খাটিয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছেঁড়া কাঁথাটা টেনে গায়ে দিতে দিতে রহমত ভাবছে, আজ দেরি করে দোকানে যাবে। সকাল থেকেই একটানা বৃষ্টি হচ্ছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। ১০টা বেজে গেছে, তবু অন্ধকার অন্ধকার ভাব। আকাশটা বুঝি চালুনির মতো ফুটো হয়ে গেছে। সূর্যের দেখা নেই, শীত শীত ভাব। রহমত বিছানা ছাড়ছে না। এরই মধ্যে রহিমা বার কয়েক ডেকেছে রহমতকে, তবু কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে রহমত। কেমন একটা আলস্য আলস্য ভাব। দোকানে যেতে হবে। হাতে টাকাপয়সা একদম নেই। এদিকে শাওনের শরীরটা ভালো না। অনেক দিন ধরে জ্বর চলছে—মাঝেমধ্যে বমিও করে, পেটব্যথায় চিৎকার করে। রহমত ভাবে, খোকাটা বড় কাহিল হয়ে পড়েছে। জিগাতলা বাজারের পাস করা ডাক্তারকে দেখিয়েছে, ওষুধও খাওয়ানো হচ্ছে, কিন্তু জ্বরটা কিছুতেই যাচ্ছে না। দুই দিন যাবৎ পেটের ব্যথায় চিৎকার দিচ্ছে শাওন। মনটা ভালো নেই রহমতের। বিছানা থেকে উঠবে উঠবে করছে। শাওনের গোঙানি শোনা গেল। দৌড়ে এসে রহিমা বলল, শাওন জানি কেমন করছে।
কী যে করি? ডাক্তার বলল, সেরে যাবে। কিন্তু সারার তো কোনো ভাব দেখতাছি না।
তুমি এহনি যাও। ডাক্তারের কাছে গিয়া বলো ওষুধ পাল্টায়ে দিতে।
না দেখে কি ডাক্তার ওষুধ দিব?
যাও না। দেরি কইরো না। পোলাডা আমার জানি কেমুন করতাছে। আল্লাহ, তুমি ওরে ভালা কইরা দাও।
দেহি। ডাক্তারের কাছে একবার যাই দেহি।
বারান্দার ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় রহমত। একটানা বৃষ্টি। মাঝেমধ্যে দমকা বাতাসও বইছে। কী করবে ভেবে পায় না রহমত। হাতে একটা টাকাও নেই। ডাক্তারকে তো টাকা দিতে হবে। পেরথম বাচ্চাটা হইল, কিন্তু তিন দিনের মধ্যেই রহিমার কোল খালি করে চইলা গেল আমার মাকসুদা মা। মাকসুদার জন্য রহিমা খালি কান্নাকাটি করত। বছর পাঁচেক আগে রহিমার কোলে আসে শাওন। রহিমার খুশি আর দেখে কে? চব্বিশ ঘণ্টা শাওনকে নিয়ে আছে রহিমা। কত তার স্বপ্ন—শাওনকে ডাক্তার বানাব। ফুটফুইট্টা একটা বউ আনব ঘরে। আরও কত-কী স্বপ্ন রহিমার। তার মনেও অনেক স্বপ্ন। শাওনকে পড়ালেখা শিখাব, বড় চাকরি করব। সংসারে আর অভাব থাকব না, শেষ জীবনে শাওনের বউ তাকে যত্ন-আত্তি করব। নাতিপুতিতে ঘর ভইরা যাব।
বেড়িবাঁধের ধারে ছোট্ট বাসাটায় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছিল রহমত। গলির মুখে শজনেগাছটায় একটা কাক বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু বসে আছে। কালো করে আছে আকাশ। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। নিজের বাবার কথা মনে নেই রহমতের। ছোট থাকতেই বাবাকে হারিয়েছে। মা অনেক কষ্টে আর মেহনতে তাকে বড় করে তুলেছে। মেঘনা নদীর পাড়ে ছিল তাদের বাড়ি। বড় ঘর, গোয়ালঘরে গরু, চারদিকে গাছপালা। নদীর ভাঙনে সব শেষ। কোথায় যাবে সখিনাবিবি রহমতকে নিয়ে? আত্মীয়স্বজনের অবস্থাও এমন নয় যে কারও বাড়িতে গিয়ে উঠবে। মনে পড়ল গ্রামের ছেলে মকবুলের কথা। মকবুল ঢাকায় থাকে। ঈদের সময় বাড়ি আসে। ঢাকায় ভালোই আছে মকবুল। ও একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে পারবই—ভাবে সখিনাবিবি। