো করে একটা বিরাট গামলায় রাখা হয়ে থাকে সাধারণত, পরে সার হিসেবে খেতে দেওয়া হয়। একেবারে দু-টান দেওয়ার পর মুহূর্তে, নেশার জোরেই তিনি ছুটে গিয়ে পড়লেন ওই গোবরের গামলায়। আর তাতে তাঁর সে কী আনন্দ! মহানন্দে ঝাঁপাঝাঁপি করতে শুরু করলেন। গাঁজাখোর সঙ্গীদের মধ্যে যাঁদের তখনো একটু-আধটু জ্ঞান ছিল, তাঁরা যখন মামাকে উদ্ধার করতে গেলেন, তখন তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘ওরে, আমি তো ছানার গামলায় ডুবে আছি রে! তোরা আমাকে কেন তুলে আনছিস রে!’
: কেমন কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা মনে হচ্ছে! আর পাঠক উল্টো ছি ছি করতে পারে এইসব গোবরটোবরের কথা শুনে।
: আরে বাবা, তুমিই তো বললে রসগল্প! তা রস মানে কি শুধু হাস্যরস? রসশাস্ত্র পড়েছ কোনো দিন? পড়লে পরে জানতে, বীভৎস রসও তো হয়! আর গল্পটা তো এখনো শেষ করিনি। বাকিটা শুনে তারপর বল।
: ঠিক আছে, ঘটনার শেষটুকু বলুন।
: তারপর ওই গোবরকাণ্ড নিয়ে অনেক হাসিতামাশা হলো ঠিকই, কিন্তু মামা ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা গাঁজার আসর বসানো ছাড়লেন না। যথানিয়মে তাঁদের গাঁজা টানা চলতে থাকল। এমন সময় একদিন খবর এল, মামাকে খুনের দায়ে থানা-পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। অভিযোগটি এমন, তিনি নাকি গাঁজা টানার সময় হঠাৎ চটে গিয়ে দায়ের এক কোপে তাঁরই এক সঙ্গীর মাথা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলেছেন।
: এই রে, আবার খুনখারাবি কেন! হাসির গল্প তো তাহলে আর হাসির থাকছে না!
: এক কথা আর কতবার বলব বল দেখি? একটু ধৈর্য নেই? এরপর সেই গাঁজাখোর মামাকে আদালতে তোলা হলো। বেশ কদিন শুনানি হওয়ার পর সওয়াল-জবাবের শেষে নিরাশ হয়ে আসামিপক্ষের উকিল তাঁর কানে ফিসফিস করে খেদের সঙ্গে বললেন, ‘আপনি নিজের বন্ধুর ওপর রাগ করতেই পারেন। সে জন্য তাঁকে বকাঝকা ও এমনকি একটু মারধরও করতে পারতেন—এই অবধি কোনোরকমে মানা যায়। কিন্তু তাই বলে তাঁর ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিলেন! এটা তো মানা যায় না। আপনার ফাঁসি আইনত ঠেকানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তবু আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনে কি কিছু বলতে চান? মহামান্য আদালত আপনার বক্তব্য শুনে কিঞ্চিৎ নরম যদি হন, তাহলে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন হলেও হতে পারে।’
এ কথা শুনে মামা তৎক্ষণাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দিতে রাজি হলেন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে বললেন, ‘হুজুর, ওকে মারার কোনো ইচ্ছাই তো আমার ছিল না। ও ব্যাটা আমার গাঁজার পুঁটলিটা আগের দিন চুরি করেছিল, তাই ওকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। সেই মোতাবেক ওকে দা দিয়ে দমাদম দু-চার ঘা দিই। কিন্তু তাতেই মাথা কাটা পড়বে তা তো আমি ভাবিনি। কারণ, আমি জানতাম যে ওর মাথাই নেই। আমাদের সঙ্গে গাঁজা-টাজা খায়, এই আরকি। কথা হলো, ওর মাথাই আমি কোনো দিন দেখিনি। তাই ভেবেছিলাম, ওর আদতে মাথা বলেই কিছু নেই। শুধু ধড়টুকুই সম্বল। তাই মাথার ওখানে জোরসে দা ঘোরালে ব্যাটা দারুণ ভয় পাবে আর দু-একটা শাঁই-শাঁই শব্দ হবে—এ বাদে আর কিছু হবে না।’
: এ গল্প শুনে কি কারও হাসি পাবে স্যার! এখন দেখছি আপনাকে বলেই মহা গোলমালে পড়লাম।
: আমি তো বাচ্চা বয়সে নিজের চোখে দেখেছিলাম, মামার এ কথা শোনার পর এজলাসে কেমন হাসির রোল পড়েছিল! অবশ্য পরে মামার ফাঁসি আর হয়নি, এটুকুই যা বাঁচোয়া। আদালত তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ বিবেচনা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
: সে না হয় পড়তেই পারে। কিন্তু আমাদের পাঠকেরা এ গল্প শুনে হাসবে! তাই আদৌ হয়? এটাকে বড়জোর আষাঢ়ে গল্প বলতে পারি, Ñকিন্তু এখনো যে জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে! আগামী পরশু বাদে তরশু পাতার পেস্টিং। এর মধ্যে আপনি অন্য কিছু লিখে না দিলে আমি শেষ।
: বৎস, তোমাকে আমি তখন থেকেই বলছি, রসগল্প লেখা সহজ কম্মো নয়। বরং তুমি এবার এসো, রাত দশটা বেজে গেছে। আর এতই যদি রস দরকার হয়, শহরের দু-একটা মিষ্টির দোকান বারোটা অবধি খোলা থাকে, সেখানে এখন বাসি রস কিছু পেলেও পেতে পার, পয়সাও লাগবে না, গেলে মুফতেই দিয়ে দেবে। হো হো হো!