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে একদিন রহমতকে নিয়ে লঞ্চে উঠল সখিনাবিবি। ওমা, ঢাকা এত্ত বড় শহর! এহানে কেমনে পামু মকবুলরে। ঠিকানাটা ধরে বহু খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল মকবুলকে। রায়ের বাজারের বেড়িবাঁধের পাশে মকবুলের বাসা। ঢাকায় কাঠের ব্যবসা করে, ভালোই আছে মকবুল। সব শুনে সখিনাবিবির থাকার জন্য একটা বাসা ঠিক করে দেয় মকবুল। বেড়িবাঁধের পাশেই বস্তির মতো একটা পাড়ায় রহমতকে নিয়ে শুরু হলো সখিনাবিবির যুদ্ধ। রায়ের বাজারে ধনী এক ব্যবসায়ীর বাসায় একটা কাজও ঠিক করে দেয় মকবুল। মকবুলের কাঠের দোকানে গিয়ে বসে রহমত এটা-সেটা করে। দিন চলে যায় একরকম সখিনাবিবির। একসময় সখিনাবিবি ঘরে নিয়ে আসে রহিমাকে—মকবুলের বউ করে। বস্তিরই জয়নালের মেয়ে রহিমা। কয়েক বছরের মধ্যে সেই মা-ও চলে গেল পৃথিবী থেকে। মায়ের জন্য মনটা হু হু করে ওঠে রহমতের। তারপর এল মাকসুদা, সে-ও চলে গেল। এরপর। হঠাৎ রহিমার গলা শোনা গেল—
কী, এহনও দাঁড়াইয়া রইলা যে? ডাক্তারের কাছে যাইবা না? পোলাডা কি মইরা যাইব?
বৃষ্টির গতিক দেখছিলাম। বৃষ্টিটা একটু ধরলেই যামু।
এহনি যাও গো। আর দেরি কইরো না। পোলাডা জানি কেমুন করতাছে। মাকসুদার মতো কি শাওনও—
কথাটা শেষ করতে পারে না রহিমা। রহিমার কথা শুনে আঁতকে ওঠে রহমত। নিচু গলায় বলল, কী যে করি? বৃষ্টি থামার তো কোনো ভাব দেখছি না। কী গতিক যে করি? পোলাডারে লইয়া বড় বিপদেই পড়লাম। পান্তা আছে? দুইডা পান্তা দাও। খাইয়া যাই দেহি দোকানে।
কিছু জমানো টাকা আর মকবুলের কাছ থেকে ধারকর্জ করে রহমত ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে দোকান দিছে জিগাতলা বাজারে। খাটিয়া বিক্রির দোকান। মকবুলই বুদ্ধিটা দিছে। দোকানের নামটাও দিছে মকবুল—বিদায় স্টোর্স। দেশের বাজার থেকে কাঠ এনে নিজেই খাটিয়া বানায় রহমত। মন্দ চলে না। নিজে বানায় বলে তার খাটিয়ার দাম বেশি পড়ে না। ঢাকা শহরে তো লোকজনের অভাব নেই—মানুষ তো মরবেই। দোকানে বসে বসে রহমত কখনো ভাবে, আমি কী চাই মানুষ মরুক? নাহলে এ ব্যবসায় এলাম কেন? মনটা ভালো লাগে না রহমতের। মনে মনে ভাবে, একটু সুবিধা হলে এ ব্যবসা ছেড়ে দেবে। তারপর? তারপর শুধু কাঠের ব্যবসা করবে মকবুল ভাইয়ের মতো। দু-একসময় ভালো বিক্রি হয় খাটিয়ার। আবার কখনো কখনো বিক্রিবাট্টা তেমন থাকে না। তবু চলে যাচ্ছে রহমতের সংসার।
পান্তা আর কাঁচা মরিচ একটা প্লেটে নিয়ে রহমতকে ডাক দেয় রহিমা। বারান্দায় শাওনের গোঙানি শোনা যাচ্ছে। থেমে থেমে গোঙাচ্ছে শাওন। ও যেন ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে উঠল রহমত। আর দেরি করন যায় না। মনে হয় বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে। রহিমাকে ডেকে বলল, যাই। চিন্তা কইরো না। আমি দোহানে যাই। বিক্রিবাট্টা হইলে ডাক্তারের কাছে যাইব। তুমি পোলাডারে দেইখো। রহমত বারান্দা ছেড়ে বাইরে পা বাড়ায়। আবার কী ভেবে ঘরে ঢোকে। ভেজা হাতেই শাওনকে একটু আদর করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। রহিমা ডেকে বলে—
আগে ডাক্তারের কাছে গেলে অইত না?
পয়সাকড়ি একদম নাই। ডাক্তার তো আর এমনি এমনি ওষুধ দিব না। এই বাদলার দিনে ডাক্তার ফার্মেসিতে আসে কি না, কে জানে?
দেহো গিয়া। যা ভালো মনে করো। মোর জানি কেমন ডর লাগতাছে।
বৃষ্টির মাঝে জোরে হাঁটতে হাঁটতে রহমত জবাব দেয়, ডরের কী? আল্লাহ দেখব। যাই। রহমতের কথাটা রহিমার কানে পৌঁছাল কি না, বোঝা গেল না। শাওন জোরে জোরে গোঙাচ্ছে। এখন গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই রহিমার কানে যায় না। রহমতের পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে যেন কেমন আনমনা হয়ে যায়। ভয় ঢোকে রহিমার মনে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই রহমত পৌঁছে গেল জিগাতলা বাজারের দোকানে। ছাতাটাতা নেই অনেক দিন ধরে। কিনব কিনব করেও কেনা হয়নি। বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গেছে রহমত। বাজারে তেমন লোকজন নেই। ঝড়-বাদলায় সবাই কি বাসায় ঘুমাচ্ছে? কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। বাতাস বইছে জোরে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা রিকশাওয়ালা হিন্দি গান গেয়ে জোরে বেরিয়ে গেল। বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগল রহমতের মুখে। বিদায় স্টোর্সের ঝাপটা খুলল রহমত। ঘরে ঢুকে গা-টা ভালো করে মুছে খরিদ্দারের অপেক্ষায় বসে থাকল। রাস্তার ওপারে ঝিলমিল হোটেলটা খোলা। দু-একজন লোক দেখা যাচ্ছে ওখানে। মিনা ফার্মেসিটা কি খোলা আছে? ডাক্তার সাব কি এসেছে? এসব ভাবছে আর অপেক্ষা করছে খাটিয়া কেনার জন্য কেউ একজন আসুক। কী ভাবছে রহমত? মানুষ মারা যাক, এটাই কি রহমতের ভাবনা?
মনটা ভালো নেই রহিমার। শাওনের জ্বরটা আবার বেড়ে গেল। সকাল থেকে কিছুই খাওয়ানো যায়নি। খেলেই বমি করে দেয়। মাগরিবের তো বেশি দেরি নেই। ওর আব্বা তো এহনো আইল না। কী যে করি? একবার যামু নাকি মকবুল ভাইয়ের কাছে? বাইরে বৃষ্টি। মকবুল ভাইকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে খালি ঘরে আনা কি ঠিক অইব? বলা তো যায় না। দেহা অইলে কেমন করি যেন চায় আমার বুকের দিকে। ছি, কী ভাবছি? আমাদের কত সাহায্য করে মকবুল ভাই। শাওনের গোঙানির শব্দ বেড়ে যায়। ভাবনায় ছেদ পড়ে রহিমার। বাইরে বৃষ্টি বাড়ে, বাড়ে ঝোড়ো বাতাস। শাওনের শিয়রের পাশে বসে রহিমা শাওনের কপালে হাত দিয়ে চমকে ওঠে, এ তো আগুন!
মন ভালো নেই রহমতের। ব্যবসাটার প্রতি আগের মতো মনোযোগ নেই। রহমত ভাবে, মানুষ মরলেই কেবল খাটিয়া লাগে। তাইলে কি আমি মানুষের মরার কথাই ভাবি সব সময়? মায়ের কথা মনে পড়ল আবার। ছোট উঠানটায় একটা খাটিয়া। মায়ের শরীরটা বস্তির চার-পাঁচটা ছেলে ধরাধরি করে খাটিয়ায় শোয়াল। ছোট্ট শাওন হুট করে খাটিয়ায় উঠে দাদির পাশে শুয়ে পড়ল। সবাই ধরাধরি করে শাওনকে ঘরে নিয়ে গেল। সবকিছু যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে রহমত।
অপেক্ষা করতে করতে রাত নেমে এল। শুরু হলো জোর বাতাস। বিদ্যুৎ চলে গেল। বাজারে লোকজন একেবারে নেই। রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি পানি ঢেলে চলে যাচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টি, বজ্রপাত। রাস্তায় পানি জমে গেছে। এটা কি রাস্তা, না খাল? কমিশনার ব্যাটার কোনো কাজ নেই, খালি কামানোর তালে থাকে। রাস্তাঘাটের দিকে কোনো নজর নেই। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির পানি ঢুকছে ঘরে। ঝাপটা বন্ধ করে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে রহমত। পোলাডা কেমন আছে? রহিমা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছিল। এখনো কোনো বিহিত করতে পারলাম না। কত সময় বসে আছি। একটা খাটিয়াও বেচতে পারলাম না। দেহি রাইত ১০টা পর্যন্ত থাহি। তারপর দেহা যাবে। বৃষ্টি-বাদলায় তো নানা অসুখ-বিসুখের কথা শুনি। কেউ কি...। না, রহমতের ভাবনাটা থমকে যায়।
শাওনের গোঙানিতে তন্দ্রা ভাঙে রহিমার। শাওন শেষ শক্তি দিয়ে যেন বলছে, আম্মা, আর তো পারছি না। পেটটা ব্যথায় ফাইট্টা যাইব যে। শাওনের কপালে হাত দিয়ে আঁতকে ওঠে রহিমা। বুকে জড়িয়ে ধরে পোলারে। এই তো বাবা, ওষুধ নিয়া তোমার আব্বা এহনি আইব। তুমি ভালা হইয়া যাইবা, বাবা। শাওনের গায়ে ভালো করে কাঁথাটা জড়িয়ে দেয় রহিমা।
রহমত ভাবল, একবার দেহি আসি মিনা ফার্মেসিতে ডাক্তারসাব আছে কি না। না থাকলেও আফজালকে বইল্লা ওষুধ নিয়া আসি। বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে গেল খানিকটা দূরের মিনা ফার্মেসিতে। ডাক্তার নেই। দোকানে বসে আছে আফজাল। দুইজন লোকও বৃষ্টিতে আশ্রয় নিছে। জ্বর কমার ভালো ওষুধ কোনটা জানতে চায় রহমত। আফজাল নাপার কথা বলে। ভাই, আমারে চারটা নাপা দেও। কাইল তোমারে পয়সা দিব। রহমতকে অনেক দিন ধরেই চেনে আফজাল। একই বাজারে দোকান। বলল, কী যে বলেন ভাই। যহন খুশি দিয়েন। তয়, অসুখ কার? রহমত শাওনের অসুখের কথা বলে ওষুধ নিয়ে নিজের দোকানে ফিরে আসে। যাক, রহিমাকে তো একটা বুঝ দেওয়া যাবে। মনে মনে ভাবে, হয়তো এত সময়ে খোকাডা আমার ভালা হইয়া গেছে।
গোঙাতে গোঙাতে একসময় একটু পানি খেতে চায় শাওন। তাড়াতাড়ি পানি দেয় রহিমা। পানিটুকু মুখে দিয়ে কেমন জানি বিছানায় পড়ে যায় শাওন। শাওন নামটা মকবুল ভাইয়ের দেওয়া। মকবুল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। যাবে নাকি মকবুলের কাছে। যা কপালে থাকে থাক। বিপদে-আপদে তো একমাত্র ভরসা মকবুল ভাই। আবদার করলে করুক। আগে তো পোলাডারে বাঁচাই। আবার ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে যায়। মনে হয় ঘরটা যেন ভেঙে পড়বে। ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তায় চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে রহিমার। স্বপ্নে দেখে, তার রাজপুত্র ছেলে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।...একি, মকবুল ভাই রহিমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়?
বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে রহমত। খাটিয়ায়, ঘুমিয়ে আছে রহমত। বাইরে জোর বাতাস। ঝড়-বৃষ্টির শব্দেও ঘুম ভাঙছে না রহমতের। স্বপ্ন দেখে রহমত। মা ডেকে বলছে, বাবা, তুই খাটিয়ায় শুয়ে আছিস কেন? খাটিয়ায় তো মরা মানুষ শোয়ায়। তুই কি মইরা গেলি নাকি?...ঘুমের ঘোরে নাক ডাকে রহমতের। হঠাৎ দেয়ালের গায়ে একটা টিকটিকি চোখে পড়ে। কুমিরের মতো বিশাল একটা টিকটিকি। টিকটিকিটা কী খাচ্ছে? মুখে একটা সাপ দেখছি।...টিকটিকি কি সাপ খায়? টিকটিকি সাপ খায় কেমনে? সাপের মুখটা হঠাৎ শাওনের মুখ হয়ে যায়।
উড়তে উড়তে রাজপুত্রটা মাকে বলছে, আমি দূরে চলে যাচ্ছি। আর তোমার কাছে আসব না। তুমি মকবুল চাচাকে নিয়া থাকো...।
টিকটিকিটা গিলতে পারছে না শাওনকে।
না বাবা, তুমি যেয়ো না। আমাকে একা রেখে তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমায় কথা দিচ্ছি, মকবুল ভাইয়ের কাছে আমি যামু না, যামু না।
টিকটিকি শাওনকে খাবে কেমনে? আমার শাওন যে বীর।
আমি যাই মা। বিদায়।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় রহিমার। শাওন আর গোঙাচ্ছে না, নড়ছে না। নিথর হয়ে পড়ে আছে। রহমতের কথা মনে পড়ল রহিমার। এখনো কি তার আসার সময় হলো না? এখন এসে আর কী হবে? বসে থাকতে পারে না রহিমা। শাওনের নিথর শরীরটায় কাঁথা জড়িয়ে বৃষ্টি মাথায় জিগাতলার বিদায় স্টোর্সের দিকে হাঁটতে থাকে।
শাওনকে খাওয়ার জন্য টিকটিকিটার মুখটা কুমিরের মুখের মতো বিশাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ঝাপটায় জোরে ধাক্কা মারে সে। জোরে জোরে ডাকে, ওঠো, আর কত ঘুমাবা মাকসুদার বাপ, শাওনের বাপ। তুমি কি একটা মানুষ! তোমারে কইলাম, ডাক্তারের কাছে যাইতে। আর তুমি কিনা ঘুমাইয়া আছ? রহিমার চিৎকারে জেগে ওঠে রহমত। বুঝতে পারে না, ঝড়-বাদলায় কে তারে ডাকাডাকি করে। হয়তো খরিদ্দার আইছে। যা দাম কইব, হেই দামেই আইজ খাটিয়া বেইচা দিমু। শাওনকে ডাক্তার দেহামু। অপেক্ষা করে ভালোই হইল।
দরজাটা খোলো
আবার চিৎকার দেয় রহিমা। রহমত এবার আঁতকে ওঠে। এ যে রহিমার গলা। সেই কবে থেকে রহিমার গলা চেনে রহমত। না, ভুল হওয়ার নয়। ঝাপটা খুলতেই জুবজুবে ভেজা রহিমা ঘরে ঢোকে। বৃষ্টির জলে চোখের জল বোঝার উপায় নেই। ঘরে আলোও নেই। রহিমা হু হু করে কেঁদে ওঠে। চলো, তোমার পোলার কাছে চলো। তোমারে আর ডাক্তারের কাছে যাইতে অইব না। আর তোমার অপেক্ষা করতে অইব না। একটা খাটিয়া নিয়া ঘরে চলো।
আঁতকে ওঠা রহমতের মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল শুধু একটা শব্দ—খা-টি-য়া...